বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

উদয় শংকর দুর্জয়

কামরুল বসিরের কবিতায় একাকীত্বের বিহ্বলতায় শব্দরা জেগে থাকে



চিত্রকল্প আর ফিরে দ্যাখা গল্প-কথা সমূহ উঠে আসে একসাথে; রোশনাই আলো জ্বলে ওঠে, যখন কামরুল বসির লিখতে বসেন। ভাবনার পতঙ্গ পাখায় আশ্রিত সময়ের রাগ-অনুরাগ ঝরে পড়ে তাঁর লেখার অনুষঙ্গ হয়ে। তিনি প্রতি মুহূর্তে লেখার তাগিদ অনুভব করেন না, কিন্তু রোজ হাওয়ার সাথে গল্প করতে নেমে পড়েন, যেখানে ‘আইল অফ শেফি’র কর্ণ-দুয়ার ঘেঁষে এক শান্ত সমুদ্র বয়ে গেছে।

কবি যেখানে বসবাস করেন সেখানকার আবহ-ভাবনা-প্রকৃতি মিলেমিশে কবির লেখাকে ত্বরান্বিত করে। চিন্তার বহিঃপ্রকাশের মধ্যে অস্ফুট রোদ্দুর এসে কড়া নেড়ে পালিয়ে যায়। তারপর পাঠক খুঁজতে থাকেন সেসব পূর্বাপর সম্বন্ধ যেখানে জড়িয়ে আছে অনুবৃত্তি প্রেম ও বিষাদ। ‘হাইডপার্ক উল্টে আছে বিচিত্র শৈলশিরায়’ অথবা ‘পার্ক রোডের শিয়াল’ কবিতায় প্রবাস যাপনের ছায়াতলে কবি সেসব তুলে রেখেছেন পাণ্ডুলিপির পকেটে।

হাইড পার্কের গভীর অন্ধকার ছায়ায় কবি বসে আছেন, যেখান থেকে অনতিদূরের সব প্রতিচিত্র ভেসে ওঠে চোখের কর্ণিয়ায়। কবি বসে বসে এসব শুধু উপভোগই করেননি, বাইফোকালটির হঠাৎ উড়ে যাওয়া আর হেমন্তের শিশির মেখে হলদু ট্রাকটির পালিয়ে যাওয়া তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছে। বসির এখানে মধ্যরাতের নিসর্গ এবং বিষাদ ভরা আলিঙ্গনের চিত্রকল্প সাজিয়েছেন যেখানে রয়েছে দূরসঞ্চারী এবং গূঢ়গম্ভীরতার ব্যাপকতা। উপমার কিছু নতুন কারুকাজ দিয়ে কবিতার নান্দনিকতাকে করেছেন যথেষ্ট হৃদয়গ্রাহী। ‘হাইডপার্ক উল্টে আছে বিচিত্র শৈলশিরায়’ কবিতা থেকে-

‘আমার পরনে আদ্দিকালের প্লাস্টিক, মাথায় জুবোথুবো শুষ্ক চুলের ঢেউ;
চোখে নির্ঘুম বাতাসি পরাগ। বাইফোকালের অস্পষ্ট তারায় নিষ্প্রভ নক্ষত্রের
মৃত্যাদেশ- তিনটি পাতার একটি বোধের লহমায় সৌম কুণ্ডলীর আত্মীয়
স্থানীয়, অন্যটি ইকুয়েডরের প্রান্তিক গিরির দলিত লতা; অবশিষ্টে হাইডপার্ক
উল্টে আছে বিচিত্র শৈলশিরায়-‘

পাঠক হয়তো ভাবতে পারেন লন্ডনে আবার শিয়াল থাকে নাকি! কবির হয়তো অহেতুক বা চিন্তার বিভ্রম ঘটিয়ে বাঙলাদেশের কোনো গ্রামীণ জনপদের কথা ভেবে উঠেছেন। বাঙলার গ্রামীণ-জনপদ শিয়ালকে হারাতে বসলেও, লন্ডনে, এই হাইটেক যাপিত জীবনে শিয়াল দেখতে কবি ভুল করেননি। বর্ণচোরা শ্বাপদ যেন কবিকে মনে করিয়ে দিয়েছে বিগত খেয়াল। জীবন যেখানে ধাবিত হয় স্মৃতির ধুলো সেখানে অমলিন মেঘ হয়ে ভেসে যায়। বসির শিয়ালের বাহ্যিক রঙের সাথে আরেকটি ঘটনাকে রিলেট করেছেন; মেটাফরের চুড়ান্ত ব্যবহার দেখিয়েছেন ‘পার্ক রোডের শিয়াল’ কবিতায়। ক্যামন সেই উৎকৃষ্ট মেটাফর-

‘পার্ক রোডের শিয়ালটি তোমার মতো চুপচাপ। একটু তাকিয়ে রাস্তা পার হয়,
আমি ভাবি এই ঝমকে শহরে অনাহূত এই শ্বাপদ তোমার মতো রঙ কেন
পাল্টে আমাকে বিভ্রমে নিয়ে যায়! এ কি অদৃশ্য তমাশার বচিত্র উল্টো শ্লোক!’

দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা, মেট্রো ট্রেনের কামরা আর উষ্ণ ক্যাপাসিনো কবিকে গ্রাস করে নিয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। এসবকিছু হয়তো কবিতা লেখার রসদ যোগায় কবিকে তা নাহলে একাকী বিশাল জলরাশির সামনে দাঁড়িয়ে ভাবেন কেন– ‘যেখানে নিস্প্রভ একাদশী বর্তুল/ রেললাইনে হেঁটে বেড়ানো হলুদমুখি গিনিপিগ, আর/ পকেট ফুটো করে শুধু বিয়োগ হওয়া ঈষৎ পেনিমুদ্রা-/ সেখানে চককাটা হাওয়াই শার্টের বোতাম খুলে মধ্যবয়সী যে কবি পুরোদস্তুর/ আসমানে তাকিয়ে, তার বিষণ্ণতা কতটা বদলাতে পারে পারিপার্শ্বিক! আমি/ এ প্রশ্ন করেছিলাম সেই ভুলে যাওয়া সুখী যুবরাজকে একবার;’।

কবি জীবিকার মাঝে কবিতাকে ভুলে থাকার কথা ভাবতে পারেন না। গ্রীন পার্কের অদূরে বাকিংহ্যাম প্যালেস, যেখানে রানি এলিজাবেথ এই ঘন আধারে ঘুমিয়ে আছেন। কবি হয়তো আরও কাছাকাছি অফিসে, ব্লাডমুন উপভোগের পায়তারায় অবচেতন মনকে শাসন করছেন। ম্যাপল গাছের গাঢ় ছায়া এসে পড়েছে কবির আশে পাশে। তখন হঠাৎ তাঁর মনে হলো রাণী এলিজাবেথ কি কবিতা পড়েন? না পড়লেও ক্ষতি নেই, কবিতার সবার পড়ার জন্য লেখা হয় না। এসব ভাবনা বসিরকে কখনও তাড়িত করে না। তিনি কবিতাকে আপন সৃষ্টির বলয়ে রেখে যেতে চান; নিভৃতচারিতার সাথে ভাবনার ভাগাভাগি করে আনন্দ পান।

কবি বসিরের শব্দ ভাণ্ডারের  উপচে পড়া ভিড়ে পাঠক যেন হারিয়ে ফেলেন বন্দর। তাঁর কবিতা এক বিশাল সমুদ্রগামী জাহাজের মতো। উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে যেভাবে পড়ে থাকে জাহাজের পেরিয়ে যাওয়ার কৌশল, বসিরও তেমনি রেখে যান কবিতার এক রহস্যময় রঙ। কবি পাঠককে ভাবাতে চান, নিয়ে যেতে চান সেখানে, যেখানে পাঠক বিহ্বলতার মেঘলা বালুচর পেরিয়ে শাশ্বত এক দুরন্ত ঘোড়ার দ্যাখা পায়। কারণ তাঁর কবিতা থামতে জানে না; ভাবনার বিস্তৃত জাল বুনে বহুদূর যেতে চায়।

কবি কখনও অবিনশ্বর প্রেমের মাঝে দ্রুতগামী ট্রেন ছুটিয়ে হারিয়ে যান। শ্বেত বর্ণের রমণী যখন তার ধবধবে মাংসের স্তুপ বেসামালের দ্বারপ্রান্ত থেকে বাঁচাতে গিয়ে, এক মোহিনী বেলার হাসিয়ে দিয়ে পালাতে চায়, তখন কবি দ্যাখেন জানালার বাইরে প্রকাণ্ড এক নক্ষত্র চেয়ে আছে নির্লজ্জভাবে। কাফকার সাথে তখন মনোযোগ ছুটে যায়; ওমর খৈয়ম তাঁর রুবাইয়্যত নিয়ে হাজির হয়। কবিতার শিরোনাম- ‘কাফকার খৈয়ম পাঠ এবং মনেটের সাথে বিচিত্র সন্ধ্যা’ — কবি এই কবিতায় তাঁর এক যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়েছেন। উঠে এসেছে একটি ট্রেন জার্নির গল্প যা পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে কুইনবরা থেকে লন্ডনে।

এবার ‘ভালোবাসা’ কবিতায় কবি লন্ডনের রেডব্রিজের সাথে ধাকার গোড়ানের চৌরাস্তার রিলেট করেছেন, যেখানে প্রেম ও প্রিয়জনের পারষ্পারিক দিনবদলের আবহকে বিলেতে বসে বিনির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন। বসির অগণন নক্ষত্রের ছায়া ভেঙে চেপে বসেছেন বাসের পেটে কারণ তিনি প্রিয়তমার শহর ভেদ করে হারিয়ে যাবেন গন্তব্যে। ‘সীমারেখা’ কবিতায় কত সহজেই সাজিয়ে দিচ্ছেন চিত্রকল্প, তারই মাঝে উপমা উৎপ্রেক্ষাকে বসিয়ে যেন বিবস্ত্র আকাশটাকে পরিয়ে দিচ্ছেন ঝুমকো লতার পোশাক।

কবি বসির হেমন্তের পাতা ঝরা দিনগুলোতে বেরিয়ে পড়েন। ম্যানর পার্কের হ্রদের অগভীর শয্যায় হাঁসেদের সাঁতার কাটা দেখে আপ্লুত হন। অস্কার ওয়াইল্ডের খেরোখাতা খুলে বসেন নির্জনে। কবির এই  নির্জনতা কবিকে আরও বেশি সৃষ্টিশীল করে তোলে যেমনটি করেছিল জীবনানন্দকে। ‘জোছনার বন্দনা ও একটি আক্ষেপ’ তারই উৎকৃষ্ট প্রতিফলন। এখানে কবি তাঁর জাত চিনিয়েছেন। কবি হয়তো পাখি বিশরদ নন তবে তিনি যে শব্দ বিশারদ তাতে কোনো সন্ধেহ নেই। পড়া যাক সে কবিতা থেকে –

‘কয়েকটি হাঁস জোছনায় ম্যানর পার্কের হ্রদে সাঁতার কাটে, রুপার মতো
চাঁদের আলো তাদের শাদা আর বাদামি পালক ছুঁয়ে গেলে- দুরতম ম্যাপল  
গাছটি ভাবে, এখন জোছনা আর হেমন্তের শেষপাতাঝরা একত্রে বিষাদ পুষে
এনেছে; অথচ সবাই সঙ্গত একা।

কবি মূলত এই কবিতায় নিঃসঙ্গতার এক মেটাফরিক বয়ান দিয়েছেন। একাকীত্ব কবিতার এক দীর্ঘ জীবনের সঙ্গী সেখানে কবি নিসর্গ, পার্থিব, অপার্থিব, কল্পনা, বাস্তবতা সবকিছুকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে বাঁচাতে চান স্রোতের বিপরীতে খড়কুটোর মতো। মন তাঁর চায় ভেসে যেতে কিন্তু তিনি যে পারেন না। এখানেই কবি কামরুল বসিরের সার্থকতা।

তাঁর কবিতা গভীর পাঠের পরবর্তী মুহুর্ত খুব ভাবাবেগের হয় তাই প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে। তিনি একটি কবিতার জন্য লেখার জন্য এতো অনুষঙ্গ বেছে নেন যে, তা মনোজ্ঞ না হয়ে পারে না। ‘জনারণ্যে শুনিনি সহিসের ডাক’ কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে সেইসব সংগতবিহীন জীবনের এক সরল উপপাদ্য। যা পাঠককে ভাবিয়ে তুলতে একবারও দ্বিধাবোধ করবে না। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ পেয়েছে ২০১৯ ঢাকা বইমেলায়। প্রকাশক – অনার্য পাবলিকেশন্স। বইটির বিনিময় মূল্য ধরা হয়েছে – ১৮০.০০ টাকা।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!