আব্দুর রশীদ লুলু

চাষাবাদ বিষয়ক টুকিটাকি – ২৯

* সময়ের প্রেক্ষিতে চাষাবাদে আলোচিত একটি বিষয় হলো জৈব/কম্পোস্ট সার। এটা তৈরীতে কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। এ জন্য প্রথমেই দরকার একটি গর্তের। সংশি¬ষ্টরা বলেন এ জন্য চার হাত লম্বা, চার হাত চওড়া এবং দুই হাত গভীর গর্ত ভালো। তবে অবস্থার প্রেক্ষিতে এর আকার আকৃতি কিছুটা কম/বেশি হতে পারে। গর্তের ওপর চালা তৈরী করা উচিৎ। অন্যথায় ছায়াযুক্ত স্থানে গর্ত করা যেতে পারে। গর্তের ভেতরে গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, খড়, ঘাস, লতা-পাতা, ঘর-গেরস্থালীর উচ্ছিষ্ট, কুচুরিপানা ইত্যাদি ফেলতে হবে। তবে অপচনশীল কিছু যেমন- পলিথিন, কাঁচের বা প্লাষ্টিকের টুকরো ইত্যাদি গর্তে ফেলা যাবে না। গর্ত ভরে গেলে এর মুখ/উপরি অংশ মাটি দিয়ে হাল্কাভাবে লেপে/ঢেকে দিতে হবে। ২/৩ মাস পর গর্তের আবর্জনা পচে ধূসর কালো রঙ ধারণ করলে তা জৈব/কম্পোস্ট সার হিসেবে চাষাবাদে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

* দেশে সাধারণত শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজি চাষাবাদ করা হয়। শীতকালীন শাক-সবজি চাষাবাদের উপযুক্ত সময় আশ্বিন-কার্তিক মাস এবং গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজি চাষাবাদের উপযুক্ত সময় ফাল্গুন-আশ্বিন মাস পর্যন্ত। তবে আগাম চাষাবাদ করতে পারলে অনেক সময় বেশি দাম পাওয়া যায়। শীতকালীন চাষাবাদের শাক-সবজি হলো- লাল শাক, পালং শাক, বাঁধা কপি, ফুলকপি, মুলা, গাজর, শিম, শালগম, লাউ, টমেটো, ব্রোকলি, লেটুস প্রভৃতি। গ্রীষ্মকালীন চাষাবাদের শাক-সবজি হলো- ডাঁটা, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, পটল, ঢেঁড়শ, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, করলা, শসা, বেগুন, ওলকচু, মুখীকচু, সজিনা, পুই, কলমি, হেলেঞ্চা, থানকুনি প্রভৃতি।

* আফ্রিকা, আফগানিস্তান, ইরান, মিশর, মরক্কো, আলজেরিয়া ও বেলুচিস্তানে বেশি চাষাবাদ হলেও দেশে দীর্ঘদিন ধরে ডালিম চাষাবাদ হচ্ছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের ধারণা, ডালিমের উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা। দেশে ডালিমের চাষাবাদ বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা না হলেও অনেকেই সৌখিন ভাবে বাড়ী-ঘরের আশ-পাশে সীমিতভাবে এর চাষাবাদ করে থাকেন। দেশের সমতল ভূমিতে প্রচুর পুষ্টি ও ভেষজ গুণ সম্পন্ন এই ফলের চাষাবাদের সম্ভাবনা প্রচুর। দীর্ঘাকৃতি গুল্মজাতের উদ্ভিদ ডালিমের জন্য গরম ও শুষ্ক গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া সবচেয়ে ভালো। কিছুটা তুষারপাত সহ্য করতে পারলেও ভিজে আবহাওয়ায় ফলের মান উন্নত হয় না। পানি নিষ্কাশনের সুবিধা সম্বলিত বেলে দোঁআশ মাটি বা পলি মাটিতে ফলন ভালো হয়। দেশে চাষাবাদ উপযোগি ডালিমের কয়েকটি উন্নত জাত হলো- স্প্যানিশ রুবি, পেপারসেল, মাসকেড প্রভৃতি।

* ক্রমাগত চাহিদার প্রেক্ষিতে দেশে জুঁই ফুলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুগন্ধের জন্য বাজারে এর চাহিদাও প্রচুর। জুঁই ফুলের অনেক গুলো প্রজাতি রয়েছে। দেশে সাধারণত মল্লী, যুঁথিমল্লী ও মুল্লাই প্রকারের জুঁই বাণিজ্যিকভাবে বেশি চাষাবাদ হচ্ছে। পর্যাপ্ত সূর্য্যালোক প্রাপ্ত উঁচু জমির পলি দোআঁশ মাটিতে জুঁইয়ের চাষাবাদ ভালো হয়। এ ফুলের চাষাবাদে তিনটি বিষয়ে সযতœ দৃষ্টি রাখতে হয়। বিষয় তিনটি হলো- ০১. যথাসময়ে পানি সেচ; ০২. যথাসময়ে সার প্রয়োগ এবং ০৩. যথাসময়ে ও যথোপযুক্ত পদ্ধতিতে গাছ ছাঁটাই। উল্লেখ্য, বিশেষজ্ঞরা বলেন শীতকাল জুঁই গাছ ছাঁটাইয়ের উপযুক্ত সময়। কেননা এ সময় গাছের বৃদ্ধি মন্থর থাকে। তবে গাছ ছাঁটাইয়ের অন্তত: পনের দিন আগ থেকে গাছে পানি সেচ বন্ধ রাখতে হবে।

* বাজারে প্রচুর চাহিদা সম্পন্ন আপেল কুলের চাষাবাদ লাভজনক। অন্যান্য কুলের তুলনায় সব সময়ই এ কুলের দাম বাজারে বেশি থাকে। এ কুল বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করে দেশের বিভিন্ন জেলায় অনেকেই স্বাবলম্বী ও লাভমান হওয়ার খবর প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আসছে। উল্লেখ্য, জাতীয় বীজ বোর্ড উদ্ভাবিত বিউ কুল-১ জাতটি দেশে/বাজারে আপেল কুল নামে পরিচিত। চৈত্র-বৈশাখ মাসে কুল সংগ্রহের পর অনুন্নত/জংলী গাছের শাখা কেটে ফেললে কিছুদিন পর নতুন শাখা বের হয়, সেসব শাখায় আপেল কুলের কুঁড়ি বাডিং পদ্ধতিতে সংযোজনের মাধ্যমে এ কুলের চাষাবাদ বিস্তার লাভ ঘটানো যায। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান/নার্সারী থেকে এ কুলের চারাও সংগ্রহ করা সম্ভব। বাডিং করা গাছে প্রথম বছরেই ফুল-ফল আসে। উপযুক্ত পরিচর্যায় একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছ থেকে বছরে ১৫০-১৮০ কেজি ফল পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, দেশে উৎপাদিত অন্যান্য/কুলের চেয়ে আপেল কুলের স্বাদ বেশি মিষ্ট এবং এতে যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন সি এবং অরগানিক এসিড বিদ্যমান।

* তুষারপাত ব্যতিত যে কোনো আবহাওয়ায় পেয়ারা চাষাবাদ করা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পেয়ারা গাছ সর্বোচ্চ ৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বায়ুর উষ্ণতা সহ্য করতে পারে। তবে অধিক বৃষ্টিপাতে পেয়ারার স্বাদ খারাপ হয়ে থাকে। পানি সুনিষ্কাশনের সুবিধা সম্বলিত উর্বর পলি মাটিতে পেয়ারার উৎপাদন ভালো হয়, বীজ ও কলম এর মাধ্যমে পেয়ারার বংশ বিস্তার/চাষাবাদ করা যায। বীজ থেকে চারা গজাতে সাধারণত ২০-২৫ দিন লাগে। বীজের গাছে ফল পেতে প্রায়ই ৪/৫ বছর সময় লাগে। বীজের গাছে পেয়ারার মাতৃ গাছের গুণাগুণ বজায় নাও থাকতে পারে। এ প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা পেয়ারার কলমের গাছ লাগানো ভালো বলে মনে করেন। গুটি কলম, জোড় কলম ও চোখ কলমের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা যায়। পেয়ারার চারা রোপণের উপযুক্ত সময় জুন-জুলাই মাস। তবে পানি সেচের সুবিধা থাকলে অথবা মাটিতে জো থাকলে বছরের অন্যান্য সময়েও এর চারা রোপণ করা যেতে পারে। বাণিজ্যিক চাষাবাদের জন্য সারিতে চারা রোপণ করা উচিৎ। গাছের সারির মধ্যে হাল্কা চাষ দিয়ে ঝরাপাতা ও আগাছা মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে মাটির উর্বরতা এবং মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। গাছ রোপণের ২/৩ বছর পর্যন্ত ফাঁকে ফাঁকে সাথী ফসল হিসেবে আদা, হলুদ, মরিচ ও বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি চাষাবাদ করে মাটির ও প্রয়োগকৃত সার এবং পানির উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে লাভমান হওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, পেয়ারা সাধারণত: বছরে দুইবার ফল দিয়ে থাকে। একবার বর্ষাকালে এবং একবার শীতকালে। বর্ষাকালের ফলন শীতকালের অপেক্ষা বেশি হলেও শীতকালের পেয়ারার গুণগত মান ভালো থাকে এবং বাজারে দামও বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া বর্ষাকালে বাজারে অন্যান্য দেশিয় ফলের আমদানী থাকে, পক্ষান্তরে শীতকালে বাজারে দেশিয় ফলের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। সার্বিক বিবেচনায় উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে শীতকালে পেয়ারার ফলন বৃদ্ধির দিকে চাষাবাদ সংশ্লিষ্টদের সচেষ্ট হওয়া উচিৎ।

লেখক: সম্পাদক – আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী অনিয়মিত প্রকাশনা)।

শেয়ার করুন: