‘ক্রসফায়ার’ ও সাংবিধানিক রক্ষাকবচ

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় এ অঞ্চলের মানুষের নৈতিক অধিকার থেকে। চব্বিশ বছর ধরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিষ্পেষণ আর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণে নৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্ম অনিবার্য হয়ে উঠেছিল । বাংলাদেশ আজ বিশ্ব পরিসরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে তার জনগনের শ্রম, ঘাম আর মেধার জোরে এবং তার শক্তি ন্যায়ের পক্ষের শক্তি হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের পবিত্রতম সংবিধানে ঘোষিত হয়েছে সেই পবিত্র সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা এবং মানবতা রক্ষার সুমহান বাণী।

জাত, পাত, শ্রেণি, পেশা, বর্ণ পার্থক্য ব্যতিরেকে সকল মানুষের জন্যে সংবিধানের তৃতীয় ভাগের অনুচ্ছেদ-২৭ এ ঘোষিত হয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সমতার কথা। অনুচ্ছেদ-৩১ আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার। আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্হা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।

অনুচ্ছেদ-৩২ জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকাররক্ষণ। আইনানুযায়ী জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না। অনুচ্ছেদ-৩৩ গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারন জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শ ও তাহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না । এটা যেমন সাংবিধানিক আইন, তেমনি Principle of Natural Justice। এমনকি মানবাধিকারের সার্বজনিন আন্তর্জাতিক ঘোষনা/চার্টারের মধ্যেও আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়টি আছে।

অতএব, সাংবিধানিক আইন ও সার্বজনিন মানবাধিকার ঘোষণার বাইরে গিয়ে কিছু করলে সভ্য সমাজ তা মেনে নিতে পারে না। আমাদের যেটা ভাবতে হবে তা হলো, সহিষ্ণুতা ও বিবেকসম্মত আচরণ ও ভাবনার সক্ষমতা সমাজ হারিয়ে ফেলছে কিনা?
যদি তাই হয়, তবে ভাববার বিষয় এটি। পিপল সাইকোলজির যদি এক্সট্রিম পছন্দ হয়ে যায়, তাহলে সমাজে, রাজনীতিতে ও দর্শনে চরমপন্থার এবং ঘৃনার বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা আধিপত্য লাভ করবে। অন্যকে মানতে অপারগতা আসবে। সেটা সামাজিক অস্থিরতার চোরা স্রোত ধরেই বিকশিত হবার সুযোগ পায়। সময়টা সমাজের বুদ্ধিভিত্তিক অংশের জন্য পরীক্ষার এবং একই সাথে পরিপক্বতা প্রদর্শনেরও বটে। এটা সত্য যে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হলেই মানুষ এভাবে ভাবতে শেখে। ব্যাপারটা সত্যিই হতাশার।

বাংলাদেশ বিশ্বসভায় স্থান পেয়েছে তার নৈতিক লড়াইয়ের জন্য। তার অধিকারের জন্য লড়াই, ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, মাড়ি ও মড়কের বিরুদ্ধে তার যুগযুগান্তরের লড়াই। সেসব লড়াইয়ে বিশ্বের নৈতিক সমর্থন বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। সেনা শাসন-স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বিশ্বের হাজার হাজার গনতন্ত্রকামীদের শুভেচ্ছা কুড়িয়েছে। আজ কোনভাবেই বাংলাদেশের নৈতিক শক্তির পরাজয় মুখ বুজে মেনে নেওয়া যায় না।

একরাম কি বা কেমন ছিলেন, সে প্রশ্ন আমি এখানে করবো না। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন নাগরিক হিসেবে আমার প্রশ্ন হলো- একরাম ও তার পরিবারের সাথে যা হয়েছে তা কি মেনে নেওয়া যায়? না, কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা আইনবহির্ভূত কোন হত্যাকাণ্ডই মেনে নিতে পারি না। আমরা নিজেদের সভ্য সমাজ ও জগতের সভ্য হিসেবে মানি। যদি তাই দাবি করি, তাহলে সভ্যতা-ভব্যতার মানদণ্ড আমাদের মেনে চলতেই হবে। না হলে বিশ্বসভায় আমাদের মুখে চুনকালি পড়বে এবং আমাদের সাথে নৈতিক আচরণের দাবি জানানোর অধিকার আমরা হারাবো।

তাই রাষ্ট্র ও সমাজে আমাদের বিবেক জাগাতেই হবে।

শেয়ার করুন: