আবু সুফিয়ান খান

গ্রন্থালোচনা : কবিতার বই ‘জলের গহীনে জল’

গড়াই কালিগঙ্গা বাঁক বদলানো নদী বিধৌত নীল-সবুজে ঘেরা সরসিত বাউলা সমতল ভূমির উর্বর ফসলী প্রান্তরবাসী লেখক বিচিত্র বিষয় ও ভাব সম্বলিত অতিন্দ্রীয় স্পর্শকাতর ধীমাত্রিক গদ্য-পদ্য-ছড়া কবিতা বিনির্মাণের একনিষ্ঠ অতলান্ত কবি মনোয়ার হোসেন মণি, কবিতা রচনায় তিনি যুগোপযোগী ধারায় সাধনা করে আসছেন, তার লেখা কবিতা গুলো অন্তমিল কাব্য ও গদ্য রীতি-শৈলী ছন্দ চাল পর্ব বিন্যাস করে সুপরিপক্ক হাতে রচিত হয়েছে।

এবার অমর একুশে বই মেলায় প্রকাশিত “জলের গহীনে জল” বইটির কবিতাগুলো পড়লেই পাঠক শব্দ চয়নের অর্থবহ কলা কৌশল সম্পর্কে এবং মাধুর্যমণ্ডিত কাব্যিক কারুকাজ নিরূপনে অবগত ও পরিচিত হবেন।

সমাজের বৈচিত্র্যময় বিষয় ও প্রকৃতির মনস্তাত্ত্বিক ঘটনাবলী প্রণয়ন করে কবি তার গ্রন্থের প্রথম “নকশিকাঁথা জীবন” কবিতায় বলেছেন :—
# “জীবন আমার মায়ের বোনা
রঙিন নকশি কাঁথা,
ফুল-পাখি আর চন্দ্র-তারা,
সবুজ লতা, পাতা।
কোথাও নদী, বালিয়াড়ি
কোথাও জলের ধারা
মেঘের ভাঁজে চন্দ্র উঁকি
মুচকি হাসে তারা।
// // // // // //

এই তো জীবন প্রকৃতি যার
প্রচ্ছদপটে আঁকা,
আকাশ থাকে স্বচ্ছ আবার
কৃষ্ণ মেঘে ঢাকা।
এই কবিতায় কবির আত্মজন্মোপলব্ধি ও প্রকৃতির সমন্বয়ে নিজকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। এখানে কবিকে আত্মজন্ম সচেতন বলা যেতে পারে।

# ” আকস্মিক বজ্রাহতের মতো
আমার হৃদয়ের মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা
চৌচির হয়ে গেলো নিমেষে
তোমার মায়াবী- মোহনী ঠোঁটের
চমকিত উজ্জ্বল হাসির ঝিলিকে।

// // // // // //

নিমেষে আমার হৃদয়ের আকাশে
নবারুণ হাসে
তোমার প্রেমিক ঠোঁটের চমকিত হাসির
আকস্মিক বজ্রপাতে।”
(কবিতার নাম : অকস্মাৎ বজ্রপতন)
এখানে কবি অতীন্দ্রেয় প্রেমকে মহাজাগতিক প্রেমে নিয়ে বিরহ যন্ত্রণায় বিদগ্ধতার চিত্র রূপায়ন করে গদ্য রীতি কাব্যে কথ্যভাষায় সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন।

# ” আমি কবি আঁকি ছবি
মাতৃভাষার
সুখে দু’খে হাসি মুখে
আলো আশার।

// // // // // //

তাইতো কবি জ্বালায় রবি
সংগোপনে
গোলাপ ফোটায় চন্দ্র ওঠায়
মনের বনে।”
(কবিতার নাম : আমি কবি)
এখানে কবি রোমান্টিক দ্যোতনায় সীমন্তি মনকে উথাল চন্দ্র, সূর্য, পুষ্পের উপমায় তুলনা করে উত্তাল যৌবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন সাবলীল শব্দায়নে এবং কবিতাটি লঘু ত্রিপদী ছন্দে নির্মাণ করে ছন্দের যাদুকরী ব্যাঞ্জনাময় সৃষ্টির দক্ষতা দেখিয়েছেন। এই বইতে মোট ১৫টি অন্তমিলের কবিতা আছে এবং বাদবাকিগুলি গদ্য রীতিশৈলীতে অন্তমিলবিহীন সফল কবিতা।

# “জীবন যখন যন্ত্রণাতে ভরায় শুধু প্রাণ
সমাজ যখন বঞ্চনাতে মাতে
আপন যদি পরের খাতায় অবলীলাক্রমে
লেখায় তাদের নাম—
সুখের আশায় পড়ে যদি ছাই
হৃদয় কেটে তখন কি আর লিখতে পারা যায়
সুখের নামে সে শুকপাখিটার সুখের ইতিহাস?

// // // // // //

ভাবনাগুলো ইতস্ততঃ শুধুই সঞ্চারিত
হন্যে হয়ে খুঁজছে একটি মন
হিরন্ময়ী যে মন শুধু
স্নিগ্ধ সজীব করবে এ জীবন।”
(কবিতার নাম : হিরন্ময়ী মনের প্রত্যাশা)

কবি কাব্য রচনা শৈলী নির্মাণে কোনরূপ কার্পন্য করেন নাই, ঋদ্ধহস্তে উপমা, রূপক কাব্য উপাদান ব্যবহার করেছেন, শব্দ প্রয়োগও করেছেন যথাযথভাবে। তবে বাক্যর অনুগামীতায় কিছুটা অসংগতি পরিলক্ষিত হয় এবং কাব্যরীতি অনুযায়ী অপ্রয়োজনীয় বিরাম চিহ্ন ব্যবহার করেন নাই, যা বর্তমানে গদ্য কবিতায় মানায়।

সমালোচক আবু সুফিয়ান খান (বামে) ও কবি মনোয়ার হোসেন মণি

গদ্য কবিতার ধারাবাহিকতা ঠিক থাকলেও পর্ব বিন্যাসে যতি, ছেদ, চাল আরো মাত্রাবৃত্তিক হওয়া শুদ্ধ। কবি, তার লেখায় কোনো অনুকরণ প্রিয়তা দেখান নাই এবং বইয়ের সমস্ত কবিতার বিষয়, চিত্রকল্প ও ভাব নিরেট মৌলিক বলে প্রতিয়মান হয় এবং শব্দ চয়নেও চৌকষ কৌশলীর ছাপ রেখেছেন। নৃজ্ঞান ও নিঃসর্গ জ্ঞানেও কবি ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ড ওয়র্থ এবং বাঙালি চারণ কবি বিজয় সরকার, লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্ ও কবি গোলাম মোস্তফা -ওনাদের ভাব শিষ্য মনে হয়।

চমৎকার উপমা, অনুপ্রাস, উৎপ্রেক্ষা, রূপ-রূপক, ব্যঞ্জনাময় শব্দের বিন্যাস, কাব্যিক ছন্দ-পর্ব-রীতি-শৈলী ও সরল ঝংকারে সাবলীল বাক্য নির্মাণ, যাথোপযুক্ত উদাহরণসহ বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও উপাত্ত সম্বলিত এবং অজানা অনেক খুনসুটির অবতারণামূলক দেশাত্ববোধ ও দেশপ্রেম অন্তরালে প্রেম রসময় সহজপাঠ্য, প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা ৫৩ টি কবিতা এই বইতে স্থান পেয়েছে।
সব থেকে দীর্ঘ কবিতা “হিমুর যাদুর রাজ্য” ৫৬ লাইনের এবং সব চেয়ে ছোট কবিতা “সুপ্রভাতে” ১৫ লাইনের। তবে বইয়ের নামকরণ “জলের গহীনে জল” কবিতাটি ১২তম স্থানে সন্নিবেশিত হইয়েছে। নামকরণ কবিতাটি সাধারণতঃ বইয়ের প্রথমে বা শেষে থাকে, এখানে কবি তা করেন নাই। তাহলে এই কবিতাটির গুরুত্ব কী অপরিসীম নয়? পাঠকের মনে প্রশ্ন থেকে যায়। আচ্ছা
কবিতাটি পড়ে দেখি :
# আকাশের নীল চোখ গাঙুড়ের জলে
বেহুলার ভেলা খোঁজে পরন্ত বিকেলে
ঘুমের দুলুনী দোলে ফিকে মাঠ প্রন্তর ছায়ে
অসীম সমুদ্র, আকাশ বাঁধ ভাঙাঢেউয়ের ভাঁজে

// // // // // //

ভেলা আর মোচকের খোলা একাকার
গাঙুড়ের নীল জলে হাওয়া তোলপাড়
ভাসে নদ নীল, গঙ্গা, ভলগা, ঝিলাম
অশান্ত, প্রশান্ত এক সাগর অতল।

লেখকের মেধা ও মনন সুপরিচ্ছন্নভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। অন্তমিলের নাতিদীর্ঘ কবিতাগুলো সুন্দর ভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে, কবিতাগুলো সহজ পাঠ্য ও বোধে গ্রাহ্য । পড়ার জন্য আলাদা সময় করে নেয়া প্রয়োজন নাই।

গদ্য রীতির কবিতাগুলোও হোঁচট খাওয়ার মত নয়। তবে পুরোপুরি আধুনি নির্মাণ শৈলী কবিতার গায়ে বসাতে কবি চেষ্টা করেছেন বলে প্রতিয়মান হয় না এবং উত্তর আধুনিক করতে ব্যর্থ হয়েছেন, কারণ : ভরা নদীর অন্তঃসরণ উত্তর আধুনিক কবিতায় অনন্তগামী ইন্দ্রীয় গ্রাহ্য ভাব ও পরাবাস্তব বিষয় শব্দের গাঁথুনিতে থাকতে হয়, আমার কাছে তাও প্রতিপন্ন হয় নাই, এবং রীতি-শৈলীতে অব্যয় পদের ব্যবহার হয় না, যেমন ; এবং, যদি, তবে নতুবা, অথবা, মতো, জন্য, যেমন, তেমন বরং ইত্যাদি।কিন্তু কবি তার কবিতায় এগুলো প্রয়োগ করেছেন। কবি তার প্রচ্ছন্ন বীর্যবান যৌবনের স্ফূরণ কবিতার সরল রেখায় সমস্ত কবিতাকে এক কক্ষে না রেখে বিভিন্ন ভাব-ভাবনা, ছন্দ প্রকরণে ছড়িয়ে বিধৃত করেছেন। তবে কিছু শব্দ যেমন (অমায়, তোমায়, মোর, শুধাই, ওগো, ওহে, রে, যেন,তেন, মতো, যে, যা ) প্রভৃতি পুরনো শব্দ, যা এখন কবিতায় ব্যবহার অবাঞ্ছনীয়। বর্তমানে কবিকে শব্দ আধুনিক করে প্রয়োগ করার জন্য সজাগ থাকে হয়।

বইটির শেষ কবিতাটি “আমার কিছু ছিল”

# “আমার একটি ভালোবাসার গৃহ ছিল
সেই গৃহটায় কুসুম কুসুম সুখ ছিল
ভালোবাসার একটু আশার স্বপ্ন ছিল
স্বপ্নগুলো মাঝ গগনে হ্বলতে ছিল।

// // // // // //

অগ্নিগিরি জ্বলছে, বুকে অগ্নি জ্বালা
শুরু হলো দিবানিশি জ্বলার পালা
জ্বলছি এখন ধিকিধিকি দিবা-যামি
এই জ্বলাটাই এখন আমার অনেক দামি।”
এখানে কবি বিস্মৃত জীবনকে নিয়ে স্পষ্টভাবে তার সুশাসিত মত প্রকাশ করে বিদগ্ধ পাঠককে আপন করেছেন।

অন্যদিকে একই শব্দ বারবার যেমন : চন্দ্র, সূর্য, ক্লান্ত ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন, শব্দের প্রতিশব্দ বা অনুশব্দ ব্যবহার করে শব্দ প্রয়োগে বৈচিত্র আনতে পারতেন।

গ্রন্থটি পাঠান্তে কবিতা কেমমন হয়েছে, তাও পাঠক অনুধাবন করতে পারবেন। কবি লিখতে যেয়ে ইংরেজি শব্দের প্রভাব এড়াতে পেরেছেন। এটা তার বাংলা ভাষার প্রতি অগাত আনুগত্যতা বিনম্র শ্রদ্ধা প্রকাশই বোঝায়। এখানে কবি তার শব্দ প্রয়োগের বাড়তি দক্ষতা দেখিয়েছেন।

বইটি সকল মানুষের পাঠযোগ্য ও সংগ্রহে সংরক্ষণযোগ্য।

বানান বিভ্রান্তি এবং মুদ্রণ প্রমাদ পরিলক্ষিত হয়েছে তবে ছাপাত্রুটিও নাই। কবি গ্রন্থ শেষে ভুল বানানগুলোর একটি শুদ্ধ রূপের নির্ঘন্ট রাখতে পারতেন। কারণ ভুল বানান ভুল তথ্য উপাদ্য পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা সমুচিন নয়। বই নির্মাণের সময় মনে রাখতে হবে লেখক, কবি জাতির বিবেক, জাতির শিক্ষক। পাঠককে ভুল শেখানো যাবে না। স্বাধীন দেশের শুধু ভূ-খণ্ড স্বধীন হলে আর অবকাঠামোর উন্নয়ন হলেই দেশ উন্নত হয় না, দেশ উন্নত হয় তার উর্বর সাহিত্যে। আর সেই সাহিত্যের স্রষ্টা সনামধন্য লেখক, কবিগণ। তাই শুদ্ধ সুন্দর পরিমিত লেখা আবশ্যক।

বইটি উৎসর্গীত হয়েছে ; কবির স্নেহধন্য একমাত্র পৌত্র “মির্জা আলিফ শামস্-উল্লাহ্ কিশোর-কে।

৪ ফর্মার বই, সুন্দর আকর্ষণীয় গাঢ় নীল-নীলাভ উত্তাল দরিয়ার রঙের প্রচ্ছদ ও মজবুত বাঁধাই, প্রথম ফোল্ডারের ছাপা প্রসঙ্গ কথন ও প্রচ্ছদপত্র এবং শেষের ফোল্ডারে কবির আবক্ষ ছবি সহ আত্মকথন ও পুরস্কার প্রাপ্তির খতিয়ান । ৮০ গ্রাম কাগজ, ১/৮ সাইজ। মূল্য টাকা ১৪০.০০ মাত্র।

প্রকাশক: তৃণলতা প্রকাশ, ৪০/৪১ বাংলাবাজার(আহমদ কমপ্লেক্স ২য় তলা), ঢাকা-১১০০
মোবা : ০১৯২৬৬৫৭৫০৮; ০১৭১১৭৩০৯৩১

প্রকাশকাল : একুশে গ্রন্থমেলা- ২০১৮

প্রচ্ছদ : জাহাঙ্গীর আলম।

স্বত্ব : লেখক।

লেখকের প্রথম বই : “ছড়ার মেলা” ১৯৭৭ সালে বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত হয়।।
এর পর যথাক্রমে নিম্নোক্ত বইগুলো প্রকাশ করেন :
* প্রাথমিক বাংলা ব্যাকরণ ও বিরচন- ১৯৯৮
* রঙ বাহারী ছড়া- ২০০৮
* চোখের জলে নদী (গীতিকাব্য) -২০১০
* বাহাদুর বাঁশরীয়া (কিশোর উপন্যাস) -২০১২
* অন্যরকম ভালোবাসার গল্প (উপন্যাস) -২০১২
* বর্ণমালার ছন্দ ছড়া (শিশু পাঠ্য) -২০১৬
* চতুষ্পদাবলি ও স্বপ্নের কাব্য -২০১৭
* শত মঞ্জুরী কাব্যগ্রন্থ -৩, -২০১৬
* স্বপ্নিল হাতছানি (যৌথ কাব্য) -২০১৬
* বাংলা আমার জন্মভূমি(যৌথ)-২০১৭
* ফুল পাঁপড়ি (যৌথ ছড়াগ্রন্থ) -২০১৭।

উপরোক্ত বইগুলি প্রকাশ করে কবি প্রচুর সম্মানিত ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

এছাড়াও তিনি একজন বাংলাদেশ টেশিভিশনের তালিকাভূক্ত গীতিকার এবং বেতারে নাটক রচয়িতা।

কবির কাব্যচর্চা অব্যাহত থাকুক। বইটির বহুল প্রচার ও সফল বিক্রয় কামনা করি।

আবু সুফিয়ান খান : কবি, সমালোচক ও মুক্তিযোদ্ধা।

 

শেয়ার করুন: