সম্মানিত কারো বার বার জানাযা পড়লে তাঁর মর্যাদা আরো প্রকাশিত হবে—এমনটি যদি হত তাহলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহা-প্রয়াণের পর মাক্কা অথবা অন্য শহরেগুলোতে সাহাবীগণ তাই করতেন।
চার খালিফাগণের প্রয়াণের পর অন্যান্য শহরে তাঁদের জন্য আরো জানাযা হত।
চার ইমামগণের জন্যও তাঁদের অনুসারীরা অন্যত্র জানাযা পড়তেন।
শাইখ বিন বায রাহিমাহুল্লাহুর জন্যও অন্য কোথাও দ্বিতীয় জানাযা হত।
কিন্তু এমনটি হয়নি।
২.
ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি সুন্দর ও সুষ্ঠ জানাযার পর দ্বিতীয় অথবা বার বার আরো জানাযার আয়োজন করা নিশ্চয় দ্বীন কায়েমের কসরত নয়। প্রতিকূল পরিবেশে এমনি কোন জানাযায় শরীক হয়ে কেউ যদি নিজেই জানাযার পাত্র হয়ে যায়—তাহলে এ পরিণতির কী হবে!
৩.
নাজাশি রাহিমাহুল্লাহ’র জানাযা হয়নি তাঁর নিজ দেশে। নাজাশির জানাযার কোন সম্ভাবনাও ছিল না তাঁর নিজ দেশে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য একটি ব্যতিক্রমী জানাযা পড়লেন মাদিনা শহরে। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এই মহান মানুষটির জন্য মাক্কা অথবা অন্য শহরে জানাযা পড়তে আদেশ কিংবা ইঙ্গিত করেননি। এবং মাদিনা ছাড়া অন্য কোথাও তাঁর জানাযা হয়নি। গায়িবানা জানাযা হোক অথবা জানাযা হোক মূলত একটিই জানাযা হয়েছে নাজাশীর জন্য।
যদি এ জানাযা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম না পড়তেন তাহলে আর কখনো নাজাশীর জন্য জানাযা পড়া হত না।
৪.
যদি বলা হয়, ইমামদের মধ্যে গায়িবানা জানাযা নিয়ে বিতর্ক আছে। এবং কোন কোন ইমাম অদৃশ্য-লাশের জানাযার পক্ষে অনুমতি দিয়েছেন তাহলেও কথা চূড়ান্ত হয়ে যায়নি।
সচেতন মুসলিমকে দেখতে হবে—যে কোন এক শাসনের বিপরীতে অথবা প্রতিকূল পরিবেশে, পুনর্বার কিংবা পুনঃপুনঃ জানাযা অথবা গায়িবানা জানাযার অনুমতি সেই ইমাম দিচ্ছেন কী না!
কথাটির গুরুত্ব এ কারণে দিতে হবে যে, প্রতিটি মুসলিমকে এলোপাতাড়ি না চলে বরং চলতে হবে একটি আদর্শের উপর।
৫.
মুসলিম কারো মৃত্যু হলে পর জানাযা পড়া নিতান্ত কর্তব্য। সুষ্ট একটি জানাযার পর এ কর্তব্য আর থাকে না।
অতঃপর অতিরিক্ত কিছুর জন্য অতিরিক্ত কিছু করার সুযোগ না থাকলে সংযমী হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
৬.
মৃত কোন প্রিয় মানুষের জন্য ভালোবাসা প্রদর্শন করে মানুষ অনেক কিছু করতে চায়, যেমন মাতম বা বুক চাপড়িয়ে শোক প্রকাশ করতে ভাল পায়। অনেকে আবার ধর্মীয় আড়ালে কিছু বা অনেক কিছু করতে চায় যেমন তিনদিনি আয়োজন পছন্দ করে।কিন্তু সত্য ধর্ম এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা দেয় তাহল—ধৈর্য্য এবং আদর্শ।
আবার ধৈর্য্য এবং আদর্শ কী! তা জিজ্ঞেস করে নিতে হবে স্থানীয় ইসলামী বিজ্ঞদের কাছ থেকে। ইসলামী মতাদর্শের প্রতিটি মানুষকে আবেগ থেকে সহনশীলতাকে প্রাধান্য দেওয়া শিখতে হবে। আর হুজুগের প্রশ্রয় তো একেবারে নয়।
৭.
ধর্মীয় প্রজ্ঞা, এমনকি রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও এটির আজ্ঞা হয়ত দিবে না যে, একটি এলাকায়, প্রতিষ্ঠিত ও মীমাংসিত বৈধ ও ন্যায্য একটি প্রচলিত রীতির বিপরীতে ধর্মীয় একটি বিতর্কিত বিষয় সমাজে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো। যে মানুষ অথবা যে দলটি এমন বিষয় নিয়ে পিড়াপিড়ি করবে তাঁর ও তাঁদের ধর্মীয় জ্ঞানের দীনতা ও সংকীর্ণতা প্রকাশ পাবে।
উল্লেখ্য, সত্য ধর্মে এমন অনেক কিছু আছে যা বৈধ হওয়া সত্ত্বেও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা থেকে বিরত থাকারই শিক্ষা দেয়।
৮.
জানাযা মূলত দুআ’র ভিত্তিতে সাজানো একটি সালাহ বা নামায। এ সালাতেরও নিয়ম নীতি আছে যা ধর্মীয় ভাবে নির্দিষ্ট করা।সর্বোপরি, এ সালাত একটি ইবাদাত।
এ নামাযও আদায় করতে হবে স্রষ্টার জন্য।রাব্বকে খুশি করার জন্য।তাঁর সন্তুষ্টির জন্য। তাই এই সালাতও লৌকিকতা মুক্ত হওয়া চাই। বিশেষত, স্রষ্টার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য।
৯.
‘গায়িবানা জানাযা’ অথবা বার বার জানাযা পড়া একটি ধর্মীয় বিতর্কিত বিষয়। এটি নিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করা গোঁড়ামি এবং উগ্রতার পথ প্রশস্ত হবে। তাই, এমনটি আশা করা যায় না ইসলামী ভাবাদর্শ আধুনিক ও সচেতন কারো কাছ থেকে।
১০.
পৃথিবী থেকে এমন অনেক মহান ইসলামী ও প্রিয় মানুষ চলে গেছেন যাদের জানাযায় সামান্য মানুষই হয়ত শরিক হয়েছে তবুও মানুষ ও স্রষ্টার কাছে তাঁদের মর্যাদা হ্রাস বা কম হয়নি। পক্ষান্তরে, এমনও মানুষ ছিল যাদের শেষকৃত্যে অপরিমিত লোকসমাগম হয়েছে তবুও কিন্তু স্রষ্টার কাছে তাঁর সম্মান জিরোই থেকে গেছে। তাই, জানাযা দিয়ে সব গৌরব নির্ণয় করার মানসিকতায় আটকে থাকা সুখকর নয়।
লেখক: মুফতি