সাকিব আল হাসানের কাছে কাল স্যাবাইনা পার্কের উইকেট একটু আর্দ্র মনে হয়েছিল। পেসারদের কথা ভেবেই টস জিতে বোলিং নিয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। কিন্তু ভাবনাটা আর কাজে লাগেনি। উইকেট প্রথম দিন থেকেই স্পিনবান্ধব! বল বাঁক নিয়েছে, ব্যাটে এসেছে থেমে থেমে। আর তাই প্রথম দিনে পেসাররা বলতে গেলে অলস সময়ই কাটিয়েছেন।
প্রথম দিনে প্রথম ইনিংসে বৃহস্পতিবার ৪ উইকেটে ২৯৫ রান তুলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টেস্ট ব্যাটিং টেম্পারামেন্টের আরেকটি প্রমাণ দেওয়া ইনিংসে ব্র্যাথওয়েট করেছেন ১১০ রান। সিরিজে তার টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। ৮৪ রানে দিন শেষ করা হেটমায়ারের সামনে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির হাতছানি।
অথচ প্রথম সেশনে খানিকটা এগিয়ে ছিল বাংলাদেশই। দ্বিতীয় সেশন থেকে বদলাতে থাকে চিত্র। তৃতীয় সেশনে দারুণ খেলে দিনটাই নিজেদের করে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
সকালে স্পিনের ঝলকে ক্যারিবিয়ানদের নাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। উদ্বোধনী জুটি থেমেছিল ৮ রানে। কিন্তু পরের তিন জুটির প্রতিটি ছাড়িয়ে যায় আগেরটিকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রমেই সরিয়ে ফেলে চাপের ছায়াগুলোকে। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে আসে ৫০ রান, তৃতীয় জুটিতে ৭৮ আর চতুর্থ জুটিতে ১০৯।
দিনের শুরুটা ছিল চমকপ্রদ। ঘাসের ছোঁয়া থাকা উইকেটে কাঙ্ক্ষিত টস জিতে বাংলাদেশ। বোলিং নিয়ে সাকিব বলেছিলেন শুরুর আর্দ্রতা কাজে লাগাতে চান। কিন্তু খেলা শুরুর পর বাংলাদেশ চমকে দিল স্পিন দিয়ে!
দুই দলের একাদশে ছিল উল্টো বার্তা। তিনজন স্পিনার নিয়ে একাদশ সাজায় বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাদ দেয় আগের টেস্টে খেলা একমাত্র স্পিনারকেও। খেলা শুরুর পর দেখা গেল, উইকেট পড়তে খুব ভুল করেননি সাকিব। ম্যাচের প্রথম সকালেই মিলল বেশ টার্ন ও বাউন্স!
সাকিব বোলিংয়ে আসেন ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারেই। এই প্রথম ম্যাচের প্রথম ইনিংসে নতুন বল হাতে নিলেন তিনি। দেশের বাইরে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের স্পিনে শুরুও এই প্রথমবার।আবু জায়েদ চৌধুরীর প্রথম স্পেলের সমাপ্তি ম্যাচের প্রথম ওভারেই। তৃতীয় ওভারে বোলিংয়ে মেহেদী হাসান মিরাজ।
ক্যারিবিয়ানদের চমকে দেওয়ার চেষ্টা হয়তো ছিল। স্পিন খেলায় ডেভন স্মিথের দুর্বলতাও নিশ্চিতভাবে ছিল একটি কারণ।
সেই পরিকল্পনা কাজে লাগে ভালোভাবেই। সাকিবের প্রথম ওভারে ক্যাচ মতো দিয়েছিলেন ব্র্যাথওয়েট ও স্মিথ দুজনই। মিরাজকে সামলাতেও দুজনের হিমশিম অবস্থা। বারবার আউট হতে হতে বেঁচে যান দুজন। ৮ ওভারে রান ছিল ৯।
প্রথম সাফল্য মেলে নবম ওভারে। ধুঁকতে থাকা স্মিথ মিরাজের বলে শর্ট লেগে ধরা পড়েন মুমিনুল হকের হাতে।
স্পিনের সামনে শুরুতে নড়বড়ে থাকলেও অধৈর্য না হয়ে ব্র্যাথওয়েট আঁকড়ে রাখেন উইকেট। তিনে নেমে কাইরান পাওয়েল বিপাকে পড়েছেন কয়েকবার। তবে সামলে নিয়েছেন পরে।
এই জুটিও ভেঙেছেন মিরাজ। দারুণ ডেলিভারিতে এলবিডব্লিউ করেছেন ২৯ রান করা পাওয়েলকে।
জুটির ধারাবাহিকতা পরের উইকেটেও। ব্র্যাথওয়েটের সঙ্গী এবার শেই হোপ। ততক্ষণে উইকেটের আর্দ্রতা অনেকটাই যায় শুকিয়ে। ক্যারিবিয়ানদের রানের গতিও একটু বাড়ে।
দুই ব্যাটসম্যানকেই যখন মনে হচ্ছিল স্বচ্ছন্দ, জুটি ভাঙে তখনই। তাইজুলের বাড়তি লাফানো একটি বলে কিপার নুরুল হাসান সোহানের দুর্দান্ত ক্যাচে ফেরেন ২৯ রান করা হোপ। দ্বিতীয় সেশনে ওই উইকেটই বাংলাদেশের একমাত্র প্রাপ্তি।
হোপের বিদায়ে আশা হারায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্র্যাথওয়েট ছিলেন নিজের ব্যাটিংয়ে অটল। দলে ফেরা হেটমায়ার দারুণ খেলে বাড়াতে থাকেন রান। এই জুটিই শেষ করে দেয় প্রথম দিনে বাংলাদেশের দারুণ কিছুর আশা।
টুকটাক সুযোগ অবশ্য দিয়েছিলেন দুজনই। ৮২ রানে মিরাজের বলে ব্র্যাথওয়েটকে স্টাম্পিংয়ের সুযোগ হাতছাড়া করেন কিপার নুরুল হাসান সোহান। যদিও সুযোগটি ছিল ভীষণ দুরূহ।আরও কঠিন ছিল তাইজুলের বলে হেটমায়ারের ক্যাচ, স্লিপে ডাইভ দিয়েও যেটি হাতে জমাতে পারেননি লিটন।
১৪৯ বলে ফিফটি করেছিলেন ব্র্যাথওয়েট। একই পথ ধরে এগিয়ে সেঞ্চুরি ২৫৯ বলে।
৪৯ টেস্টে এই ওপেনারের অষ্টম সেঞ্চুরি। বাংলাদেশের বিপক্ষে ষষ্ঠ টেস্টে তৃতীয়।
দ্বিতীয় নতুন বলেও খুব ভালো হয়নি বোলিং। এই জুটির ভাঙনটা ছিল একটু বিস্ময়কর।
নতুন স্পেলে মিরাজের প্রথম বলেই বেরিয়ে এসে চার মারেন ব্র্যাথওয়েট। তার ব্যাটিংয়ের ধরণের সঙ্গে বেমানান শটে পরের বলেই আবার করেছিলেন একই চেষ্টা। এবার ধরা পড়েন শর্ট মিড উইকেটে। শেষ হয় ২৭৯ বলে ৯ চারে ১১০ রানের ইনিংস।
শেষ বিকেলে হেটমায়ারকেও ফেরাতে পারত বাংলাদেশ। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর বলে ৮১ রানে তাকে স্টাম্পিংয়ে ফেরানোর কঠিন সুযোগ হাতছাড়া করেন সোহান।
আগের ৫ টেস্টে তার ফিফটি ছিল একটি। সর্বোচ্চ ৬৬। এবার ৯ চার ও ১ ছক্কায় অপরাজিত ৮৪ মাত্র ৯৮ বলেই।
ফর্মে না থাকা রোস্টন চেইসকে নিয়েও হেটমায়ার গড়ে ফেলেছেন ৪৮ রানের অবিচ্ছি্ন্ন জুটি।
৯২ ওভার শেষে আম্পায়াররা যখন ইতি টানলেন দিনের, সকালের সুসময়কে তখন মনে হচ্ছিল বুঝি কোন সুদূর!
তবু দিন শেষে মিরাজ বললেন – প্রথম দিনটা ভালোই কেটেছে বাংলাদেশ দলের, ‘আজ (কাল) উইকেটে একটু বাঁক ছিল আর মন্থর ছিল। আমরা স্পিনাররা চেষ্টা করেছি লাইন-লেংথে বোলিং করার। দুর্ভাগ্যবশত উইকেট পেয়েছি দুটি। হয়তো আরও এক-দুটি উইকেট প্রথম সেশনে তুলে নিতে পারলে ভালো হতো। তারপরও আমার মনে হয় সব মিলিয়ে ভালো হয়েছে। পেসাররা আজ বেশি ওভার করতে পারেনি। কারণ, উইকেট স্পিনারদের বেশি সাহায্য করেছে।’
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১ম ইনিংস: ৯২ ওভারে ২৯৫/৪ (ব্র্যাথওয়েট ১১০, স্মিথ ২, পাওয়েল ২৯, হোপ ২৯, হেটমায়ার ৮৪*, চেইস ১৬*; আবু জায়েদ ১০-৪-২২-০, সাকিব ১৮-৪-৫১-০, মিরাজ ২৭-৯-৯০-৩, তাইজুল ২১-৩-৬৫-১, কামরুল ৮-১-২২-০, মাহমুদউল্লাহ ৮-১-২০-০)।