গত ১০ সেপ্টম্বর (সোমবার) সকালে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে প্রথমেই যে টেক্সট ম্যাসেজটি পেলাম তা হলো ‘প্রিয় বাদশা ভাই আর আমাদের মাঝে নেই, অল্প কিছুক্ষণ আগে লন্ডনের সেন্টবাথ হসপিটালে ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউওন)’। খুব অল্প কথায় এ ম্যাসেজটি মিসবাহ উদ্দিন পাঠালেও এটা যেন বজ্রপাতের মত আচমকা আমার মাথায় আঘাত হানে। আমি দাঁড়ানো থাকলেও ম্যাসেজটি পড়ার পর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। সাথে সাথে চেয়ারে বসে পড়ি। এক অজানা আশঙ্কায় যেন আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অবচেতনের মত বার বার সে ম্যাসেজটি পড়তে থাকি। আর যতই পড়ি ততই মনের মধ্যে অনেক স্মৃতি ভেসে উঠতে থাকে। আমি তখন অনুভব করতে থাকি স্মৃতি যে কতটুকু বেদনাময় হতে পারে! আমার তখন মনে হয়েছে এ মৃত্যু সংবাদটির রিয়েকশন যেন আমার আপন ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদের চাইতে কোন অংশেই কম নয়।
মানুষ তাঁর ব্যবহারের মধ্যেমে অন্যের কাছে শুধু আপন হয়ে উঠে না, কোন সময় বন্ধু-বান্ধবদের কাছে আপন ভাইয়ের চাইতেও ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। আমার মনে হয় মদরিছ আলী বাদশা ছিলেন আমাদের কাছে সে রকমই এক আদর্শের প্রতীক। বাদশা ভাই, আমার চাইতে বয়সে অন্তত: দশ বছরের ছোট ছিলেন। কিন্তু তাকে আমি ‘বাদশা ভাই‘ বলে ডাকতাম যেভাবে তার অন্য দুই বড় ভাই তৈমুছ আলী ভাই ও হাছন আলী ভাইকে ডাকি। তিনি তাঁর ব্যবহারের মাধ্যমেই আমাকে এ সম্বোধন করতে বাধ্য করেছিলেন।
মদরিছ আলী বাদশা ছিলেন এক অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী মানুষ। একদিকে তিনি ছিলেন বন্ধুবৎসল অন্যদিকে সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন আপোষহীন। কোন অন্যায়-অবিচার দেখলে তিনি সাথে সাথেই এর প্রতিবাদ করতেন। তাঁর মধ্যে সবচাইতে বড় গুণ ছিল সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন ও অন্যের অসুবিধায় নিজের কাজ ফেলেও সহযোগিতায় এগিয়ে আসতেন। তবে এটা শুধু তাঁর মধ্যে ছিল যে তা নয়, তাঁদের অন্যান্য ভাইদের মধ্যেও সেটা বিদ্যমান রয়েছে।
মদরিছ আলী বাদশা ছিলেন – যুক্তরাজ্য যুবদলের সাবেক সভাপতি, বিশ্বনাথ স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি, বিশ্বনাথ এইড ইউকে এর লাইফ মেম্বার, বিশ্বনাথ ইউনিয়ন ট্রাস্টের ট্রাস্টি সহ অনেক সামাজিক সংগঠনের সদস্য। মূলত তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী। বিলেতের বাঙালী পাড়ার ‘মধুর কেন্টিন’ হিসাবে পরিচিত ‘আলাদিন’ রেষ্টুরেন্ট থেকে শুরু করে বৈশাখী রেস্টুরেন্ট ও বেথনালগ্রীনের একটি গ্রোসারী শপ পর্যায়ক্রমে পরিচালনা করেছেন। তবে এ সমস্ত ব্যবসার পাশাপাশি তিনি সমাজকর্ম ও কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমেও অংশ নিয়েছেন। বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডা প্রায় সময়ই তাঁর এ সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লেগেই থাকতো। শুধু বিলেতে নয়, দেশে গেলেও তিনি বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় সব সময় মেতে থাকতেন। বিভিন্ন সময় তিনি দেশে বিরাট ফুটবল খেলারও আয়োজন করেছেন। যুব সমাজ অপেক্ষায় থাকতো কখন তিনি দেশে যাবেন আর ফুটবল খেলা শুরু হবে। সেই যুব সমাজও আজ তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত হবে তাঁকে আর কোনদিন কাছে না পাওয়ার বেদনায়।
ব্যক্তিগত জীবনে মদরিছ আলী বাদশা ছিলেন তার ৫ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তৃতীয়। তিনি ৩ মেয়ে ও ২ ছেলের জনক। তাঁরা ইস্ট লন্ডনের ফরেস্ট গেইট এলাকায় থাকতেন। তাঁদের দেশের বাড়ী বিশ্বনাথ উপজেলার পার্শ্ববর্তী হরিকলস গ্রামে।
তিনি এবার তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে পবিত্র হজ্ব পালন করতে গিয়েছিলেন। গত ১১ আগস্ট হজ্বে যাওয়ার পর সেখানে হজ্ব পর্ব শেষে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সাথে সাথে তখন তাঁকে কিং ফাহাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় তাঁকে হসপিটালে নেয়া সহ দেশে আত্মীয়-স্বজনের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছিলেন একই সাথে হজ্বে যাওয়া বিশ্বনাথ প্রবাসী এডুকেশন ট্রাস্টের সেক্রেটারী মিসবাহ উদ্দিন। তাঁর মাধ্যমই অসুস্থতার খবরটি ছবিসহ ম্যাসেজ আমরা পাই। আমরা তখনই আশঙ্কা করছিলাম যে, তিনি কি সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসতে পারবেন। অবশেষে প্রায় ছয় দিন সেখানে থাকার পর কিছুটা সুস্থ হলে গত ৮ সেপ্টেম্বর শনিবার যুক্তরাজ্যে চলে আসেন। আমরা তখন কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। তবে এখানে আসার পর আবারো তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে হঠাৎ ১০ সেপ্টেম্বর সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি শেষ বিদায় নেন। তাঁর এ মৃত্যু আকস্মিক হলেও মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ করুণা লাভ করেছেন বলে সবাই মনে করছেন। কারণ পবিত্র হজ্বব্রত পালন করার সাথে সাথেই তিনি শেষ বিদায় নিয়েছেন। আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।
গত ১২ সেপ্টেম্বর বুধবার ইস্ট লন্ডন মসজিদে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান তারেক রহমান সহ বিপুল সংখ্যক লোকজন উপস্থিত হয়েছিলেন। আমি বিগত কয়েক বছরের মধ্যে তাঁর মত অন্য একজন মানুষের জানাজায় এমন উপস্থিতি আর লক্ষ্য করিনি। আমার মনে হয়েছে যে, তার পরিচিত মহলের অধিকাংশ লোকই যে যেভাবে সংবাদ পেয়েছেন সেভাবেই জানাজায় ছুটে এসেছেন। সবার মুখেই বলতে শুনেছি বাদশা ভাইয়ের প্রশংসার কথা। তাঁর বিভিন্ন স্মৃতির কথা। অনেকে এ সময় নিরবে চুখের অশ্রু ফেলেছেন তাঁর জন্য।
মহান আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুন ও আমাদেরকেও সেভাবে চলার ও মানুষের ভালবাসা অর্জনের তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক, ইস্টউড অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত কলামিস্ট ও সম্পাদক মাসিক দর্পণ।
info@dorpon.co.uk