একাদশ সংসদে এরশাদ বিরোধী নেতা, কাদের উপনেতা

জাতীয় সংসদে বিরোধী দলে থেকেও সরকারের অংশীদার হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়া জাতীয় পার্টি (জাপা) এবার তাদের ভূমিকা পাল্টাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়া দলটি একাদশ সংসদে ‘সত্যিকারের’ প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকবে। বিরোধী দলের নেতা হবেন পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং উপনেতা হচ্ছেন জাপার কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের। পার্টির কোনো সংসদ সদস্যই (এমপি) মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হবেন না। গতকাল শুক্রবার সর্বস্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক ও দেশবাসীর উদ্দেশে এ ঘোষণা দিয়েছেন এইচ এম এরশাদ। দলীয় প্যাডে ‘সকলের অবগতির জন্য’ শিরোনামে এরশাদের স্বাক্ষর করা ওই ঘোষণাপত্রটি পাঠানো হয়েছে গণমাধ্যমেও। এ ঘোষণার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে অনুরোধ করেছেন তিনি।

এইচ এম এরশাদের এই ঘোষণায় শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সন্তুষ্ট হলেও নাখোশ হয়েছেন দলটির নির্বাচিত এমপিরা। বিশেষ করে সরকারের সুবিধা পাওয়া জাপার মন্ত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন বেশি। এ ঘোষণায় তারা হতভম্ভ। কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা না করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয়নি। তবে গণমাধ্যমে স্পষ্ট করে কেউ কোনো কথা বলছেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এমপি জানান, পার্টিপ্রধানের ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন গত সংসদে মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া নেতারা। তারা কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করছেন না। এর মধ্যে মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা দাপ্তরিক কোনো কাজে অংশ নেননি। চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয়েও যাননি। অন্য মন্ত্রীরাও নীরব। সরকারের অংশ হিসেবে থাকতে উৎসাহী নেতারা শিগগিরই বৈঠক করবেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

২০১৪ সালে এরশাদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘বর্জন’ করার ঘোষণা দিলেও তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পার্টির একাংশ ভোটে অংশ নেয়। তাতে জাপা ৩৪ আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও মন্ত্রিসভায় যোগ দেন তিন নেতা। তাদের মধ্যে একজন পূর্ণমন্ত্রী ও দুজন প্রতিমন্ত্রীর পদ পান। গত সংসদে পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদায় ছিলেন পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। আর প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় ছিলেন মসিউর রহমান রাঙ্গা ও মজিবুল হক চুন্নু। এরশাদ নিজেও মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পান।

একই সঙ্গে বিরোধী দলে ও সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে জাপা। এসব সমালোচনা ও বিতর্ক সামাল দিতে সরকার গঠনের কয়েক মাস পর মন্ত্রিসভা ছাড়ার দাবি উঠে জাপায়। সে সময় এরশাদ ও রওশন এরশাদও তৃণমূলের ওই দাবির সঙ্গে একমত ছিলেন। তবে বেঁকে বসেন জাপার মন্ত্রীরা।

এরপর নানা সমালোচনার মধ্যেই কেটে যায় দুই বছর। ২০১৬ সালে পার্টির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়ে জি এম কাদের পার্টিকে সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে জনগণের আস্থা অর্জনের উদ্যোগ নেন। মন্ত্রিসভা থেকে জাপার মন্ত্রীদের বের করার পরিকল্পনা করেন তিনি। তবে সফল হতে পারেননি।

সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারিতে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ মন্ত্রীদের পদত্যাগে অনুমতি দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান। তবে শেষ পর্যন্ত জাপার কোনো মন্ত্রী পদত্যাগ করেননি। সূত্রমতে, গত ১ জানুয়ারি বনানী কার্যালয়ে পার্টির ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার নেতৃত্বে বৈঠক করেন শীর্ষ নেতারা। ওই বৈঠকে পার্টি সরকারের অংশ হবে, না বিরোধী দলে যাবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে ব্যর্থ হন তারা। পরদিন ২ জানুয়ারি প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নবনির্বাচিত এমপিদের যৌথসভাতেও একই বিষয়ে আলোচনা হয়। সে সভাও শেষ হয় সিদ্ধান্তহীনতার মধ্য দিয়ে।

এদিকে, গতকাল শুক্রবার হঠাৎ করেই এরশাদের স্বাক্ষর করা ‘সকলের অবগতির জন্য’ শিরোনামে একটা চিঠি গণমাধ্যমে আসে। তাতে এরশাদ উল্লেখ করেন, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মী-সমর্থক এবং দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আমি এই মর্মে জানাচ্ছি, একাদশ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধীদল হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। পদাধিকার বলে জাতীয় পার্টির পার্লামেন্টারি দলের সভাপতি হিসেবে আমি প্রধান বিরোধী দলের নেতা এবং পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। জাতীয় পার্টির কোনো সংসদ সদস্য মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হবেন না।’ এরপর স্পিকারের উদ্দেশ্যে করে বলেন, ‘সংসদের স্পিকারকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’

পার্টিপ্রধানের এ ঘোষণার পর সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বস্তি ও শীর্ষ নেতাদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা গেছে। তারা পার্টিকে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখতে চান। তাছাড়া পার্টিপ্রধান কয়েক দফায় তাদের পদত্যাগ করতে বললেও তারা তা করেননি। মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার দিকে ইঙ্গিত করে তারা বলেন, তার কারণেই কেউ পদত্যাগ করেননি। তার কারণেই পার্টির ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নবনির্বাচিত এমপি কাজী ফিরোজ রশিদ একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, সংসদে বিরোধীদল হিসেবে ভূমিকা পার্টির ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে। সত্যিকারের বিরোধী দল হতে পারলে দলের ভাবমূর্তি বাড়বে।
আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এরশাদের একান্ত সচিব মেজর (অব.) খালেদ আকতার মন্ত্রীদের সমালোচনা করেন বলেন, মন্ত্রীরা কী করেছেন এতদিন? তাদের দিয়ে পার্টির কোনো উপকারই হয়নি। তিনি মনে করেন, যারা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পেয়েছেন তারাই আবার সরকারের অংশ হিসেবে থাকতে চায়।

অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাপা নেতা মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, চেয়ারম্যানের ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে আমরা কেউ কিছু জানি না। কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

শেয়ার করুন: