চৈতন্য।। আব্দুর রশীদ লুলু

নদীর পাড় ধরে বিকেলে একা একা হাটতে গিয়ে মুকুল স্বপ্ন বুনে মনে মনে মিতাকে নিয়ে সংসার গড়বে। একটি সুখের নীড় হবে। দু’একটি ফুটফুটে বাচ্ছা হবে-।
হঠাৎ তার ভাবনা হোঁচট খায়, আরে! এ যে কলসী কাঁখে নদীর ঘাটে দেখা গতকালের ডাগর মেয়েটা। আজও কেমন হাঁ করে তাকিয়ে আছে। যেন রক্ত মাংসের মানুষ নয়, চিড়িয়াখানার আজব কোনো জীব দেখছে।
শহুরে ছেলে মুকুল এক সময় দু’কদম এগিয়ে যায়। গ্রামীণ মেয়েটার উৎসুক্য দুর করতে, কথা বলতে উদ্যত হয়। মেয়েটা হাল্কা নির্মল হাসে। মুকুলের সাহস বেড়ে যায় দ্বিগুণ। কিন্তু আপনি না তুমি সম্বোধন করবে এই দ্বিধা-দ্বন্ধে থমতম খায়।
ঃ আপনি কোথায় এসেছেন?
প্রথম প্রশ্ন করে মেয়েটা মুক্তি দেয় মুকুলকে। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে মুকুল-যাক বাবা বাঁচা গেলো।
মনে মনে প্রশংসা করে মেয়েটার। উত্তরে হুট করে বলে ফেলে- মিতাদের বাড়ীতে। বলে কেমন চুপসে যায়। ভাবে মিতার কথা না বলে ওর বাবার কথা বলা উচিৎ ছিল। ওহ কী অস্থি মজ্জায় মিশে গেছে মিতা।
মুকুলের উত্তর শুনে তীর্যক চোখে তাকায় মেয়েটা। তারপর রুক্ষ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করে মজিদের বাড়িতে?
মুহুর্তে মুকুলের রাগ চড়ে সপ্তগ্রামে। গাঢ় করে উত্তর দেয়- হ্যাঁ, মজিদ চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ীতে।
কথা শেষ না হতে অত্যন্ত তাচ্ছিল্য স্বরে ‘ওহ’ বলে মেয়েটা ঘুরে দাঁড়ায়। বাড়ীর পথে পা বাড়ায়।
বিব্রত হয় মুকুল, বুঝে ওঠতে পারে না মজিদ চেয়ারম্যানের নামে মেয়েটা অমন করল কেন? একি স্পষ্ট ঘৃণা? সে তো জানে, গ্রামে- এলাকায় চেয়ারম্যানের অনেক প্রভাব প্রতিপত্তি।
এক মিনিট ভাবে মুকুল। তারপর তার কর্তব্য স্থির করে নেয়। ভাবী শ্বশুর মজিদ চেয়ারম্যান সম্পর্কে তাকে সব কথা জেনে যেতে হবে। তাকে হতে হবে সন্দেহ-সংশয় মুক্ত।
দ্রুত পা চালায় মুকুল। হঠাৎ করে মেয়েটা যেন তার খুব আপন হয়ে যায়। পেছন থেকে সিঃসংকোচ হাঁক ছাড়ে- এই যে বোন শোন।
মেয়েটা শিউরে ওঠে এবং দাঁড়ায়। পেছন ফিরে তাকায়। অমন মধুর স্বরে বোন বলে কেউ কখনও তাকে ডাকেনি।
চেয়ারম্যানের নামে তোমার এত ঘৃণা কেন? মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুকুল সোজা প্রশ্ন করে। আচমকা প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় মেয়েটা। তারপর না এমনি বলে পাশ কেটে যেতে চায়। কিন্তু মুকুল ছাড়তে নারাজ।
ঃ প্লিজ, লক্ষী বোন, আমাকে সব কথা খুলে বল। মিনতি ঝরে তার কন্ঠে।
মুগ্ধ-অভিভূত হয়ে যায় মেয়েটা। রাখ-ঢাক করে না কিছু। কাঁখে ভরা কলসী রেখে অনর্গল বলে যায় সবকিছু। একাত্তরে মজিদ চেয়ারম্যানের অপকর্মের কথা। গ্রামে পাকসেনাদের নিয়ে আসার কথা। নিরীহ নিরপরাধ মানুষ জনের বাড়িতে আগুন দেয়ার কথা। তার স্কুল মাষ্টার বাবাকে নির্মমভাবে হত্যার কথা। যুদ্ধের পর সুকৌশল মজিদ চেয়ারম্যানের উত্তরণ ও প্রভাব প্রতিপত্তির কথা। বলতে বলতে মেয়েটার চোখে ছল ছল করলেও মুকুলের চোখে আগুণ জ্বলে। এক সময় শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে মেয়েটা চলে যায়। মুকুল পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধুলো বালিতে ধ্বপাস করে বসে পড়ে। ভাবে স্মৃতি চারণ করে।
মিতার মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সেরা ছাত্র মুকুল। বই ছাড়া কিছু জানে না, সব সময় তার একটা চিন্তা কিভাবে ভালো রিজাল্ট করা যায়। এর মাঝে বুঝতেই পারেনি মুকুল, কি ভাবে তিল তিল করে সুন্দরী সহপাঠিনী মিতা তার হৃদয়ের পরতে পরতে স্থান করে নিয়েছে। পরীক্ষা শেষে সহসা একদিন মিতা অনুরোধ করে- চলো আমাদের গ্রামটা দেখে আসবে। দেখে আসবে সুজলা-সুফলা বাংলাকে।
মুকুল না করতে পারেনি এবং হৃষ্ট চিত্তে চলে এসেছে। এখানে এসে দেখে শুনে সর্বোপরি মিতার সাথে ওঠা-বসা করে মুগ্ধ হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিতাকে বরণ করে নেয়ার। কিন্তু এখন ভাবতে গিয়ে মুকুলের চোখে ক্রমশঃ মিতার ভালো মুখ কালো হয়ে ওঠে। একাত্তরে ওর কলেজ পড়ুয়া রানু আপুকে রাজাকররা ধরে নিয়ে পাক সেনাদের দিয়েছে। সারাটা জীবন রানু আপু বিষন্নতার মধ্যে একাকী কাটিয়ে দিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। মুকুল যেন দিব্যি দেখতে পায়। ওই রাজাকারদের দলনেতা মিতার বাবা মজিদ চেয়ারম্যান।
এমন অবস্থায় পেছন থেকে চুপি চুপি এসে মিতা দু’চোখ চেপে ধরে এবং আহ্লাদী স্বরে বলতে যায়- এ্যাই, কী এতো ভাবছ?
মুহুর্তে মুকুল গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। মিতার কোমল হাতের স্পর্শ কাঁটার মতো বিঁধে। ঘৃণায় গা রি রি করে। এক ঝটকায় সরে দাঁড়ায়।
তারপর হন হন করে ছুটে চলে তার নিজস্ব গন্তব্যের দিকে। যেদিকে ভরা কলসী কাঁখে আইবুড়ো মেয়েটা গেছে।

শেয়ার করুন: