চাষাবাদ বিষয়ক টুকিটাকি – ৪৫।। আব্দুর রশীদ লুলু

 দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল তিল। তবে সারা দেশেই তিলের চাষাবাদ সম্ভব। তিল চাষাবাদের জন্য উঁচু জমি নির্বাচন করা ভালো। বেলে দোঁ-আশ এবং দোঁ-আশ মাটি তিল চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে জমি জলাবদ্ধতাহীন হতে হবে এবং মাটির ভালো রস ধারণ ক্ষমতা থাকতে হবে। এছাড়া ৩/৪ টি চাষ মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হয় যাতে মাটির ঢেলা না থাকে। তিলের একটি ভালো জাত হলো বারি তিল-৪। এ জাতের উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য হলো- গাছের উচ্চতা ৯০-১১০ সে.মি হয়, গাছ প্রতি শাখা ৪-৭টি হয়, বীজের রং লালচে বর্ণের এবং জীবনকাল ৯০-১০০ দিন। এ জাতের তিলের বীজ ১-১৫ ফাল্গুনের মধ্যে বপণ করতে হয়। উল্লেখ্য, দেশে রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমেই তিলের চাষাবাদ করা যায। তবে দেশে তিল চাষাবাদের দুই তৃতীয়াংশ খরিফ মৌসুমেই হয়ে থাকে।

 লাউ প্রায় সব ধরণের মাটিতে চাষাবাদ হলেও অভিজ্ঞরা বলেন, দোআঁশ ও এঁটেল দোআঁশ মাটিতে এর চাষাবাদ ভালো হয়। এ ছাড়া পর্যবেক্ষণকারী ও অভিজ্ঞরা বলেন, বেলে মাটিতে উৎপাদিত লাউয়ের স্বাদ আলাদা ও অনন্য। উল্লেখ্য, লাউ দিবস নিরপেক্ষ লতানো উদ্ভিদ। দিবস নিরপেক্ষ হওয়ায় বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় চাষাবাদের মাধ্যমে এর উৎপাদন লাভ সম্ভব। পর্যাপ্ত রস সম্বলিত মাঝারি উঁচু জমি লাউ চাষাবাদের জন্য ভালো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জনপ্রিয় সবজি লাউ খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে, কোষ্টকাঠিন্য দূর করে ও হজমে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, লাউয়ের চেয়ে এর ডগা ও পাতা বেশি পুষ্টিকর।

 জনপ্রিয়, রসালো ও আকর্ষণীয় একটি ফল হলো লিচু। দেশে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে এর ফলন পাওয়া যায়। লিচু চাষাবাদে প্রায়ই দেখা যায়, একবার গাছে ভালো ফলন লাভের পরের বার তেমন ফলন পাওয়া যায় না। অথচ চাষাবাদ সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা থাকে প্রতি বছর ভালো ফলন লাভ। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা কিছু বিশেষ ব্যবস্থাপণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। যেমন- ফলন সংগ্রহের পর পর চিকন ও ঘণ ডালগুলো ছাটাই করা। যদিও ফলন সংগ্রহের সময় বেশ কিছু চিকন ডাল এমনিতে ভাঙ্গা/কাটা পড়ে। ডাল ছাটাইয়ের সময় অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যেন হাতের আঙ্গুলের চেয়ে মোটা/বড় ডাল ছাটাই করা না হয়। ছাটাইয়ের কাজ ফল সংগ্রহের পর মে-জুন মাসের মধ্যেই শেষ করতে হবে। এ ছাড়া কাঙ্খিত মাত্রায় ফলন লাভের জন্য গাছের গোড়ায় বছরে দু’বার নির্ধারিত মাত্রায় সার প্রয়োগ ছাড়াও শুষ্ক মৌসুমে গাছের গোড়ায় রস স্বাভাবিক মাত্রায় রাখতে প্রয়োজনীয় সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।

 দেশে সব ধরণের মাটিতে টমেটো চাষাবাদ সম্ভব হলেও দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে টমেটোর চাষাবাদ ভালো হয়। চাষাবাদ সংশ্লিষ্টরা বলেন, চারা রোপণের পূর্বে শতক প্রতি ৬০ কেজি গোবর ও ৭০০ গ্রাম টিএসপি সার ছিটিয়ে ৫/৬টি চাষ দেয়া উচিৎ। এরপর মাটি সমান করে চারা রোপণ করা ভালো। ৪-৫ সপ্তাহের চারা বীজতলা থেকে সংগ্রহ করে পূর্ব প্রস্তুতকৃত মূল জমিতে পরিকল্পিতভাবে লাগাতে হয়। টমেটোর চাষাবাদের জমিতে আগাছা থাকা খুবই ক্ষতিকর। প্রয়োজনে নিড়ানি দিয়ে মাটি আলগা করে দিতে হয়। এছাড়া মাটিতে রস কমে গেলে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। টমেটো পাকতে শুরু করলে সংগে সংগে সংগ্রহ করা উচিৎ। ভালো জাতের টমেটো উপযুক্ত পরিচর্যায় হেক্টর প্রতি ২০-২৫ টন পর্যন্ত পাওয়া যেতে পারে।

 পৃথিবীর প্রধান সবজি সমূহের অন্যতম শসা। এটি একটি কুমড়া জাতীয় সবজি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এর চাষাবাদ হয়। দেশে সালাদ ও সবজি হিসেবে ব্যবহৃত শসার চাষাবাদ লাভজনক। প্রচুর পুষ্টিমাণ সমৃদ্ধ শসার অনেকগুলো জাত রয়েছে। উফশী জাতের মধ্যে আছে- রতœা, শীলা, গ্রীণ জয়েন্ট, গ্রীণ কিং, বারোমাসী, জ্যোতি ইত্যাদি। হাইব্রিডের মধ্যে আছে- হীরা-৯০৪,, ডেডী-২২৩১, বুলবুল, আলভী, তিতুমীর, হিমেল, নাইস গ্রীণ প্রভৃতি। হাইব্রিড শসা হীরা-৯০৪ শীতকাল অর্থাৎ পৌষ-মাঘ মাস ব্যতিত সারা বছরই চাষাবাদ করা যায়। এর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আছে ৩৫-৩৮ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ উপযোগি হয়, প্রতিটি ফলের গড় ওজন ৩০০-৩২০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং উপযুক্ত পরিচর্যায় হেক্টর প্রতি ফলন ২৫-৩০ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে।

 মুখী কচু চাষাবাদের জন্য দোআঁশ মাটি উত্তম। রোপণের উপযুক্ত সময় ফাল্গুন মাস। উল্লেখ্য, মুখী কচুর মুখীই বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বীজের আকার মধ্যম হওয়া ভালো। বেশী বড় কিংবা বেশী ছোট বীজ লাগানো অনুচিৎ। মধ্যম আকৃতির বীজ হলে হেক্টর প্রতি ৪৫০-৬০০ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। বীজ সারিতে লাগাতে হয়। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৭৫ সে.মি. এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ৪৫ সে.মি.। মুখী কচুর গাছ হলুদ হয়ে যখন শুকিয়ে যেতে থাকে, তখন মুখী সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। এতে প্রায় ৬/৭ মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। তবে আগাম বাজারজাতের জন্য রোপণের ৪/৫ মাস পরও ফসল সংগ্রহ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, আগাম বাজারজাতের মাধ্যমে অধিক মূল্য পেয়ে অনেক সময় কৃষক/কৃষাণী লাভমান হয়ে থাকেন।

 দেশের সব অঞ্চলে সহজেই চাষাবাদ উপযোগী পানি কচু একটি গুরুত্বপূর্ণ সবজি। এর কচু ও লতি সুস্বাদু। পানি কচু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমনÑ জাত কচু, বাঁশ কচু, নারিকেল কচু, শোলা কচু, খামা কচু ইত্যাদি। এ কচু দাঁড়ানো পানিতে চাষাবাদ করা হয় বলে এর নাম পানি কচু। গবেষকরা বলেন, পানি কচুর আদি বাস ভুমি বাংলাদেশ। দোআঁশ ও এঁটেল মাটি পানি কচু চাষাবাদের উপযোগী। ভালো ফলনের জন্য পানি কচু সারিতে চাষাবাদ করা উচিৎ। এ ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৬০ সে.মি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৪৫ সে.মি। উল্লেখ্য, পানি কচুর জমিতে সব সময়ই কিছু না কিছু পানি থাকতেই হবে।

লেখক: সম্পাদক – আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী অনিয়মিত প্রকাশনা), সিলেট।

শেয়ার করুন: