শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

আব্দুর রশীদ লুলু

ডা. কবীর আহমদ: অনুভবে অনুভূতি



ডা. কবীর আহমদ

কক্সবাজার তথা দেশের একজন বর্ষীয়ান ও প্রথিত যশা হোমিও চিকিৎসক ডা. কবীর আহমদ একই সাথে একজন কবি, লেখক ও গবেষক। বলা হয়, ‘ডা. কবীর আহমদ জীবন ঘনিষ্ট সেবামূলক পেশায় একজন চিকিৎসক হলেও, অন্ত:করণে বিকশিত সত্তায় একজন কবি’। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘ডাক্তার কবীর আহমদ হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের এপার-ওপার বাংলার গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থকার হলেও মননে ও সত্তায় তিনি একজন কবি’। ১৯৩১ সালের ১লা জানুয়ারি জন্মগ্রহণকারী এমন একজন গুণী ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মানুষের সাথে আজো আমার সরাসরি দেখা হয়নি। জনৈক বন্ধু সুহৃদ (যে এখন একটি সরকারী ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা) এর মাধ্যমে আশির দশকের শেষ দিকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে আমার পরিচয় (যদিও নব্বই দশকের শুরু থেকে আমার সক্রিয় হোমিওপ্যাথির চর্চা)। তখন থেকে অর্থাৎ আশির দশকের শেষদিক থেকে আমি একটু একটু হোমিওপ্যাথিক বই ও পত্রপত্রিকা নাড়াচাড়া শুরু করি। পড়তে থাকি নোয়াখালী থেকে প্রকাশিত ডা: আবু হোসেন সরকার সম্পাদিত “মাসিক পারিবারিক চিকিৎসা”। ক্রমান্বয়ে পড়তে থাকি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ড থেকে প্রকাশিত ডা: জহুরুল ইসলাম সম্পাদিত “বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পত্রিকা”, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ডা: এম এ হালিম সম্পাদিত “মাসিক হোমিও দর্পণ” এবং চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ডা: সালেহ আহমদ সুলেমান সম্পাদিত “মাসিক হোমিও চেতনা”। এসব পত্র-পত্রিকা এবং বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত “স্ট্যান্ডার্ড মেটেরিয়া মেডিকা” (চার খন্ড) পাঠে আমি ডা: কবীর আহমদ এর নামের সাথে পরিচিতি লাভ করি। অন্যান্য দু’একজন বিশেষ করে এলোপ্যাথি থেকে হোমিওপ্যাথিতে রূপান্তরিত বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও কবি ডা: জহুরুল ইসলামের লেখার সাথে বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎসক, সমাজসেবক, সাহিত্যিক ডাঃ কবীর আহমদের লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ ও অভিভূত হই। হোমিও বিষয়ক কোনো প্রকাশনা হাতে পড়লেই, পাতা উল্টে আগে দেখে নিই এ দু’জনের লেখা আছে কিনা। ক্রমে অদেখা এ দু’জন হয়ে ওঠেন আমার অন্যতম প্রিয় লেখক ও ব্যাক্তিত্ব। যদিও দু’জনের লেখার স্টাইল দু’রকম।

১৯৯১ ইং সাল থেকে হোমিওপ্যাথির সাথে আমার গাঁটছড়া বন্ধন হলে আলাপ-পরিচয় হয় বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎসক ড. নজীর আহমদ এর সাথে। তিনি প্রায়ই মরহুম অধ্যাপক ডাঃ বদরুল আলম, মরহুম ডাঃ জহুরুল ইসলাম, অধ্যক্ষ ডা: আব্দুল করিম এর সাথে সাথে ডাঃ কবীর আহমদ এর কথা আলোচনা করেন। আমি মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনে যাই। মনে মনে তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাঁদের অনুসরণে হোমিওপ্যাথি (ও লেখালেখি)তে নিবেদিত একটি জীবন গড়ার প্রত্যয় নিই। যদিও দীর্ঘ জীবন লেখালেখি ও হোমিওপ্যাথিতে কাটিয়ে এখন অনুভব করি একজন কবীর আহমদ (কিংবা একজন ডা. জহুরুল ইসলাম কিংবা একজন ড. নজীর আহমদ কিংবা একজন ডা. আব্দুল করিম) হওয়া চাট্রিখানি কথা না। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাধ্য-সাধনায় এমন একজন হতে হয়। ডা. কবীর আহমদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন জনের লেখা পড়ে তাঁর সম্পর্কে আমার আগ্রহ আরো গভীর হয়েছে। কর্ম ও সাধনায় তাঁর জিরো থেকে হিরো হয়ে ওঠার কথা পড়তে পড়তে আমার প্রায়ই মনে হয়েছে, তাঁর পদপ্রান্তে বসে থেকে যদি কিছুদিন হোমিওপ্যাথি শিখতে পারতাম। সিলেট থেকে সুদূর কক্সবাজার তদুপরি তাঁর অশীতিপর বয়স আমার এ আগ্রহে বাধ সাধে। তাই অনেক দিন বলি বলি করেও বলা হয়নি- গুরু ছুটে আসি আপনার কাছে।

প্রথম জীবনে সম্পাদনা (এবং লেখালেখি)র প্রতি আগ্রহ থেকে অনেকটা পরিণত বয়সে ২০০৪ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে আমি আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান আনোয়ারা হোমিও হল থেকে প্রকাশ করছি শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা “আনোয়ারা”। দেশের অনেক বিশিষ্ট লেখকের সাথে বিভিন্ন সময়ে আমার সম্পাদিত “আনোয়ারা”য় ডা. কবীর আহমদের অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বইয়ের আলোচনা-সমালোচনা। লেখাগুলো পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঠক তাঁর ও তাঁর বই সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সে প্রেক্ষিতে আমি মনে করি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তাঁর সবগুলো লেখা গ্রন্থিত হওয়া দরকার। দরকার তাঁর সবগুলো লেখা নিয়ে “ডা. কবীর আহমদ রচনা সমগ্র” প্রকাশ করা। প্রসঙ্গত এ বিষয়ে তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী ও শুভানুধ্যায়ীদের দৃষ্টি সবিনয় কামনা করছি। সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও বিগত ক’বছর ধরে ডা. কবীর আহমদের সাথে আমার নিয়মিত কথা ও পত্র যোগাযোগ হচ্ছে। আমার জন্য এ অনেক বড় পাওয়া। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর কাছে অনেক ঋণী। এই নব্বই ছুঁই ছুঁই বয়সে অনেক সময় তিনি স্বত:স্ফুর্তভাবে আমার খোঁজ-খবর নেন, “আনোয়ারা” (শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা) পাঠাতে অনুরোধ করেন। সর্বোপরি হোমিওপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথদের সম্পর্কে তথ্যাদি দেন। দেশের বিশিষ্ট কোনো হোমিও চিকিৎসক ইন্তেকাল করলে সে সংবাদ “আনোয়ারা”য় ছাপাতে ও শোকবার্তা দিতে অনুরোধ করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত সিলেটের বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎসক ড. নজীর আহমদ ইন্তেকাল করলে তিনিই প্রথম আমাকে সংবাদটা জানান। হ্যানিম্যান, হোমিওপ্যাথি এবং হোমিওপ্যাথদের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। তাঁর কথায় কাজে এর প্রমাণ আমি বহুবার পেয়েছি। তিনি অনেক জটিল- কঠিন রোগীর সফল চিকিৎসক। আমার অনেকবার মনে হয়েছে, আমার নিজের ও বউ-বাচ্চার চিকিৎসা তাঁর মতো বিজ্ঞ জনের কাছ থেকে নিতে পারলে ভালো হতো। বলা বাহুল্য, আমি যতদূর জানি, মরহুম ড. নজীর আহমদসহ দেশের অনেক বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎসকের পরিবার-পরিজনের চিকিৎসা বিষয়ে তিনি পরামর্শ দিতেন।

ডা. কবীর আহমদ তাঁর বইসহ কক্সবাজারের অনেকগুলো বই/সংকলন আমাকে আগ্রহ সহকারে পাঠিয়েছেন। আমি সে গুলো যত্ন সহকারে আমার ছেলে বইপ্রেমিক আনিসুল আলম নাহিদ পরিচালিত রাজীব স্মৃতি গ্রন্থাগারে সংরক্ষণ করেছি। আশা করছি, সুদূর কক্সবাজারের এই প্রকাশনাগুলো দীর্ঘদিন আমাদের এখানে সংরক্ষিত থাকবে। এখানকার পাঠকরা ঘাটাঘাটি করবে। ডা. কবীর আহমদের কাছ থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে থেকেও আমি অনুভব করি, তিনি চমৎকার একজন মানুষ। তাঁর আচার-ব্যবহার ও কথাবার্তা অত্যন্ত সুন্দর ও নমনীয়। ধর্মপ্রাণ এ মানুষটির কন্ঠ সেলফোনে আমাকে শ্রদ্ধাবনত করে। পড়ন্ত বয়সেও কথায় কথায় প্রাণখোলা হাসি। অনুজ প্রতীম আমাকে ‘আপনি’ ও ‘ভাই’ সম্বোধন, আগে-ভাগে সালাম প্রদান, গোছানো কথাবার্তা সব মিলিয়ে তিনি অনন্য এক মানুষ। এখনও তিনি কাজে-কর্মে অনেক দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেন। ধারণা করি, বয়সে তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। আফসোস, তাঁর সাথে আরো আগে কেন যোগাযোগ/সম্পর্ক হল না! এমন একজন সর্বগুণে গুণান্বিত মানুষকে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে মূল্যায়ন করা উচিৎ। আশা করব, সংশ্লিষ্ট সবাই বিষয়টি ভেবে দেখবেন। আমাদের ইচ্ছে আছে, আনোয়ারা হোমিও হল-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান আনোয়ারা ফাউন্ডেশন থেকে ভবিষ্যতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে (যেমন- সাহিত্য, সাংবাদিকতা, চিকিৎসা, কৃষি, বিজ্ঞান, সমাজসেবা প্রভৃতি) কিছু পুরস্কার/পদক প্রবর্তন করার। আল্লাহ যদি কোনো দিন তৌফিক দেন এবং আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, তা হলে আমরা সর্বাগ্রে চেষ্টা করব ডা. কবীর আহমদের মতো মানুষদের মূল্যায়ন করার।

মূলত আমার সম্পাদিত “আনোয়ারা”র মাধ্যমে ডা. কবীর আহমদের সাথে আমার যোগাযোগ/সম্পর্ক ছিল। এই গুণী ব্যক্তিত্ব ২১ জুন ২০১৮ অনেকটা পরিণত বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। আনোয়ারা হোমিও হল গ্রন্থাগার ও আর্কাইভে আমার তাঁর জীবনের তথ্য সংরক্ষনের চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে তাঁর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সার্বিক সহযোগিতা বিনীতভাবে কামনা করছি। একই সাথে তাঁর রুহের মাগফিরাতও কামনা করছি।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা- আনোয়ারা হোমিও গ্রন্থাগার ও আর্কাইভ, দেওয়ান বাজার, গহরপুর, বালাগঞ্জ, সিলেট।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!