আব্দুর রশীদ লুলু

বিষয় বৈচিত্রে ভরপুর লাভলী চৌধুরীর গান

কবি লাভলী চৌধুরী

আমাদের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক পরিচিত নাম- লাভলী চৌধুরী। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তাঁর বিচরণ। তাঁর পৈত্রিক নিবাস সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার সিকন্দর পুর গ্রামে। তাঁর পিতা স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ মরহুম লতিফুর রহমান চৌধুরী। লেখক-গবেষক মরহুম আশরাফ হোসেন তাঁর নানা। লাভলী চৌধুরী ১১ মে ১৯৫০ ইং তাঁর নানার বাড়ী মুন্সিগঞ্জে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক “যুগভেরী”তে ১৫ মে ১৯৬১ সালে। এ পর্যন্ত তাঁর বেশ ক’টি বই প্রকাশিত হয়েছে।

সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় লাভলী চৌধুরীর বিচরণ হলেও আমরা এখানে তাঁর গানের ওপর একটু আলোকপাত করব। এ পর্যন্ত লাভলী চৌধুরী দু’শতাধিক গান লিখেছেন। বেরিয়েছে তাঁর গানের বই “গীতিগুচ্ছ” (সেপ্টেম্বর ১৯৮৩)। বাংলাদেশ বেতারের তিনি মনোনীত গীতিকারও।

গীতিকার লাভলী চৌধুরীর প্রথম গান প্রচারিত হয় বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্র থেকে ১৯৬৮ সালে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর গান প্রথম প্রচারিত হয় জুলাই ১৯৮৫ সালে শিল্পী নার্গিস পারভীনের কন্ঠে। গানটির প্রথম কলি- “এমন মুখোমুখি হবে যে দেখা, জানা ছিল না …….।”

বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর ১০টি জনপ্রিয় গানের মধ্যে ৫টা বাচ্ছাদের, ২টা ধর্মীয় ও ৩টা বড়দের জন্য লেখা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়েছে তাঁর ৫টি গান। সে গানগুলো মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে।

ষাটের দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সংকলনে তাঁর বেশ ক’টি গান প্রকাশিত হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের ভূমি দিবস (১৯৮৬)-এ সিলেট অডিটোরিয়ামে শিল্পী হিমাংশু বিশ্বাস ও তাঁর দলের কন্ঠে লাভলী চৌধুরীর আবেগময়ী গান শ্রোতাদের কাঁদিয়েছে। কাঁদিয়েছে গীতিকার লাভলী চৌধুরীকেও। সে গানে শ্রোতারা একাত্ম হয়েছেন ভূমিহারা-নির্যাতিত ফিলিস্তিনীদের সাথে। ভুমিহীন ফিলিস্তিনীদের হৃদয়ের হাহাকার গীতিকার লাভলী চৌধুরীর গানে যথার্থই প্রকাশ পেয়েছে-
হায় ফিলিস্তিন- হায় ফিলিস্তিন
আমাদের নেই কোন দেশ
আমরা বাঁধা-বন্ধনহীন, আমরা ভূমিহীন।
কোথায় যাব আমরা কোথায় ঠাঁই
দেশে দেশে ভেসে বেড়াই, শুধুই বেড়াই
স্বজন হারা ব্যাথা লয়ে বুকে
কেঁদে ফিরি বারে বারে——।
লাভলী চৌধুরীর গানে আছে স্বদেশ ও প্রকৃতি প্রেম। বিচিত্র বিষয়ে তিনি গান লিখেছেন। তাঁর গান শ্রোতাদের মুগ্ধ-আবিষ্ট করে। সামাজিক অনাচার-অসংগতিও তাঁর গানে উঠে এসেছে চমৎকার ভাবে-
বড় লক্ষীমন্ত মেয়ে ছিল
ছোট্ট গায়ের কলি
অসময়ে হলো যে
যৌতুকের বলি।
তন্বী-তনু মেয়েটির এমনি পোড়া কপাল
ভর-ভরাট দেহ মন ধরলো না হাল
সোহাগিনী হবার সাধ
গেল যে ভূলি।
বিভিন্ন অত্যাচার-নির্যাতনে বাংলার অনেক মেয়ে-বঁধু হয় নিস্পোষিত। খুঁজে পায় না মুক্তির উপায়। লাভলী চৌধুরীর গানের ন্যায় তারা শুধু হা পিতোশ করে আর নিজেকে নিজে শুধায়-
কার অভিশাপে ভেঙ্গে যায় ঘর
পুড়ে যায় বাধা নীড় …….।
লাভলী চৌধুরীর গানে একাত্তর তথা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চিত্রও আছে যথার্থ রূপে-
ও ভাইরে ভাই
একাত্তরের সে কথা আজ
কেমনে জানাই॥
লাগল আগুন জলে স্থলে
লাগল আগুন মনে মনে
ধন পুড়াইল-জন পুড়াইল
মান পুড়াইয়া ছাই॥……..
লাভলী চৌধুরীর গানে পরিশীলিত রোমান্টিকথাও আছে-
প্রজাপতি মেলে পাখা
যা উড়ে যা
তার তরে সব প্রীতি
যা নিয়ে যা॥
সবুজ পৃথিবী আজ মোর দু’মুঠোতে
ইমন কল্যাণ বাজে প্রিয় সেতারাতে
মধুর গুঞ্জনে ভরে আছে মন
পলাশ শিমুল তাই উম্মন
সে পলাশের পরাগ মেলে
যা উড়ে যা॥ ….
প্রেমিক-প্রেমিকার প্রথম দেখা প্রথম প্রেম। চোখে চোখ রাখা। রাত জাগা। ভালো লাগার দোলায় দোলা। এসবের আকুতিও তাঁর গানে ফুটে ওঠেছে-
মুগ্ধ দু’চোখে সোনার কাজল
পরিয়ে দিলে
ভালো লাগার দুলায় এমন
ভাসিয়ে নিলে॥ ……….
ছোট্ট সোনামণিদের হাল-চালও আছে তাঁর গানে-
পড়া দেখলে খোকার চোখে
নামে ঘুমের ঢল
খেলার শব্দ পেলে তার
পায়ে ফিরে বল …….।
পীর-ফকির, আউলিয়া-দরবেশের কথাও আছে লাভলী চৌধুরীর গানে। ভক্তি সহকারে হযরত শাহজালাল (রহ.) সম্পর্কে তাঁর গানে আছে-
বাহন জায়নামাজে নদী হয়ে পার
শাহজালাল বাবা সেই অবতার ………..।
যৌবনের সোনাঝরা দিন পেরিয়ে পৌঢ়ত্বের দিকে ক্রমান্বয়ে যাত্রাকারী নারী-পুরুষের আকুতি আর আফসোস যথার্থই ফুটে ওঠেছে তাঁর গানে-
দামী দিন গুলো চলে গেল জীবন থেকে
হেলায় খেলায় অবহেলায়
কে জানে আর কটা দিন দেবে আমাকে ……..।
মৃত্যু ভাবনাও আছে তাঁর গানে। মৃত্যুর পরও তিনি তাঁর ভক্ত-অনুরাগী কিংবা আত্মীয়-স্বজনের বুক ফাটা কান্না নয়, চান আন্তরিক ভালোবাসা-
শুধু একটি ফুল দিও মরণে আমার
অশ্র“মালা বাসনা নয় তো পাবার ……।
লাভলী চৌধুরীর গানে স্বদেশ প্রেম আর স্বাজাত্যবোধও আছে প্রবলভাবে। স্বদেশের দূর্দশায় তাঁর কন্ঠে ঝরে ঐকান্তিক ব্যাথা-প্রত্যাশা-
উঠান ভরা শস্য কোথা
কোথা হাস্য ধ্বনি
শ্বশ্মাণ কেন সোনার বাংলা
শুন্য সোনার খনি
ছিলেম আমরা পরম সুখে
গানে গানে পদ্ম মুখে
ফিরে দাও বাংলা মায়ের সেই শ্যামলা বরণ
আশার তরী বেয়ে যাব-করব কান্না হরণ।
সৃজনশীল-মমনশীল কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিকের মতো গান নিয়ে লাভলী চৌধুরীরও অতৃপ্তি প্রচুর। তিনি নিজেই সে কথা নির্দ্বিধায় তাঁর গানে বলেছেন-
বিদায়ের আগে ভেবেছি এ জীবনে
লিখবো একটি গান
স্নিগ্ধ চাঁদের আলোর মতন
গলে গলে ঝরবে পাষান॥
যখন হারিয়ে যাব তেমন দিন গেয়ে ওঠে যদি কেউ
চমকে চলা থেমে পৃথিবী শুনবে সুরের ঢেউ ……..
হ্যাঁ আমরা চাই গীতিকার লাভলী চৌধুরীর কাছ থেকে এমন গান যে গান কালোত্তীর্ণ হবে, তাঁকে অমর করে রাখবে। সে গানের সুর শুনে পথিক থমকে দাঁড়াবে, পাষাণ হৃদয় আপনা আপনি গলে যাবে।

 লেখক – সম্পাদক আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী অনিয়মিত প্রকাশনা)।

শেয়ার করুন: