শাহনাজ সুলতানা

ব্যস্ত জীবনে আমাদের সবারই উচিত সময়কে মূল্যায়ন করা

একজন সাহিত্যকর্মী এবং কমিউনিটির ছোট খাটো কয়েকটি সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার সুবাধে মাঝে মধ্যে দু’একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পাই। যদিও সবগুলো অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগত কাজের চাপে যাওয়া সম্ভব হয় না তবে সময় সুযোগ হলে দু’চারটা প্রোগ্রামে যাই এবং আয়োজকদের বেঁধে দেয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উপস্থিত হই। তবে ইদানিং অনুষ্ঠানগুলোতে পৌঁছার পর যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি আহত করে পীড়া দেয়, সেটি হলো সময় মতো অনুষ্ঠান শুরু না করা।

গত কয়েকদিন পূর্বে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আয়োজকরা আমন্ত্রণ দেবার সময় বলেছিলেন বিকেল পাঁচটায় অনুষ্ঠান শুরু হবে, আপা ঠিক সময় মতো চলে আসবেন প্লিজ। টাইম মেইন্টেইনের ব্যাপারে আমি খুব যত্নশীল। নির্ধারিত সময়ের পাঁচ দশ মিনিট আগে সব জায়গায়-ই পৌঁছার অভ্যাস আমার দীর্ঘদিনের। সে অনুষ্ঠান হোক আত্বীয়-স্বজনের বাসায় অথবা বাইরে অন্য কোথাও। ঠিক সময়ের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার এক অদৃশ্য চাপ আমাকে তাড়া দেয়। এ নিয়ে মাঝে মধ্যে আমার আত্বীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবরা হাসাহাসি করে। তবে এতে আমার কিছু করার নেই।

এবার আসি মূল কথায়। সে দিনের অনুষ্ঠানে বিকেল পাঁচাটায় গিয়ে দেখলাম ওখানে মাত্র তিন চার জন লোক উপস্থিত আছেন। তাদের কথাবার্তা শুনে মনে হলো আয়োজকদের মধ্যে অনেকে-ই এখনো আসেননি। চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম এবং সুযোগমতো একজনকে জিজ্ঞসে করলাম, ভাই বললেন পাঁচাটায় আসতে এখন ঘড়ি সাড়ে পাঁচটা, কিন্তু অনুষ্ঠান এখনো শুরু করছেন না, করাণটা কি? উত্তরে ভদ্রলোক বললেন, বিকেল পাঁচটায় আসতে বলার কারণ আমাদের বাঙালীরা সময় মতো কেউই আসেন না। আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সবাইকে বলা হয়েছে বিকেল পাঁচটায় আসতে। তবে আমরা অনুষ্ঠানটি শুরু করব ছয়টা অথবা সাড়ে ছয়টার দিকে। আপনি সময়মতো এসেছেন আপা ধন্যবাদ, একটু চা খান।

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিলো বিকেল সাতটায়, প্রায় দুই ঘন্টা দেরীতে। যার ফলে আমাদের মতো অনেকে-ই বিপাকে পড়েন। কাজকর্ম ফেলে অতি কষ্টে সময় বের করে অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থিত হয়ে যখন দেখা যায় নির্ধারিত সময়ে শুরু না হয়ে ঘন্টা দেড়েক পরে শুরু হয় তখন অনেকেই বিরক্ত বোধ করেন এবং অ-স্বস্তিতে ভুগেন। আমাদের বাঙালী কমিউনিটির অধিকাংশ প্রোগ্রামগুলো রোববারে অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে অনেকেই থাকন কর্মজীবি এবং মহিলা, যাদের মধ্যে অনেকের-ই হয়তো নিজস্ব কোন ট্রান্সপোর্ট নেই। একটু বিনোদন, গুরুত্বপূর্ন কিছু কথা শোনা বা বলার জন্য যারা দূর-দূরান্ত থেকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে অনুষ্ঠানে আসেন, তাদের মধ্যে দেখা দেয় চরম হতাশা । বিশেষ করে নারীদের বেলায় সমস্যাটা হয় একটু বেশি। নানা ধরণের পারিবারিক সমস্যার পাশাপাশি টাইম মতো বাসায় ফেরা, বাচ্চা দেখাশোনা করার মতো বাড়ীতে লোকের অভাবসহ আরো অনেক কিছু। তবে যাদের আত্বীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আছেন তাদের কথা আলাদা । কিন্তু যারা আত্বীয়-স্বজনহীন, তারা অনেকেই পয়সা দিয়ে চাইল্ড মাইন্ডারের কাছে বাচ্চাদেরকে রেখে আসেন। এরমধ্যে যদি অনুষ্ঠান শুরু হতে ঘন্টা দেড়েক সময় কেটে যায় তা হলে এতো কষ্ট করে অনুষ্ঠানে এসে কোন লাভ হয় বলে মনে হয় না। আমাদের অধিকাংশ বাঙালী অনুষ্ঠানগুলোর এই একই চিত্র দেখা যায় সবখানে। তবে এ সব ক্ষেত্রে অন্যান্য কমিউনিটির চিত্রগুলো একটু ভিন্ন।

বিগত বছরগুলোতে অন্যান্য কমিউনিটির বেশ ক’টি অনুষ্ঠানে যাবার সৌভাগ্যে আমার হয়েছে। আয়োজকরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা তাদের অনুষ্ঠানগুলো শুরু এবং শেষ করেছেন। বিশেষ করে ইউরোপীয়ানদের বেলায় দেখেছি, তারা যদি কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আর সেখানে মাত্র পাঁজজন লোক উপস্থিত হয়, তারা দেরি না করে ঐ পাঁচজন লোক নিয়েই সময় মতো অনুষ্ঠান শুরু করেন। এতে আয়োজক এবং দর্শক দু’পক্ষের জন্য ভালো হয়।

প্রবাসের এই ব্যস্ত জীবনে আমাদের সবারই উচিত সময়কে মূল্যায়ন করা। কর্মজীবি দর্শকদের কথা চিন্তা করে অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজকরা আগামী অনুষ্ঠানগুলো যদি সময় মতো শুরু করেন তাহলে অনেকেই উপকৃত হবেন । বিশেষ করে নারীরা আরো বেশি অংশ গ্রহণের সুযোগ পাবে। হুট করে কোনকিছইু সম্ভব নয়, এরপরও সবাই মিলে যদি চেষ্ঠা চালিয়ে যাই অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এ জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব, কারণ পৃথিবীতে মানুষের অসাধ্য বলে কোনকিছু নেই।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী।

শেয়ার করুন: