আব্দুর রশীদ লুলু

চাষাবাদ বিষয়ক টুকিটাকি – ২১

 ভিটামিন সি সমৃদ্ধ বাতাবী লেবু দেশের কৃষিক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনাময় ফল। সাধারণত: সব ধরণের মাটিতে এর চাষাবাদ সম্ভব হলেও পলি ও বেলে দোঁ-আঁশ মাটিতে এর চাষাবাদ লাভজনক। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেন, মধ্যম অম্লীয় মাটিতে এর ফলন ভালো হয়। বিভিন্ন ভাবে বাতাবী লেচুর চাষাবাদ/বংশ বিস্তার সম্ভব। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বীজ থেকে চারা তৈরী করা হয়। এ ক্ষেত্রে পুষ্ট অথচ বেশি পাকা নয় এমন উন্নত জাতের ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। সূর্য্যতাপে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই রোদে শুকিয়ে বীজ সংরক্ষণ করা যাবে না। তবে স্বল্প সময়ের জন্য বীজ সংরক্ষণ করতে চাইলে বীজ ছায়াতে শুকিয়ে নেয়া যেতে পারে। মোটকথা বীজ থেকে চারা উৎপাদন করতে হলে, ফল থেকে বীজ বের করার পরপরই বীজতলা/নির্দিষ্ট স্থানে বপন করতে হবে।
গ্রীষ্মকালে গুটি কলমের মাধ্যমে সহজেই বাতাবী লেবুর বংশ বিস্তার করা যায়। এ ক্ষেত্রে উন্নত জাতের মাতৃগাছ নির্বাচন করতে হবে। যাতে পরবর্তীতে ভালো ফলন পাওয়া যায়। উপযুক্ত পরিচর্যায় কলমের গাছ থেকে পরবর্তী মৌসুমে ফলন পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া বীজের গাছে উপযুক্ত পরিচর্যায় ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে ফলন পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, বাতাবী লেবু গাছে ফুল আসা থেকে ফল খাওয়ার উপযোগি হতে প্রায় নয় মাস সময় লাগে।

 আনারস চাষাবাদের জন্য প্রচুর সূর্য্যালোক প্রয়োজন। কম সূর্য্যালোকে আনারস বিলম্বে ফল দেয় এবং কম ফল দেয়। আনারসের জন্য বৃষ্টিপাতও একটি লক্ষণীয় বিষয়। সাধারণত: যেসব এলাকায় বছরে ২০০০-২৫০০ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে আনারসের ফলন ভালো হয়। এ ছাড়া, আনারস চাষাবাদের জন্য পানি সুনিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ সামান্য অম্লীয় বেলে দোঁ-আঁশ মাটি অত্যন্ত উপযোগি।

 বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় দেশেরই জনপ্রিয় সবজি আলু। এটি আবার প্রায় চল্লিশটি দেশের প্রধান খাদ্য। আলুর উৎপাদন বেশি হলে আমাদের দেশেও প্রায়ই বলা হয়, বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান। অনেকেই আলুকে ভাতের পরিপূরক হিসেবে অভিহিত করেন। যতেœ ও উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে হেক্টর প্রতি আলু ৩০-৪০ টন উৎপাদন সম্ভব। আমাদের দেশের উন্নত জাতের আলুর মধ্যে আছে, বারি আলু-১, ৪, ৭, ৮, ১১, ১২, ১৩ ও ১৫। এর চাষাবাদের জন্য ভালোভাবে আড়াআড়ি ৩/৪ চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে/মিহি করে নিতে হয়। আলু লাগানোর পর অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরিচর্যার সাথে সাথে মাস খানেক পর সারি বরাবর অবশ্যই মাটি তুলে দিতে হয়।

 মাটির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং কৃষিকে লাভজনক করতে ইদানিং জমির আইলে অন্যান্য সবজি চাষাবাদের পাশাপাশি শিম চাষও জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। যে জমির আইলে পানি জমে থাকে না এবং পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পায় এমন আইলে সহজেই শিম চাষাবাদ করা যায়। এতে ধান ফসলের উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতি হয় না। বরং শিমের লতাপাতা জমিতে পড়ে পচে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে ধান গাছে যেন শিমের পাতা স্তপীকৃত হয়ে আটকে না থাকে। নিয়মিত ক্ষেত-খামার পরিদর্শনের মাধ্যমে ধান গাছে আটকে থাকা পাতা জমিতে ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। উল্লেখ্য, নিয়মিত পরিদর্শন প্রত্যেক চাষাবাদে সফলতার অন্যতম উপায়। যা হোক, শিম গাছে বাউনী খুবই প্রয়োজনীয়। এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হবে বাউনী প্রধান ফসল অর্থাৎ ধান গাছের যেন ক্ষতির কারণ না হয়।

 প্রচুর পুষ্টি ও বহু ভেষজ গুণ সম্পন্ন সহজপ্রাচ্য সবজি পটল প্রায় সর্বত্র চাষাবাদ সম্ভব। এটি জমিতে মুক্তভাবে এবং মাচায় সহজেই চাষ করা যায়। পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত জমিতে ভালো ফলনের জন্য আশ্বিন থেকে কার্তিকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পটলের লতা লাগানো যায়। এ ক্ষেত্রে ভালো ফলন দিচ্ছে এমন বছর খানেকের গাছ থেকে লতা সংগ্রহ করতে হবে। উল্লেখ্য, লতা ছাড়াও বীজ ও শিকড়ের টুকরো লাগিয়ে পটলের চাষাবাদ সম্ভব। লতা লাগালে তাড়াতাড়ি ফলন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে পটল গাছের স্ত্রীফুল ও পুরুষ ফুল যেহেতু আলাদা আলাদা গাছে থাকে, যেহেতু পরাগায়ণের সুবিধার জন্য অন্য কথায় ভালো ফলন পাওয়ার জন্য প্রতি দশটি স্ত্রী গাছের জন্য একটি পুরুষ গাছ রাখতে হবে। সে অনুযায়ী লতা সংগ্রহ করতে হবে এবং লাগানোর সময় এদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

 দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সবজি মুখীকচু চাষাবাদের জন্য দো-আঁশ মাটি উত্তম। এটা রোপণের উপযুক্ত সময় ফাল্গুন মাস। ক্ষেত্র বিশেষ বৈশাখ মাস পর্যন্ত বীজ লাগানো যেতে পারে। মুখীর ছড়া বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি আদর্শ বীজের ওজন ১৫-২০ গ্রাম হওয়া উচিৎ। মুখীকচু সারি করে রোপণ করতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭৫ সে.মি. এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ৪৫ সে.মি। তবে মাটির উর্বরতা কম হলে এই দূরত্ব কিছুটা কমিয়ে দেয়া যেতে পারে।
মুখীকচুর সারি বরাবর মাটি তুলে দেয়া একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। বীজ থেকে চারা গজাবার ৪০-৪৫ দিন পর প্রথম বার এবং ৯০-১০০ দিন পর দ্বিতীয় বার মাটি তুলে আইলের মতো করে দিতে হয়। আইলের মাটি দু’পাশে বেশি পরিমাণে ধ্বসে পড়লে তৃতীয় বারও আইল করে দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সেই সাথে অবশ্যই আগাছা তুলে ফেলতে হবে। উল্লেখ্য গাছ যখন হলুদ হয়ে আস্তে আস্তে শুকিয়ে যেতে থাকে তখন মুখী সংগ্রহ/বাজারজাতকরণের উপযুক্ত সময়। বীজ লাগানো থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত সাধারণত: ৬-৭ মাস সময় লাগে।

 দেশের আবহাওয়া ও পরিবেশ মিষ্টি কুমড়া চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগি। দেশে বিভিন্ন জাতের মিষ্টি কুমড়া চাষাবাদ করা হয়। মাটি কুপিয়ে/লাঙ্গল দিয়ে ঝুরঝরে করে কুমড়ার বীজ রোপণ করতে হয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য মাটি মই দিয়ে সমান করে নিতে হয়। পারিবারিক চাহিদার জন্য সীমিত পরিসরে চাষাবাদে মাটি হাত দিয়ে সমান করে নেয়া যেতে পারে। যথাযথ পরিচর্যায় বীজ রোপণের ১০০-১১০ দিনের মধ্যে মিষ্টি কুমড়া সাধারণত: পাকতে শুরু করে। সংরক্ষণ ও ধীরে সুস্থে বাজারজাত করণের জন্য কুমড়া পাকলে ক্ষেত থেকে তুলতে হয়। তবে কাঁচা/অপরিপক্ক কুমড়ার চাহিদাও বাজারে প্রচুর। উল্লেখ্য, অপরিপক্ক মিষ্টি কুমড়া বাজারের/পারিবারিক চাহিদা অনুযায়ী তুলতে হয়। কারণ এ ধরণের কুমড়া সাধারণত: সংরক্ষণ করা/ঘরে রেখে পরবর্তীতে খাওয়া সম্ভব হয় না। কেননা এগুলো অপরিপক্ক থাকায় সহজেই পচে নষ্ট হয়ে যায়।

লেখক: সম্পাদক – আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী অনিয়মিত প্রকাশনা)।

শেয়ার করুন: