সংক্ষিপ্ত কবি পরিচিতি:
এ কে এম আব্দুল্লাহ
জন্ম: ২৬ মার্চ
জন্মস্থান: বনগ্রাম। গোলাপগঞ্জ। সিলেট।
বর্তমান ঠিকানা: লন্ডন। ইউ কে।
প্রকাশিতগ্রন্থ:
কবিতা : সচেতনা, মাটির মাচায় দণ্ডিত প্রজাপতি, যে শহরে হারিয়ে ফেলেছি করোটি।
উপন্যাস: ক্ষুধা ও সৌন্দর্য।
সম্পাদনা: অণুগল্প সঙ্কলন ‘শব্দবিন্দু’।
পুরষ্কার:
গোল্ড মেডেল এওয়ার্ড। ড.শ্যাম সুন্দর মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। ভারত।
নবধারা সাহিত্য পুরষ্কার। সিলেট।
বোলপুর,শান্তিনিকেতন এর সৎসঙ্গ পাঠাগার কর্তৃক কবিতায়— সম্মাননা এওয়ার্ড।
এ কে এম আব্দুল্লাহ এর কয়েকটি কবিতা –
যে চোখ ধারণ করে সময়ের ওজন
রাতের পবিত্র ভাঁজ খুলে গেলে ধীরে ধীরে আমরা ঢুকে পড়ি যুদ্ধমাঠে। এ মাঠ এখন আলাদা কিছু নয়।এখন এখানেই আমাদের বসোবাস।যেখানে সেলফির অপ্রয়োজনীয় কিছু আনন্দের মতো এখানে সেখানে পড়ে থাকে কিছু খুচরা আয়াত।ভেঙ্গে যাওয়া কথার আত্মকাহিনী। আর প্রাক্তন খুলির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলে আদম হাওয়ার দীর্ঘশ্বাস ; চারপাশে জ্বলমল করে ওঠে আগুন।
সময়ের পথ ধরে পাহাড় থেকে নেমে আসে আদমের পদচিহ্ন। বাতাসের ব্যরিকেড ভেঙ্গে ওড়ে জীবনের আল্টিমেটাম। এই দৃশ্য দেখে কারও দক্ষিণ চোখ নড়ে ওঠে।আর জীবন্ত খুলির ভেতর অন্-মোড হয়ে যায়, সারি সারি সয়ংক্রিয় কথার সুইচ।কিছুক্ষণের মধ্যে মাঠে জ্বলে ওঠে আগুনের হুইসেল।
অত:পর আমরা নিরীহ প্রাণীর মত গোপনে— ঢুকে পড়ি আদম হাওয়ার ব্যাকুল চোখের ভেতর।
জলায়িত সুবাস
প্রিপারেশন নিতে-না-নিতেই ডুবে যাচ্ছে চোখ। আর নামহীন যে ঝড় বয়ে গেলো কাল। তার তান্ডবে ছিঁড়ে যাওয়া কারেন্টের তারে— যে গাভীটির মৃত্যু হলো,তার পাশ দিয়েই ভেসে যাচ্ছে সুবাসিত ফুল— হিযলের পাপড়ি।
এখন মৃত গাভী— ডুবে যাওয়া ক্ষেত— আর সুবাসিত হিযল— কম্বিনেশনটা ভাবতে ভাবতে মাথাটা ঘুরছে জলকুন্ডলীর ভিতর ; ছোট ডিঙির মত।
আর আকাশ থেকে টিনের চালে ঝরে পড়া বৃষ্টির ছন্দে— রবি ঠাকুরের বৃষ্টির গান নেমে এলে ঘরে ; অকস্মাৎ ঝড়ের ধাক্কায় ভেঙ্গে যাওয়া সুপারিগাছ— জানালার কাঁচ ভেঙে ঢুকে পড়ে বিছানায়। ঝড়ের ঝাপটায় আঙুল বেয়ে নেমে আসে রক্ত। ভেতরে ভেতরে শুনতে পাই কৃষকের— হাড় ভাঙচুরের শব্দ।
এভাবে আমরা বর্ষার চরিত্র ভেঙ্গে যখন ঢুকে পড়ি হেডলাইন-রং পোশাকের ভেতর ; ডুবে যাওয়া সড়কের পাশে— কেউ টাঙিয়ে দেয় বিজ্ঞাপনি ভঙ্গিতে।
আর কেউ গেঁথে রাখে কবিতার পাতায়।
একটি ব্যাক্তিগত ইমাজিনেশন
বাবার বুকে কোনো পকেট নেই। আমাদের কিচিনে রাইছকুকারেরও কোনো সিটি বাজে না ; চুড়িরও। ফায়ারপ্লেসে পুড়ে যাওয়া কাষ্টের মতো— মায়ের হাত।
এখন আমাদের জিহ্বার নিচ থেকে নেমে আসা তাপমাত্রা ; সমাজের প্যারালাইজড ছাদ ছিন্ন করে— আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। আর সভ্যতার বগলে রাখা থারমোমিটার ভেঙ্গে ভেসে যাচ্ছে জ্বলন্ত পারদ। এখন আমাদেরকে ঘিরে আছে রক্তাক্ত ব্রাশফায়ার।
মাঝেমধ্যে বিভিন্ন রঙের ফিতায় বড় বড় কার্ড ঝুলিয়ে সাংবাদিক আসেন। স্ট্যেথোস্কোপ দিয়ে চেক করেন আমাদের বুকের আওয়াজ। নোটবুকে কী যেন লিখে নেন ; আমাদের কোনোদিন জানা হয় না।
আসলে,আমাদের মুখে – কিংবা বুকে এখন আর কোনো শব্দ নেই। আমরা নিজেদের মুখ দেখিনি বহুকাল। আসলে আমাদের ঘরে কোনো আয়না নেই। আমরা ভুলে গেছি— বাঁচার ইমাজিনেশন।
অন্ধকার নগরীতে আত্মার উচ্চারণ
অতঃপর,সূর্যের বুক ফুটো হয়ে গেলে ; পৃথিবী লেপটে যায় ঘন অন্ধকারে।আর অন্ধকার গুহায় এখন— অন্ধপরিদের সঙ্গে আমার বাস।রাত গভীর হলে— দরজায় এসে দাঁড়ায় অদ্ভুত পাহারাদার।আমি তার হাতে তুলে দিই জীবনের সব সঞ্চয়।আর স্বজ্ঞানে সাজাই আঁধার— আনন্দ উৎসবে।অকস্মাৎ,আমার পাশে গড়িয়ে আসে পরিদের নিথর আরাধনা।কেঁপে ওঠে বুক।ভয়ে করি চিৎকার—
এ চিৎকার— কেউ শুনতে পায় না। ফিরে আসে আমার কাছে। জীর্ণ,শীর্ণ,ক্ষীণ হয়ে। আর আমি পালাতে থাকি ভেতরে ভেতরে— অন্ধকার গুহার দিকে …
কাগজের চোখ ও নীল পেরেক
মাঝে মাঝে কয়েক পঙক্তি ভালোবাসা— এটিএম থেকে ওঠে আসে আমার বুকপকেটে। আর তুমি জড়িয়ে রাখো আমাকে— তোমার বুকের উত্তাপমেশিনে।
যেখানে,দেওয়ালহিটারের উষ্ণতা বিলীন হয়ে যায়। আর আমাদের মুখ থেকে ঝরে পড়া লালায়— ওড়তে থাকে নতুন নোটের গন্ধ।
এরপর টেবিলের ওপর রাখা চেকবই থেকে ওঠে আসে লক্ষ লক্ষ মৌমাছি। আমাদের ঘিরে ধরে ফুলের মতো।আমারা লাল— হলুদ আর গোলাপি হতে থাকি।
এভাবে রাত শেষ হয়ে যায়। আর চামড়ার ভাঁজ করা পকেটকোষে পড়ে থাকে— মেয়াদ উত্তির্ণ কিছু পুরুকাগজের ফলক।
নামকরণ ও রিভিউ কপি
ট্যাকনিক্যালি— তোমাদের জীবানুযুক্ত মাফলার আমাদের গলায় জড়িয়ে-ই ছাড়ো ! আর,আমরা নেশাখোরের মত ঝিমুতে ঝিমুতে— তোমাদের কথা মতো জানোয়ার নিয়ে — মানসম্মত রচনা লিখি— আর নিজেকে জ্ঞানী ভাবতে থাকি।
কখনও নেশা কেটে গেলে— ‘জীবন’ নিয়ে মানসম্মত রচনা লিখতে বসলে ; রচনাগুলো গল্প হয়ে ওঠে। আর গল্পের প্রধান চরিত্রগুলো— হুবহু তোমাদের চরিত্রের সাথে মিলে যায়।
লেখা শেষ হলে, যখন রিভিশন দিতে বসি ; দেখি— ঐ গল্পের ভেতরও— আমাদের চরিত্রগুলো হুবহু বাস্তবতার মতো— বোকা মানুষের।
বাজেয়াপ্তজীবন ও মুদ্রিত স্ক্রিপ্ট
জিহবা নড়ে ওঠলে— জমিন রুপান্তরিত হতে থাকে চপিংবোর্ডে।সন্ধ্যা শেষে ফুলকপির মতো সেদ্ধ হতে থাকে মাথার কোষ— উনুনের জলে।তখন ইশারায় কিছু হাত উড়ে ফুলে ফুলে।অন্ধকার বাগানের গলি দিয়ে চোখ থেকে নেমে যায় ধারালো কিরিচ।
এরপর, পুকুরপারের নারকেল তলার শোক ভেঙ্গে— একদিন আমার মা-ও দাঁড়াবেন বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায়। কথাগুলো কেউ মাইকিং করে বলে গেলে— আমাদের ফটিকের পুরোনো দেওয়াল থেকে ছুটে আসে —
টিকটিকির আওয়াজ। ঠিক ঠিক…
অত:পর, শতাব্দীর সিলিং ভেঙ্গে— চাল ছাড়া হাঁড়ির সেদ্ধ ধোঁয়ায়— ঢেকে যায় মায়ের ব্যাকুল মুখ।
আর আমি সেই শব্দের খুঁজে— শ্লোগান ভেঙ্গে আজও দেওয়ালের পাশে কান পেতে বসে রই। হাতে নিয়ে জীবনের কঙ্কর।
ব্যরিকেড ভেঙ্গে নামে যে বীজ
খেতের গলি দিয়ে চলে গেলে সূর্যদানা—জমিনের শরীর ঘষে নেমে আসে সন্ধ্যা।পৃথিবীর তলপেট নড়ে ওঠে।আর আমরা ভুলে যাই কান্নার স্বাদ এবং পবিত্রতা ঘুমিয়ে গেলে মৃত বালিশে।তুমি আমার বুকে মাথা রেখে হও স্বপ্নীল।
এরপর,তোমার নাভির পাশে কান পাতি। শুনি— শিশুর নিরাপদ হাসির ধ্বনি।আমি পুর্বপুরুষের পথে জমা ধুলো সরিয়ে তোমার চোখের দিকে তাকাই।দেখি— পৃথিবীর গলি ঘুঁজি আলোকিত করে আসছে আমাদের সন্তান। আর কমলাপুর রেলস্টেশন ছেয়ে যাচ্ছে কালিজিরা ঘ্রাণ।
এখন প্রতিটি রুপালী রাতে টের পাই— নিজেদের ভেতর জ্বলে ওঠছে নিজস্ব আগুন।
একটি ঘোরগ্রস্থ সময়ের ফটোকপি
আজকাল মধ্যমাসেই পকেট থেকে নেমে যায় পথের গন্তব্য।আর মাছবাজার পানিতে ডুবে যায়। আমাদের কিচিনের ছাদ থেকে টিপ টিপ করে ঝরে পেরেশানি।আমাদের উনুনে পুড়ে লোক দেখানো সভ্যতার চামড়া। আর আমরা লোডশেডিং এর মতো,হাতে হাত ধরে ধরে সাঁতার কাটি রাতের জলে।
আমরা ডাইনিং টেবিলে ধারহীন নাইফ দিয়ে সার্প করে দিই বাচ্চাদের কাঠপেন্সিল ; ভিতর থেকে অঙ্কিত করলে হৃদয়ের স্ক্যাচ ; পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে কেউ উল্টো করে ধরে ক্যানভাস। আমাদের মাথায় ভুমিকম্প হয়। আর আমাদের মুখ দিয়ে বের হতে থাকে সময়ের ফটোকপি।
অতপর রাত গভীর হলে অনেকেই আমাদের ঘিরে ধরে। শকুনের মত ঠোঁটে ফিস ফিস করে আমাদের চরিত্র বিক্রির পরামর্শ দেয়। আর আমরা পুনরায় আত্মহত্যা করি।
সাদা কাপড়ে মোড়া নগ্ন পাঁজর
করোটি থেকে নেমে যাচ্ছে আলো। আর অন্ধকার তুলে রেখে চোখে ; সংসারের সিঁড়ি ভেঙ্গে, হেঁটে হেঁটে যায় বুকের পাটাতন।
এরপর,বাজারের ব্যাগ থেকে পড়ে গেলে বাবার পকেট ; মায়ের চোখে জ্বলে ওঠে উনুন। মধ্যাহ্নের শ্লোগানগুলো সেদ্ধ করে রাতের জীর্ণ হাত। পেটের ক্ষুধা তুলে রেখে কথার গোলায় ; আমরা হাকিয়ে যাই- ভোরের পঙ্খিরাজ।
আমাদের চোখে জল,বুকে জল,ঘরে জল। তবুও এই জল ছুঁতে পারেনা আমার পঙ্খিরাজের খুর।
চৈত্রের ফাটা জমিনে, শামুকের শুকনো খোলসের মতো আটকে যাচ্ছে আয়ুর নাও।আর মায়ার গুন টানতে টানতে ক্লান্ত দেহ। এখন নিশ্বাসগুলো ক্যেমেরা ফ্লাসে চমকায়, স্যেত- স্যেতে বৈঠা কাঠের মতো।
আর চোখের পুষ্টিহীন দৃষ্টিতে বৃদ্ধ সংসারগুলো, আজও ভোরের কুলা থেকে কুড়োয় সময়ের কঙ্কর।
কবির সাথে যোগাযোগ: abdullah.20@hotmail.co.uk
এবারের অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় পাওয়া যাবে কবি এ কে এম আব্দুল্লাহ’র নতুন কাব্য গ্রন্থ – ইমেইল বডিতে সময়ের অনুবাদ। অনার্য প্রকাশনী। স্টল নং ২০৮/২০৯/২১০ দাম ২০০ টাকা।