কাইয়ূম আব্দুল্লাহ

মুহাম্মদ জুবায়ের: এক স্বজন-সতীর্থের সান্নিধ্য ও জন্মদিনের সারপ্রাইজ

মুহাম্মদ জুবায়ের। আমাদের সাংবাদিক-সাহিত্যিক বন্ধুমহলের অন্যতম প্রিয়জন। দেশ এবং বিলেতের বাংলা মিডিয়ায় এক সক্রিয় এবং যথার্থ অর্থেই সত্যনিষ্ট ও জনপ্রিয় সাংবাদিকের নাম। বর্তমানে চ্যানেল এস’র চীফ রিপোর্টার এবং লণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সদ্য সাবেক সেক্রেটারী। দেশে থাকতে প্রিন্ট মিডিয়ায় যেমন ফিচার-প্রতিবেদনে স্বাতন্ত্রিকভাবে ছিলেন সমুজ্জ্বল তেমনি বিলেতে আসার পরও প্রথমে প্রিন্ট মিডিয়া এবং পরবর্তীতে টিভি মিডিয়ায় স্টাইলিস্ট রিপোটিং কিংবা ডকুমেন্টারি নির্মাণেও আলাদা মুনশিয়ানার মাধ্যমে হয়েছেন সুখ্যাত। সবকিছুর পরও ভিলেজ ডাইজেস্টের সরেজমিন গ্রামীণ প্রতিবেদনগুলোকেই আমি মনে করি তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের এযাবতকালের অনন্য সৃজনকর্ম। সেই ভিলেজ ডাইজেস্টের হয়ে তাঁর সান্নিধ্য ও একসাথে পথচলার শুরু। বিলেতে এসেও আমাদের কর্মস্থান এক না হলেও ঠিকই আছে সহাবস্থান এবং অক্ষুন্ন রয়েছে সম্পর্কের সমান সৌধ।

আরেকটি বিষয়, জুবায়ের ভাইকে প্রায় সবাই শুধু সাংবাদিক হিসেবেই জানেন। এর বাইরে তিনি যে একজন রোমান্টিক গল্প লেখক এবং শৈল্পিক আঁকিবুকিও করতে পারেন, কখনো কখনো কবিতাও লিখেছেন— তা অনেকেরই অজানা। অনেক বই ও ম্যাগাজিনে তাঁর হাতের অঙ্কণ রয়েছে। বিশেষ করে আমার বিয়ের স্মারকের প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও অঙ্কণ (দীর্ঘ সম্পাদকীয়তো ছিলোই) এবং “আট লাইনে ভালোবাসা” শিরোনামে কবিতার একটি পকেট সাইজ ক্যালেণ্ডার স্মারকের প্রচ্ছদসহ পাতায় পাতায় তাঁর শৈল্পিক আঁকাজোকা রয়েছে, যেখানে কবি দিলওয়ারসহ অনেক খ্যাতনামাদের কবিতা স্থান পেয়েছিলো। এই স্মারকগুলি আমি এখনো অবসরে খুলে দেখি ও আন্দোলিত হই। জুবায়ের ভাইর অনেকগুলো গল্প সিলেট ও ঢাকার কাগজে ছাপা হয়েছে। রোমান্টিক গল্প লেখক বলার কারণ হলো— একদা রিকশায় যেতে যেতে জুবায়ের ভাইর জীবনে ঘটে যাওয়া সেই স্মরণীয় রোমান্টিক ঘটনাটিই আমাকে বলেছিলেন। আর তা হলো— তাঁর এক গল্পের পাঠক তরুণী ফুল নিয়ে এসেছিলেন তাঁরই কর্মস্থল সিলেটের ডাক অফিসে। সেখানে তাকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ফুল তাঁর টেবিলেই রেখে যেতে হয় সেই তরুণীকে। জীবন বাস্তবতা ও ব্যস্ততায় হয়তো জুবায়ের ভাইও এখন তা ভুলে গেছেন! সার্বক্ষণিক সাংবাদিকতার কাছে চাপা পড়ে গেছে তাঁর অন্যান্য অনন্য সৃজনশীলতাও।

সম্প্রতি জুবায়ের ভাইর জন্মদিন পালিত হয়েছে। এই পালিত বলতে স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে জানাজানি হওয়ার মাধ্যমে তিনি অসংখ্য বন্ধবান্ধব ও শুভাকাঙক্ষীর জন্মদিনের শুভেচ্ছা-শুভাশীষে ধন্য হয়েছেন। বাকী ছিলো শুধু কোনো সারপ্রাইজ পার্টির। সেটিও হয়েছে, কিন্তু যেভাবে ঘটা করে করার কথা তা সেভাবে ছিলো না। ছিলো শুধু আমাদের ৪/৫ জনের তাঁর সান্নিধ্যে কাটানো কিংবা মনখুলে কিছু সময়ের অন্তরঙ্গ আড্ডা। আর তাই আমাদের আরেক প্রিয়বন্ধুর রেস্টুরেন্টকেই আমরা বেছে নিলাম। রেস্টুরেন্টটির সত্ত্বাধিকারী আমাদের ওই কবি-সাংবাদিক বন্ধুটিও অনেকদিন থেকেই চাচ্ছিলেন জুবায়ের ভাইসহ আমাদের অন্যান্য বন্ধুদের সান্নিধ্য। আসলেই তা ছিলো স্রেফ আড্ডা, মধ্যখানে শুধু একটি কেক কাটা এবং ফুলেল শুভেচ্ছার আয়োজন। খুব ঘটা করে কোনো আয়োজন না হলেও সেই মুহূর্তটি ছিলো অন্তরঙ্গ ও আনন্দের। আসলে বড় করে করতে গেলে সেটি বিশালতায় রূপ নেবে এবং জুবায়ের ভাইর অসংখ্য বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষীর কাকে রেখে কাকে বলবো, শেষ পর্যন্ত কিনা সারপ্রাইজটাই ভেস্তে যায়— সেই আশঙ্কায় সবাইকে সম্পৃক্ত করা যায়নি বলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

সচরাচর পূর্ব লণ্ডনের বাংলা পাড়ায়ই কোনো মিটিংয়ের পর যেকোনো ছুতোয় আমরা বসে যাই, জমে যায় আড্ডা। এই আড্ডা অনেকটা দূরে, ওয়েস্ট লণ্ডনে। সেখানে থাকেন আমাদের কবিবন্ধু ও সাংবাদিক মুহাম্মদ শরীফুজ্জামান। অনেকের কাছে দূরে মনে হলেও সম্পর্ক এবং প্রায়শ যাতায়াতের ফলে আমার কাছে কিছুতেই দূর মনে হয় না। সন্ধ্যায় যাবার কথা থাকলেও যেতে যেতে আমরা গেলাম সেই মধ্যরাতে। আমরা বলতে— তাইসির ভাই (তাইসির মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক লণ্ডবাংলা প্রেসক্লাব ও সম্পাদক সাপ্তাহিক দেশ), মতিউর ভাই (মতিউর রহমান চৌধুরী, সাপ্তাহিক পত্রিকার বিশেষ করসপনডেণ্ড ও সাবেক সহ সাধারণ সম্পাদক লণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাব, ক্যারল ভাই (আব্দুল মুনিম জাহেদী ক্যারল, সাংবাদিক ও সমাজসেবী)। কথা ছিলো জুবায়ের ভাইকে সাথে নিয়েই সাড়ে ৮টায় আমরা রওয়ানা হবো। কিন্তু সদ্য পুনর্বার নির্বাচিত মেয়র লুৎফুর রহমানের সাথে কিছু জরুরী মিটিং থাকায় সাড়ে ৮টা ছাড়িয়ে দশটায়ও জুবায়ের ভাই ফ্রি হতে পারলেন না। তিনি পরে আসছেন বলে আমাদের ছেড়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু আমরা তা মাননাল না। আমাদের সাথে করে নিয়ে যেতে তাঁর কাছে গিয়েই হাজির হলাম। আমাদের দেখে লুৎফুর ভাই একে একে সবার সাথে হাত মেলালেন ও কুশল বিনিময় করলেন, সচরাচর তিনি সবার সাথে দেখা হলেই যা করে থাকেন এবং এটি তাঁর একটি অনন্য গুণ। আমরা জুবায়ের ভাইর কথা বলতেই বললেন, “আরেকটু কাজ বাকী আছে, আপনারা যাউক্কা আমি নিয়া আইরাম”। আমরা মনে মনে ভাবলাম, কাছাকাছি হলেতো ঠিক ছিলো, কিন্তু এতদূর এটা কি সম্ভব? আমরা রাত ১১টায় গিয়ে পৌঁছলাম প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নির্বাচনী এলাকা আক্সব্রিজের জাবিত্রি রেস্টুরেন্টে। তবে জুবায়ের ভাই গেলেন মধ্যরাতেরও পরে। সাথে সত্যি সত্যি মেয়র লুৎফুর ভাইকে দেখে সবাই অবাক। সাথে ছিলেন কাউন্সিলার ও কেবিনেট মেম্বার সুলুক আহমদ। আসলে লুৎফুর ভাই ভেবেছিলেন রেডব্রিজ, বার্কিং সাইটে হবে। দূর হলেও কথা যেহেতু দিয়েছিলেন আসবেন তাই না এসে পারেননি। মেয়রকে দেখে শরীফ ভাই অবাক, একই সাথে দারুণ খুশী এবং ফুল দিয়ে তাকে শুভেচ্ছাও জানালেন। পারস্পরিক কুশলবিনিময়ের এক পর্যায়ে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্কও উদঘাটিত হয়ে গেলো। সম্পর্ক ভাই থেকে গিয়ে দাঁড়ালো মামা সম্বোধনে। শরীফ ভাইকে লুৎফুর ভাই তখন থেকে মামা ডাকা শুরু করলেন। তারও অনেক পরে গেলেন এমাদ ভাই (এমদাদুল হক চৌধুরী, সভাপতি লণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাব ও সম্পাদক সাপ্তাহিক পত্রিকা)। সোমবার সাধারণত আরলি অর্থাৎ দশটার পরেই রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শুধু আমাদের শরীফ ভাই কয়েকজন স্টাফকে রেখে দিলেন এবং আমাদের খাবার পরিবেশন শেষ হলে পরে তাদেরকে ট্যাক্সি ডেকে দিলেন।

সেই পরিচিত নিশিভোর এবং কিছু স্মৃতি:

বেশীরভাগ সাংবাদিক-সাহিত্যিক তথা লেখকরাই নিশাচর প্রকৃতির হয়ে থাকেন। জুবায়ের ভাইও সেই দলেরই একজন। তবে আমার মনে হয়েছে, তিনি আরেকধাপ এগিয়ে। কাজের প্রাধান্য দিয়ে তখনও যেমন রাতজাগার অভ্যাস ছিলো এখনো তেমন। সেই মধ্য নব্বই দশক থেকে একসাথে চলার সুবাদে তার অনেককিছুই আমার জানা। ভিলেজ ডাইজেস্ট সূত্রে আমাদের আমাদের পারস্পরিক সান্নিধ্যে আসা ও ঘনিষ্টতা। ভিলেজ ডাইজেস্টের শেষ পর্যায়ের চূড়ান্ত কাজগুলো করতে করতে অনেকদিন রাত ভোর হয়ে যেতো ক্রিয়েটিভ কম্পিউটারে। জুবায়ের ভাই শুধু ডাইজেস্টের প্রধান থীম গ্রামীন প্রচ্ছদ প্রতিবেদনগুলোই করতেন না গ্রাফিক্স থেকে শুরু করে ডিজাইন সংক্রান্ত বেশীরভাগ বিষয়ে তিনিই নির্দেশনা দিতেন। টুকটাক কিছু ছাড়া আমি মূলত তাকে সঙ্গই দিতাম। বেশী রাত হওয়ার কারণে অনেকদিন তাদের বাসায় থেকেছিও। মাঝে মাঝে সময় বাঁচাতে বাসায়ও না যেয়ে কাছের কোনো হোটেলে থাকারও চেষ্টা করতাম। একদিন রাতে স্রেফ মজা করে হোটেল খুঁজতে বেরুলাম। শেষ রাতে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম প্রায় সব হোটেলই ভর্তি, বন্ধ অনেকটির সদর দরজাও। বন্দর বাজারে একটি হোটেলে দরজা খোলা দেখে আমরা ঢুকে যা দেখলাম, তাতে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! কোনো রুমেই দরজা নেই, মুরগের ফার্মের মতো তাকে তাকে বিছানা পাতা আর বালিশের পাশে সবার জুতা রাখা। এই চিত্র দেখে আমরা দ্রুতই বেরিয়ে পরলাম। আর গ্রামগুলোতে ঘুরতে যেয়ে কতো যে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম সেটি না হয় অন্যত্র বলবো। তবু সংক্ষেপে যেটি বলে রাখতে চাই— সেই ৯০ এর দশকেই দুই থেকে আড়াইশ’ পৃষ্ঠার ভিলেজ ডাইজেস্ট প্রতিটি সংখ্যায় ছাপা বাবদ খরচ হতো লক্ষাধিক টাকা। একুশে টিভির তৎকালীন চেয়ারম্যান আবু সাঈদ মাহমুদ ডাইজেস্টের প্রতিটি সংখ্যা আগ্রহভরে সংগ্রহে রাখতেন। এমন কি ভিলেজ ডাইজেস্টকে অনুসরণে একুশে টিভিতে গ্রামীণ অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছিলেন বলেও তারা স্বীকার করেছেন।

অন্য অনেক দিনের মতো আজও যে নিশি ভোর হবে, তা শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো। জুবায়ের ভাইর পৌঁছতে দেরি হতে দেখে একথা-সেকথায় আমরা সময় কাটাতে থাকলাম। সেখানে আমরা পেয়ে গিয়েছিলাম আরেক সঙ্গীতশিল্পীকে। শিল্পী নূরে মান্নানের সাথে তাইসির ভাই তাঁর সাম্প্রতিক রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত সাধনার বিষয়টি বলতে বলতে কিছু গানের কলিও গেয়ে শোনানোর চেষ্টা করলেন। নূরে মান্নানও মৃদুসুরে কয়েকটি গাইলেন এবং ইউটিউবে তাঁর প্রচুর গান যে রয়েছে সেটিও দেখালেন। এরই মধ্যে জুবায়ের ভাই পৌঁছলেন ঠিকই, কিন্তু তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১টা ছুঁই ছুঁই। আর দেরি না করে শরীফুজ্জামান ভাইও আমাদের খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। পোলাওয়ের সাথে বিশাল মুরগের রোস্ট, পাখির মাংস ও চপ ভুনা, টমেটোসহ কয়েকটি মাছের তরকারি শেষে ডিজার্টসহ খাবারের এক এলাহিকাণ্ড উপস্থাপন করলেন শরীফ ভাই। আমাদের খাওয়া-দাওয়ার পর গিয়ে পৌঁছলেন এমাদ ভাই। আমাদের সাথে আলাপ করতে করতে তিনিও খাবার পর্ব সারলেন। খাবারের পর জন্মদিনের সারপ্রাইজ হিসেবে নিয়ে আসা হলো কেক ও ফুলের তোড়া। তবে আড্ডা ও খাওয়া-দাওয়ার পর্ব ভালোই উপভোগ করছিলেন জুবায়ের ভাই। কিন্তু যখনই কেক ও ফুলের তোড়া দেখলেন তখন বিস্মিত হওয়ার পাশাপাশি কিছুটা যে বিব্রত হয়েছেন সেটা বোঝা গেলো, কারণ পুরোটাই হয়েছিলো তাঁর অজান্তে। ফটোসেশন করতে করতে ফজরের সময় হয়ে এলো। ফজরের নামাজ শেষে আরেক দফা চা পর্ব সেরে ভোরের আবছা আলোয় আমরা ফিরলাম স্ব-স্ব নীড়ে। তাইসির ভাইর রবীন্দ্র ও নজরুল গীতি সাধনার কসরত দেখে আমি ফেরার পথে ইউটিউবে আমার পছন্দের একটি নজরুল সঙ্গীত ছেড়ে দিলাম, যা কখনো আমি কাউকে গাইতে শুনিনি। অনুপ ঘোষালের অসাধারণ সুরে গাওয়া সেই গান, যা আমাদের ওই রাতের আড্ডা এবং বেশীরভাগ যাপিত সময়ের সাথে প্রতিধ্বনিত হয়— “নিশি ভোরের বেলা/ কাহার পাহাড়ি বাঁশি, বাজে …”

লেখক: কবি, বার্তা সম্পাদক – সাপ্তাহিক সুরমা, লণ্ডন।

শেয়ার করুন: