ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমার অন্যতম প্রিয় লেখক ও ব্যক্তিত্ব। তাঁর বড়ভাই হুমায়ন আহমেদের বই “আমার ছেলেবেলা” বিগত শতাদ্বীর শেষার্ধে প্রথম প্রকাশিত হলে সেটা আমি গোগ্রাসে গিলি। এর আগে হুমায়ন আহমেদের “কোথাও কেউ নেই” পড়ে আমি অভিভূত। কথাসাহিত্যের পাঠক আমি স্মৃতিচারণ পড়ে তখন আরো অভিভূত। সেই “আমার ছেলেবেলা”য় জানি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম ও ছোটবেলাই তাঁর ব্যতিক্রমী কাজ—কর্ম ও চরিত্রের কথা।
যা হোক, আমি বিজ্ঞানের মানুষ না হয়েও ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক বইগুলো আগ্রহ সহকারে ঘাটাঘাটি করতে থাকি। আমার মাঝে ক্রমে বিজ্ঞান মনস্কতা গড়ে উঠে। আমি আগ্রহ সহকারে তাই রাজীব স্মৃতি গ্রন্থাগারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কর্নার গড়ে তুলি। বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তি বিষয়ক দেশ—বিদেশের অন্যান্য বইগুলো আমি খেঁাজে খেঁাজে সংগ্রহ করি। প্রসঙ্গত বলা যায়, এদেশে গণিতকে জনপ্রিয় করতে লেখালেখি ও গণিত অলিম্পিয়াড এর মাধ্যমে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর সহযোগী জামিলুর রেজা চৌধুরী (মরহুম), ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ, মুনীর হাসান প্রমুখদের নিয়ে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। বিজ্ঞানমনস্ক উন্নত জাতি গড়তে যার ভূমিকা অনেক।
শুধু বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তি বিষয়ক লেখার জন্য নয়, শিশুদেরসহ তাঁর অন্যান্য লেখার জন্যও তিনি আমার প্রিয় লেখক। সুযোগ পেলেই আমি তাঁর লেখা পড়ি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর ভাবনা ও লেখাগুলো আমাকে তাঁর অনুরাগীতে পরিণত করে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তাঁর লেখা দুঃখের গল্প খুবই বাস্তব সম্মত ছিল। যে লেখাটার কথা আমি জনে জনে বলেছি। তাঁর অনেক লেখা ও ভাবনা ভালোলাগার বোধ থেকে আমি আমার সম্পাদিত শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা “আনোয়ারা”য় তাঁর লেখার অংশ বিশেষ প্রাজ্ঞবচন হিসেবে তুলে ধরেছি। মানুষের প্রতি দরদ ও মানুষকে কর্মে উদ্দীপ্ত করার প্রচেষ্টা আমাকে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রতিও আকৃষ্ট করে। বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, লেখক, শিক্ষাবিদ প্রভৃতি অভিধায় অভিষিক্ত ড. জাফর ইকবাল সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলে ইচ্ছে জাগে তাঁর সাথে সরাসরি দেখা—সাক্ষাৎ করার। পরিচিত যাদের সাথে তাঁর দেখা হয়েছে, তারা বলেন স্যার ভালো ব্যবহার করেছেন।
যা হোক, খোঁজ নিয়ে জানা গেলো আমার এলাকার এক ছোটভাই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্টিশিয়ান হিসেবে চাকুরী করেন। মো. আইয়ুব আলী নামের আমার সেই অনুজ প্রতীমের সাথে দেখা—সাক্ষাৎ হলে জাফর ইকবাল স্যারের কথা বলাবলি করি এবং একদিন দেখা—সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করি। আইয়ুব আলী ‘একদিন আসেন আসেন’ করেন। আমি আর সুযোগ করতে পারি না। এর মাঝে অনেকদিন গড়িয়ে যায়। সহসা আইয়ুব আলী ফোন দেন— শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জাফর ইকবাল স্যারের দিন শেষ। অবসর নিয়ে চলে যাচ্ছেন। আগামীকাল শেষ কর্মদিবস। দেখা করতে হলে তাড়াতাড়ি আসেন। এই মাত্র ক’দিন আগে পড়ে শেষ করেছি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে নিয়ে সাংবাদিক আব্দুল জব্বার—এর ভিন্নধর্মী সাক্ষাৎকার ভিত্তিক বড় বই। যেখানে তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন অকপটে।
মনটা এমনিতেই আচ্ছন্ন হয়ে আছে জাফর ইকবালে। অতএব আর গড়িমসি নয়। পরদিন ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ আমার ছেলে আনিসুল আলম নাহিদ (সম্পাদক— চাষাবাদ ও কৃষি আলো), আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. আব্দুর রউফ এবং আরো দু’জন সহযোগীসহ সোজা গিয়ে হাজির হই জাফর ইকবাল স্যারের অফিসের দরজায়। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত আইয়ুব আলী স্যারের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। স্যার তখন কম্পিউটারে কাজ করছিলেন। উঠে এসে আমাদের আগ্রহ সহকারে অভ্যর্থনা জানান। আমাদের নিয়ে টেবিলে বসেন। দীর্ঘসময় দেন। আমরা লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত জেনে খুশি হোন। আনোয়ারা হোমিও হল ও আনোয়ারা ফাউন্ডেশনের কয়েকটা প্রকাশনা আমার ছেলে তাঁর হাতে তুলে দেয়। তিনি তা আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন। বিশেষ করে আমার ছেলে আনিসুল আলম নাহিদ সঙ্কলিত ও সম্পাদিত “আনোয়ারায় উদ্ধৃত প্রাজ্ঞবচন” বইটি স্যার ঘেটে দেখেন, যেখানে দেশ—বিদেশের বিশিষ্টজনদের সাথে তাঁর প্রাজ্ঞবচনও মুদ্রিত হয়েছে।
আমার সম্পাদিত শাহ আব্দুল করিম সংক্রান্ত সংকলনটি হাতে নিয়ে শাহ আব্দুল করিম সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন। তাঁর সাথে সিলেটে দুঃখজনক ঘটনার জন্য সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করি। উত্তরে তিনি হাসেন এবং জানান সিলেটে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আমি বলি, হুমায়ুন স্যারের ছেলেবেলায় অনেক আগেই আমি তা পড়েছি। এ ছাড়া সিলেট নিয়ে একটা স্মৃতিচারণমূলক বই লেখার জন্যও সেদিন আমি তাঁকে অনুরোধ করি। আমাদের সহযোগী তাজুল ইসলাম আমীর স্যারের সাথে আমাদের অনেকগুলো ছবি তুলে। স্যার এতে আন্তরিক সহযোগিতা করেন। তাঁর মূল্যবান সময় খুব বেশি নেওয়া ঠিক হবে না ভেবে আমরাই নিজ থেকে স্যারের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করি। বিদায়ের আগে স্যার আমার ছেলে আনিসুল আলম নাহিদের মাথায় হাত বুলিয়ে শুভ কামনা করেন এবং আব্দুর রউফ স্যারের কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন। এরপর তিনি চেয়ার থেকে উঠে এসে দরজা পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দেন। কাছে থেকে ড. জাফর ইকবাল স্যারকে দেখে আমার বারবার বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথা মনে পড়ে। স্যারের অঙ্গ বৈশিষ্ট্য অনেকটা আলাদা, দেখতেই বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী মনে হয়। স্যারকে দেখে, আমার মনে হয়েছে, স্যার অনেক ভাগ্যবান—ভালো ও জ্ঞানী মা—বাবা পেয়েছেন, ভালো পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। যে পরিবারের সবাই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং লেখালেখি তথা সাহিত্য—সংস্কৃতির সাথে জড়িত। যদিও জানি লেখাপড়ায় তাঁদের একাগ্রতা তুলনাহীন। প্রতিষ্ঠার জন্য মায়ের সহযোগীতায় জাফর ইকবাল স্যার ও তাঁর ভাইয়েরা অভাব—অনটন ও দুঃখ—কষ্টের সাগর পাড়ি দিয়ে আজ এ অবস্থানে এসেছেন।
যা হোক, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাথে কাটানো ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর দিনটি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং তাঁর সুস্থ শতায়ু কামনা করছি। একই সাথে ধন্যবাদ অনুজপ্রতীম মো. আইয়ুব আলীকে স্যারের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেয়ার ও বিকেলে বাসায় আমাদের ভূরিভোজনে আপ্যায়িত করার জন্য। দুঃখিত ব্যস্ততার জন্য অনুজ প্রতীম মো. মতিউর রহমানকে ড. জাফর ইকবাল স্যারের ওখানে নিতে না পারার জন্য। যদিও জানি আমার লেখালেখি ও অন্যান্য কাজের অন্যতম সহযোগী মতিউরকে নিতে পারলে ভালো হতো।
আব্দুর রশীদ লুলু: ইসলাম ধর্ম, হোমিওপ্যাথি ও কৃষি বিষয়ক লেখক ও গবেষক।