আব্দুর রশীদ লুলু

চাষাবাদ বিষয়ক টুকিটাকি – ৩১

 সময়ের প্রেক্ষিতে ও যৌক্তিক কারণে এখন অনেকেই উচ্চ ফলনশীল ফসলের চাষাবাদে ঝুঁকছেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট অন্যান্য ফল-ফসলের পাশাপাশি বেশ কিছু শাক-সবজির উচ্চ ফলনশীল জাতের উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে টমেটো, বেগুন, মরিচ, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউ উল্লেখযোগ্য। চাষাবাদে এসবে সাফল্যও পাওয়া যাচ্ছে। সারা বছরব্যাপী এখন বেগুন ও লাউ চাষাবাদ হচ্ছে, গ্রীষ্মকালে টমেটো পাওয়া যাচ্ছে। অথচ এক সময় এগুলো অনেকটা অচিন্তনীয় বিষয় ছিল।

 অধিক ফলনশীল এবং বহুমুখী ব্যবহার সম্পন্ন দানা শস্য ভুট্টার চাষাবাদ দেশে ক্রমশ: বৃদ্ধি পাচ্ছে। জমিতে পানি জমে না এমন বেলে দোআঁশ এবং দোআঁশ মাটিতে ভুট্টার চাষাবাদ ভালো হয়। দেশে রবি মৌসুমে বেশি চাষাবাদ হলেও খরিপ মৌসুমেও এর চাষাবাদ হয়ে থাকে। রবি মৌসুমে অক্টোবর-নভেম্বর এবং খরিপ মৌসুমে মধ্য ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত বীজ বপণের উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট উদ্ভাবিত কয়েকটি উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাত হচ্ছে- মোহর, শুভ্রা, বর্ণালী, বারি ভুট্টা-৫, বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২ এবং বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩। এ ছাড়া কচি অবস্থায় খাওয়ার উপযোগি বারি মিষ্টি ভুট্টা-১। ভালো ফলনের জন্য সারিতে ভুট্টার চাষাবাদ করতে হয়। উল্লেখ্য, ধান ও গমের তুলনায় ভুট্টা দানার পুষ্টিমান অনেক বেশি।

 দেশে এক সময় খাল-বিল-হাওর-ডোবায় প্রচুর পরিমাণে সুস্বাদু ও জনপ্রিয় কৈ মাছ পাওয়া গেলেও এখন নানা কারণে তেমন পাওয়া যায় না। সময় ও চাহিদার প্রেক্ষিতে এখন পরিকল্পিতভাবে দেশে কৈ চাষ হচ্ছে। দেশে চাষকৃত কৈ মাছের জাতটি থাইল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত। দেশি কৈ মাছের তুলনায় থাই কৈ অধিক বর্ধনশীল। ইতোমধ্যে দেশে থাই কৈ মাছের চাষ লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে। পলি দোআঁশ বা এঁটেল দোআঁশ মাটির পুকুরে কৈ মাছের চাষ ভালো হয়। বন্যামুক্ত এবং কমপক্ষে ৫-৬ মাস পানি থেকে এমন পুকুর কৈ মাছ চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিৎ। এ ছাড়া রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ পুকুরে রাখা যাবে না। রাক্ষুসে মাছ কৈ মাছের পোনা খেয়ে ফেলে এবং অবাঞ্চিত মাছ চাষকৃত মাছের খাদ্য খেয়ে ফেলে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায়।

 প্রায় সব ধরণের গাছের বীজ দিয়ে বংশবিস্তার করা সহজে সম্ভব হলেও এখন প্রায়ই ফল-ফলাদির চাষাবাদে গাছের বিভিন্ন অঙ্গ দিয়ে চারা উৎপাদন এবং বংশবিস্তার করা হচ্ছে। কেননা লাভজনক হওয়ায় অঙ্গজ চারা উৎপাদন কৃষিতে ক্রমশ: জনপ্রিয় হচ্ছে। বলা যায়, অঙ্গজ চারার ব্যবহার চাষাবাদে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। এর একটি বিশেষ দিক হলো, এর চারা গাছ বিশুদ্ধ মাতৃগুণাগুণ বহন করে। এ ছাড়া এ ধরণের গাছ থেকে সহজেই ফল পাওয়া যায়। অঙ্গজ চারা উৎপাদন প্রযুক্তির মধ্যে দাবা কলম, গুটি কলম, জোড় কলম, কর্তন/ছেদ কলম এবং জোড় কলম প্রধান।

 ঔষধিগুণ সম্পন্ন নিম গাছের ব্যবহার অনেকভাবে হয়ে থাকে। নিমের পাতার নির্যাস শস্যের কীটনাশক হিসেবে চাষাবাদে প্রয়োগ করা হয়। চারা উৎপাদনের জন্য জুন-জুলাই মাসে এর বীজ সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। সাধারণত বীজ সংগ্রহের এক সপ্তাহের মধ্যেই পলিব্যাগে চারা উৎপাদনের জন্য লাগাতে হয়। সরাসরি মাটিতে/বীজ তলায় বীজ রোপণের মাধ্যমেও চারা উৎপাদন করা যায়। উৎপাদিত চারা এক বছর পর পরিকল্পিতভাবে মূল জমিতে লাগালে ভালো হয়। নিমের চারা রোপণের উপযুক্ত সময় মে-জুন মাস।

 খুবই শক্ত, টেকসই ও উন্নতমানের কাঠ বিশিষ্ট মেহগনির প্রধাণত বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা হয়। ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল মাস পর্যন্ত বীজ সংগ্রহ করে পলিব্যাগ/নার্সারির বীজ তলায় রোপণ করতে হয়। পলিব্যাগে রোপণের জন্য তিন ভাগের দু’ভাগ দোআঁশ মাটি এবং এক ভাগ জৈব সার মিশ্রিত মাটি হলে ভালো হয়। মেহগনির বীজের অঙ্গুরোদগমে সাধারণত ২০-৩০ দিন সময় লাগে। মাটির ৩-৪ সে.মি. গভীরে বীজ ঢুকিয়ে দিতে হয়। এছাড়া বীজ একটু কাত করে লাগাতে হয়, যাতে বীজের পাখা উপরের দিকে থাকে। মেহগনি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। এ দিকে লক্ষ্য করে উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে এ গাছ লাগাতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মেহগনি গাছের জন্য দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটি উত্তম। উল্লেখ্য, এ গাছের কাঠের রং সাধারণত লালচে খয়েরি, তবে গাছ বেশি পরিপক্ষ হলে কাঠের রং গাঢ় কালচে দেখায়। এ গাছের কাঠ খুব সুন্দর পলিশ নেয় বলে ঘরের আসবাবপত্র ও সৌখিন শিল্প সামগ্রী তৈরিতে এর চাহিদা প্রচুর।

 বন্যায় পানি ওঠে না এমন জায়গায় জাতীয় ফল কাঁঠালের চাষাবাদ করতে হয়। সব ধরণের মাটিতে কাঁঠালের চাষাবাদ হলেও পলি-দোআঁশ বা অল্প লাল মাটিতে এর উৎপাদন ভালো হয়। বীজ থেকে চারা উৎপাদন করে বা কলম পদ্ধতিতে চারা করে চাষাবাদ করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো ও উন্নতমানের নিশ্চয়তা না পেলে মাগনা (বিনা মূল্যে) পেলেও কাঁঠালের চারা/গাছ লাগানো উচিৎ নয়। কাঁঠালের চারা রোপণের উপযুক্ত সময় শ্রাবণ-ভাদ্র মাস। চারা রোপণের পর গোড়ার মাটি কিছুটা উঁচু করে দিতে হয়, যাতে গোড়ায় পানি না জমে। কেননা গোড়ায় পানি জমলে গাছ মরে যায়। আবার প্রয়োজনে পানি সেচ দিতে হয়। এছাড়া মাঝে মাঝে গোড়ার মাটি কুপিয়ে আলগা করে দিতে হয়। ফল ধরার তিন মাসের মধ্যে কাঁঠালে পুষ্ট অর্থাৎ খাওয়ার উপযোগি হয়। উল্লেখ্য, কাঁঠাল একটি বহুবিধ ব্যবহার উপযোগি উদ্ভিদ। এর চাষাবাদ তাই নিংসন্দেহে লাভজনক।

লেখক: সম্পাদক – আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা)।

শেয়ার করুন: