আবু সুফিয়ান খান

গ্রন্থালোচনা : কবি নাজমুন নেসা পিয়ারির প্রেমে-অপ্রেমে

কবি নাজমুন নেসা পিয়ারি (ডানে) ও সমালোচক আবু সুফিয়ান খান

বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে মেঘনীল নান্দনিক বিনোদ পাখির ডানায় উড়ে উড়ে সমগ্র ইউরোপ ঘুরে ঘুরে সুদীর্ঘ দিনে আপন সত্ত্বায় বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করে জগৎ খ্যাত কবি নাজমুন নেসা পিয়ারি একজন Poet, Journalist & Author. Worked at AIWA Europe, Lives in Berlin, Germany.

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার এবং গোল্ডেন ভয়েস সম্মাননা পেয়েছেন কবি নাসমুন নেসা পিয়ারি। নাজমুন নেসা পিয়ারির সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমে-অপ্রেমে। তিনি বেঙ্গল সেন্ট্রুম এ, ফাও, বার্লিন, জার্মানি এর সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন। স্বামী প্রয়াত কবি শহীদ কাদরী ও তাঁর সন্তান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আদনান কাদরী।

দেশের একনিষ্ঠ লেখক কবি নাজমুন নেসা পিয়ারি, কবিতা রচনায় তিনি গতানুগতিক ধারা লঙ্ঘন করে গদ্য ছন্দ রীতি-শৈলীতে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন, তাঁর লেখা কবিতা গুলো গদ্যকাব্য, রীতি-শৈলী ছন্দ চাল পর্ব বিন্যাস করে সুললিত ছন্দ-মাত্রায় রচনা করেছেন। “প্রেম-অপ্রেম” বইটির কবিতাগুলো পড়লেই পাঠক অবগত ও পরিচিত হবেন শব্দ চয়নের কৌশল সম্পর্কে এবং মাধুর্যমণ্ডিত সরল কাব্যিক কারুকাজ নিরূপন সম্বন্ধেও পরিচিত হবেন। সমাজের বৈচিত্র্যময় বিষয় ও প্রকৃতির বাস্তব ঘটনাবলী প্রণয়ন করে কবি তার বই’র প্রথম কবিতা “যে ঘরে সোনালি বৃষ্টি”তে বলেছেন :—

# কিছুই চাই না আমি
শুধু একটা গাঢ় নীল পর্দা টানা ঘর
লাল রঙের একটি টেপ রেকর্ডার।
যেখানে এক সঙ্গে সবুজ হলুদ
আর নীলাভ সংগীত বেজে উঠবে।

// // //

কোমল বেগুনি রঙের বিছানায় লীন আমার সত্তা
নিঃশব্দে থাকবে শুয়ে
জল যেমন জলের ভেতরে আজীবন শুয়ে থাকে।

# ঝিমধরা স্তব্ধ দুপুরে
হঠাৎ বসন্তের উত্তাল হাওয়ার মতো
জাপ্টে ধরলে আমায়
সমর্পণের শেষ মুহূর্তে
সামলে নিয়েছি নিজেকে।
(কবিতার নামঃ “তাড়না”।)

# অামার ঠোঁটের পরে
রাখো তোমার ঠোঁট ;
সুরের পরে যেমন
সুর রাখে
গান।

আমার ঠোঁটের পরে
তোমার আলতো ছোঁয়া
প্রগাঢ় আবেগ
নিঃশ্বাসের তালে তালে
অনুভবের গভীর থেকে
গভীরে ঢুকে-
প্রবল বেগে
সবকটা বাঁধ ছিঁড়েখুঁড়ে
গহন টানে আছড়ে পড়ে।

আমার ঠোঁটের পরে
রাখো তোমার তীব্র নেশা;
খানিকটা তার তাৎক্ষণিকের
খানিকটা তার চিরকালের।
(কবিতার নামঃ “সকল প্রেম”।)

# গোলাপি ঘুমের
মোহন বিলাসে
স্বপ্নেের অনুরণনে
তোমাকে পাব কি?
(কবিতার নামঃ “স্বপ্ন দেখবো বলে”।)

# অথচ আমার আমাকে
আমিই বা কতটুকু জানি-
স্বপ্নের ঘোরে
কখন যে কি ঘটে যায়
সোনার কাঠি রুপোর কাঠির স্পর্শে
কোন মোহন অচেনায় টেনে নেয়
পারি কি তা রুখতে?
(কবিতার নামঃ “আমিই বা কতটুকু জানি”।)

কবি তাঁর সব কবিতায় প্রেম, প্রিতি ও ভালোবাসা বিষয়ক বিরহ যন্ত্রণার বিদগ্ধতার চিত্র রূপায়ন করে প্রচলিত ও প্রমিত ভাষায় সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন।

এ বইতে সবচে দীর্ঘ কবিতাটি “নিসর্গর ভালোবাসা” নামে বিয়ল্লিশ লাইনে নির্মিত।
এবং
সব’চে ছোট কবিতাটি চার লাইনের “শূন্যতা” নামে-
# “আগুন সব পোড়ালেও
থেকে যায় কিছু ভষ্ম ;
হৃদয় হৃদয়কে পোড়ালে
থাকে শুধু এক মহা শূন্যতা।”

এখানে কবি প্রেম দ্যোতনায় প্রতিবাদী হওয়ার উত্তাল প্রেরণা দিয়েছেন এবং উত্তাল যৌবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন সাবলীল শব্দায়নে।

প্রিয় পাঠক লক্ষ করেছেন কবি তার কাব্য রচনা শৈলী নির্মাণে কোনরূপ কুণ্ঠা কার্পন্য করেন নাই, ঋদ্ধহস্তে উপমা, রূপক কাব্য উপাদান ব্যবহার করেছেন, শব্দ প্রয়োগও করেছেন যথাযথভাবে। তবে বাক্যর অনুগামীতায় কিছুটা অসংগতি পরিলক্ষিত হয়, তবে কাব্যরীতি অনুযায়ী অপ্রয়োজনীয় বিরাম চিহ্ন ব্যবহার করেন নাই।

গদ্য কবিতার ধারাবাহিকতা ঠিক থাকলেও পর্ব বিন্যাসে যতি, ছেদ, চাল আরো মাত্রাবৃত্তায়ন হলে ছত্রগুলো দীর্ঘাকার হতে পারতো।

চমৎকার উপমা, অনুপ্রাস, উৎপ্রেক্ষা, রূপ-রূপক, ব্যঞ্জনাময় শব্দের বিন্যাস, কাব্যিক ছন্দ-পর্ব-রীতি-শৈলী ও সরল ঝংকারে সাবলীল বাক্য নির্মাণ, যাথোপযুক্ত উদাহরণসহ বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও উপাত্ত সম্বলিত এবং অজানা অনেক খুনসুটির অবতারণামূলক প্রেমকাঞ্চন ও জাগতিকপ্রেম অন্তরালে প্রেম রসময় সহজপাঠ্য, প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা ৩৪ টি কবিতা।
লেখকের মেধা ও মনন সুপরিচ্ছন্নভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। নাতিদীর্ঘ কবিতাগুলো সুন্দর ভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে, সহজ পাঠ্য এবং বোধে গ্রাহ্য, যা পড়ার জন্য আলাদা সময় করে নেয়া প্রয়োজন নাই।

তবে পুরোপুরি আধুনি নির্মাণ শৈলী কবিতার গায়ে বসাতে পারেন নাই, কবি চেষ্টা করেছেন তেমনও মনে হয় না। কিন্তু কবিতাগুলো পড়লে মনে না কবি কবিতা লিখতে উত্তর আধুনিক করতে চেয়েছেন, কারণ : উত্তর আধুনিক কবিতায় অনন্তগামী ইন্দ্রীয় গ্রাহ্য ভাব ও বিষয় থাকতে হয়, আমার কাছে তা প্রতিপন্ন হয় নাই, এবং রীতি-শৈলীতে অব্যয় পদের ব্যবহার হয় না, যেমন ; (তো তা এবং যদি তবে নতুবা অথবা মতো জন্য যেমন তেমন বরং ইত্যাদি), কিন্তু কবি তার কবিতায় এগুলো প্রয়োগ করেছেন। এছাড়া (মোর, আমায়, তোমায়)-এ ধরনের শব্দও বর্তমান কবিতায় ব্যবহার দোষণীয়। তবে প্রচ্ছন্ন যৌবনের স্ফূরণ কবিতার সরল রেখায় সমস্ত কবিতাকে এক কক্ষে রেখে সহজ সরল ভাষা, ভাব, উপমা, উদাহরণে বিভিন্ন ভাব ভাবনায় ছড়িয়ে বিধৃত করতে নিবিড় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
কবি আরও বাড়তি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন যে তার কবিতায় ইংরেজি শব্দ ভেডিং, লোডসেডিং, মিডয়া, স্ট্রিট, বুলডোজার, আয়ডিকোলন প্রভৃতি শব্দকে সহজবোধ্য, সার্থক ও সফলভাবে প্রয়োগ করে বাংলা শব্দ ভাণ্ডার বৃদ্ধি ও ঋদ্ধ করেছেন।

অন্যদিকে একই শব্দ বারবার ব্যবহার করে কবি প্রেমাবেগ বুঝাতে চেয়েছেন, যা বলা যায় শব্দ ভাণ্ডারে ব্যাপক মৌনতা সংরক্ষণ করেছে। যেমন “বৃষ্টি” ও “এখনও” কবিতা দু’টিতে প্রতি লাইনের প্রথমে একই শব্দ প্রতিবার ব্যবহার করেছেন : এতে বোঝা যায় সনামধন্য আমাদের স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান-এর প্রভাব থেকে কবি নাজমুন নেসা পিয়ারি মুক্ত থাকতে পারেন নাই। কারণ তিনিই বাংলা সাহিত্য কাব্যে সর্বপ্রথম ওই ফর্মটি প্রণয়ন করেন।

গ্রন্থটি পাঠান্তে কবিতা কেমন হয়েছে, তাও পাঠক অনুধাবন করতে পারবেন।

বইটি সকল মানুষের পাঠযোগ্য, সংগ্রহে সংরক্ষণযোগ্য এবং প্রেমোপহার হিসেবে প্রদানযোগ্য।

বইটির নাম করণ হয়েছে প্রকৃতজ বিচিত্র নান্দনিক চিত্রকল্পময় খণ্ডচিত্র নিয়ে নির্মিত একটি কবিতা “প্রেম অপ্রেম” নামেঃ
# ঝরো ঝরো তুষারপাতে
বেলা বয়ে যায়
শুভ্র সতেজ নিখাঁদ তুষার
নীরব, নিঝুম
ঝরছে অবিরাম।

নয়কোলন, ভেডিং
কোয়েপেনিক, ডালেম
কুদাম আর বার্লিন-মিটে
সবাই যেন একই সেই
সাদা চাদর গায়ে
ঝিমিয়ে নিতে চায়।

// // //

ঝরুক তুষার
নামুক তুষার
ঝিমধরা এই শহরটাতে
সাধানিরা হড়কেপরুক
তুষার জমা
কঠিন বরফ
করুক ওদের
লণ্ডভণ্ড।
ঝরো ঝরো তুষার পাতে
প্রেম-অপ্রেম
সব একাকার
এক আকাশের নিচে।

বইটির নামকরণের সার্থকতা এ কবিতাটি পড়েই পাঠক ব্যক্ত করবেন।
তবে কবিতাগুলোর নামকরণ করা হয়েছে একাধিক শব্দ সমন্বয়ে। নামকরণের ব্যাপারে কবি কোনো শব্দ সংকোচন করেন নাই।

এছাড়াও কবি পৃথিবী খ্যাত “বার্লিন প্রাচীর” নিয়েও লিখেছেনঃ
# চাঁদ ঝুঁকে পড়ে আছে,
ভঙ্গুর বার্লিন প্রাচীরে।
যতদূর চোখ যায় ——-
—— —– —– —- —-
তোমার হাত
ভালোবাসায়, বেদনায়, উৎকণ্ঠায়।

এবং
আবেগময় কিছু শব্দ অহেতুক কবিতায় প্রয়োগ হয়েছে সে সম্পর্ক জানা থাকা আবশ্যক। যেমন —
# “তো” আবেগ প্রকাশ করতে যেয়ে আসল কথা বলতে
না পেরে তো তো তো করে অর্থাৎ তোতলামী থেকে
“তো” ধ্বনির উৎপত্তি।
# “গো” এটা পশ্চিম বঙ্গের একটি কথ্য আবেগী ধ্বনি যেমন-
হ্যাঁ গো, কেমন আছো গো, ইত্যাদি
# “রে” এটা প্রচলিত সঙ্গীত ধ্বনি, সা-রে-গা-মা এর ধ্বনি। যেমন- ও, পাখি রে—-, মাঝি বাইয়া যাও রে —-।
এ রকম আরও আছে।
তাই এসব অপ্রয়োজনীয় আবেগী ধ্বনি কবিতায় প্রয়োগ করা অবাঞ্চনীয়।

যৎসামান্য মুদ্রণ প্রমাদ আছে তবে ছাপাত্রুটি নাই।

বইটি উৎসর্গ করেছেনঃ মা মেহেরুন্নেসা করিম -এর প্রতি ।

৩ ফর্মার বই, সুন্দর আকর্ষণীয় চার রঙের প্রচ্ছদ। মজবুত বাঁধাই এবং প্রথম ফোল্ডারের কবির আগ্রীবা ছবি সহ আত্মকথন আছে । কবি তার আত্মকথনের শেষের দিকে লিখেছেন : “এখন আবার নতুন করে কাব্য লক্ষ্মী ভর করলো কলমে।” উল্লেখ করা যায় যে, বাক্যটি নির্ভুল নয়। কারণ লক্ষ্মী কখনো কলমে ভর করে না, সে ভর করে ধন সম্পদে। কলমে ভর করে দেবী সরস্বতী। তথ্যটি ভুল আছে।

৮০ গ্রাম কাগজ, ১/৮ সাইজ। মূল্য টাকা ৭৫.০০ মাত্র।

প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ২০১০

প্রকাশক: অঙ্কুর প্রকাশনী, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০
ফোনঃ ০১৭১১১০৬৯, ৯৫৬৪৭৯৯

প্রচ্ছদ : কাইয়ূম চৌধুরী।

স্বত্ব : নাজমুন নেসা পিয়ারি।

কবির কাব্যচর্চা আজীবন অব্যাহত থাকুক।
বইটির বহুল প্রচার ও সফল বিক্রয় কামনা করি।

শেয়ার করুন: