সিলেটে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন : জামায়াত-বিএনপি দ্বন্দ্বে সুবিধায় আওয়ামী লীগ

জোটে একাধিক প্রার্থী হওয়ায় শক্ত অবস্থানে আওয়ামী লীগ

সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের ৩ মেয়রপ্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। জামায়াতের একজন এবং বিএনপির দুজন। বিএনপি নিজের দলের স্থানীয় শাখার সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিমকে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে বহিস্কার করেছে। নিজের দলের নেতাকে যেমন তারা নিবৃত্ত করতে পারেনি তেমনি জামায়াত প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে প্রবল চাপ দিয়েও প্রার্থীতা প্রত্যাহার করাতে পারেনি।

বাংলাদেশে সিলেট, রাজশাহী এবং বরিশাল – এই তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর ইতোমধ্যে প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন।

মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে কামরান আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন

তবে সিলেটে বিএনপি’র রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী দেয়ায় ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বিগত নির্বাচনগুলোতে প্রার্থিতা নিয়ে এতটা শক্ত অবস্থান নেয়নি বিএনপির-নেতৃত্বাধীন জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামী।

এবারের এই অবস্থানের কারণ ব্যাখ্যা করে বিশ্লেষকরা বলছেন, নিবন্ধন-বাতিল-হওয়া দল জামায়াত সিলেটে প্রার্থী দেয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরার কৌশল নিয়েছে।

সিলেটে জামায়াতের এই অনড় অবস্থান জোটের রাজনীতিতে কি প্রভাব ফেলবে, সেই প্রশ্ন এখন উঠছে তাদের জোটেই। নির্বাচন কমিশন অনেক আগেই জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লা এবং দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে। তাই তারা দলীয়ভাবে কোনো নির্বাচন করতে পারবে না। সে কারণে সিলেট মহানগর জামায়াতের আমীর এহসানুল মাহবুব জুবায়ের একজন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী হিসেবে ‘টেবিল ঘড়ি’ মার্কা নিয়ে সেখানে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন।

নির্বাচনী প্রচারণায় উঠান বৈঠক করছেন জুবায়ের।

তিনি যেন এই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান – সে জন্য বিএনপি অনেক চেষ্টা করলেও, তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। জামায়াত নেতা এহসান মাহবুব জুবায়ের জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে থাকবেন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, তাদের দলের স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই তিনি এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা অনুরোধ করেছিলাম, আমাদের যাতে এখানে জোটের প্রার্থিতা দেয়া হয়। সেটা হলে আমরা জোট থেকেই নির্বাচন করতাম। কিন্তু জোট আমাদের সে সুযোগ না দেয়ায় আমরা এখানে আলাদাভাবে নির্বাচন করছি’।

বর্তমান সরকারের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ কয়েকজন নেতার ফাঁসি হয়েছে। সরকারি বাঁধার কারণে দলটি বেশ কয়েক বছর ধরে প্রকাশ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারছে না।

জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, ‘শীর্ষ নেতাদের বিচারকে কেন্দ্র করে তাদের দল একটা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে জামায়াতকে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হচ্ছে না। নানা খোড়া অজুহাতে সরকার তাদের ঘরোয়া বৈঠক পর্যন্ত করতে বাঁধা দিচ্ছে। তাই গোপনে তারা নেতাকর্মীদের সংগঠিত রেখে এগুচ্ছেন। এ প্রেক্ষাপটে এখন তারা চাইছেন, তাদের দলের রাজনৈতিক শক্তি দেখাতে।’

দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সালাহউদ্দিন বাবরও জামায়াতের অবস্থানকে একইভাবে ব্যাখ্যা করছেন। তিনি বলেন, ‘জামায়াত তাদের ফোর্সটাকে তুলে ধরছে। তারা যে রাজনীতিতে আছে, সেটা তুলে ধরার জন্যই তারা সিলেটে জোটের বাইরে নির্বাচন করছে।’

জামায়াতকে জোটের শরিক হিসেবে সাথে রাখার ব্যাপারে বিএনপিকে বিভিন্ন সময় দলের ভেতরে এবং বাইরে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটের রাজনীতিতে বিএনপি জামায়াতের ভোটকে হাতছাড়া করতে চায় না বা তাদের জোটের ভোটকে ভাগও হতে দিতে চায় না। সেজন্য অনেক টানাপোড়েন চললেও দু-দল ভোটের সময় কেউ কাউকে ছাড়তে চায়নি। যদিও সরকারী দলের পক্ষ থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটে ভাঙন তৈরির জন্যে সকল প্রকার চেষ্টা প্রত্যক্ষ করা গেছে।

নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত আরিফ

এদিকে আরিফুল হকের নাম প্রার্থী ঘোষণার আগে সিলেটে জোটের একক প্রার্থী রাখার ব্যাপারেও বিএনপি অনেক চেষ্টা করেছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে সিলেটে জোটের একক প্রার্থী দেয়া সম্ভব হলো না। কারণ সেখানে জামায়াত এ বিষয়ে একেবারেই অনড় রয়েছে যে, ওখানে তাদের প্রার্থী থাকবেই। সেটা নিয়ে সেজন্য আর আমরা কিছু বলছি না।’

জোটের রাজনীতিতেও এটা ‘কিছুটা নেতিবাচক’ প্রভাব ফেলবে বলে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল মনে করেন। তিনি স্বীকার করেছন, ‘প্রভাব তো কিছুটা হলেও সাময়িকভাবে পড়েছে, বিশেষ করে সিলেটের রাজনীতিতে পড়েছে’।
মির্জা ফখরুল বলেন, এর আগে গাজীপুর এবং খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াত মেয়র প্রার্থী দিয়ে জোটে দরকষাকষি করেছিল। পরে আলোচনার মাধ্যমে সেখানে তারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। কিন্তু এবার জামায়াত সিলেটে কোনভাবেই তাদের প্রার্থীকে প্রত্যাহার করে নেবে না বলে বিএনপিকে জানিয়ে দিয়েছে।

গত কয়েক বছরে নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে জামায়াত যে কোনভাবেই হোক বিএনপির সাথে জোটে থাকতে চেয়েছে। বিএনপিও জোট ভাঙতে চায়নি। সে কারণেই এখন সিলেটে প্রার্থী দেয়ায় জামায়াতের অবস্থান নিয়ে বিএনপিতে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। দুই দলের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, জামায়াত রাজনৈতিকভাবে অবস্থান তৈরির কৌশল হিসেবে সিলেটে বিএনপির প্রার্থী দিয়ে সরকারের আস্থা পেতে চাইছে কিনা, এ রকম সন্দেহ তৈরি হলে জোটে আস্থার অভাব দেখা দিতে পারে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনে বেশি আসনে জোট থেকে প্রার্থী পাওয়ার দরকষাকষির জন্যও তারা এখন এমন অবস্থান নিয়ে থাকতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন।

সিলেটে মেয়র প্রার্থী, জামায়াত নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়ের এর বক্তব্যেও এটা বোঝা যায় যে, জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত আসন নিয়ে তাদের জোটে বড় দর কষাকষিতে যাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরিদা আখতার জামায়াতের এখনকার অবস্থানকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখছেন। ‘আলাদা প্রার্থী দেয়াটা একটা কৌশল হতে পারে। আবার তারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান বোঝার জন্যও এমন অবস্থান নিতে পারে।’
সিলেট নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে বিএনপি এবং জামায়াতের সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন দেখা দিলেও এখনও এই দুই দলের নেতাদের অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগের সরকারের বিরোধিতা থেকে তাদের স্ব স্ব দলের প্রয়োজনেই শেষ পর্যন্ত তারা তাদের জোট টিকিয়ে রাখবেন।

বিএনপি নিজের দলের স্থানীয় শাখার সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিমকে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে বহিস্কার করেছে।

নির্বাচনী গণসংযোগকালে সেলিম

এ বিষয়ে অনেকের অভিমত, নিজের দলের নেতাকে যারা প্রার্থী হওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি তারা জামায়াত প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়েরকে নিবৃত্ত করতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। একই জোটের দু-জন শক্তিশালী প্রার্থী হওয়ায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদরুদ্দীন কামরানের বিজয় প্রায় নিশ্চিত বলেই অনেকে বিবেচনা করছেন।

 

শেয়ার করুন: