রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আব্দুর রশীদ লুলু

টলমলো জলে ভাসে হৃদয় পদ্ম



লাইব্রেরী থেকে বেরুবার পথে বকুলের সাথে দেখা। বরাবরের মতোই সালাম ও সৌজন্য বিনিময়। তা-ও হাসিমুখে। হৃদয়টা চিনচিন করে ওঠে। এতো ভালো মেয়ে বকুল!
আপনার ক্লাস আছে?
বকুলের কথায় সম্বিত ফিরে।
না, কেন?
বিব্রত কন্ঠে জবাব দিই আমি।
আমারও ক্লাস নেই। তা আপনার আপত্তি না থাকলে কোথাও বসা যায়। দু’কথা বলা যায়।
বকুলের কথায় আনন্দে লাফিয়ে ওঠে হৃদয়। ইচ্ছে করে তাইরে নাইরে করে নাচি।
তার পরও স্বভাব-সুলভ গাম্ভীর্যে সম্মতি জানিয়ে পা বাড়াই। বকুল আমাকে অনুসরণ করে নিরবে।
আমি ভাবনার সাগরে ডুবে যাই। মাথা ঘোরে যেতে চায়। চোখের সামনে ফুলে ওঠে আমার টানাটানির সংসার। অসুস্থ মা, ভাই-বোন।
স্বাধীনতা দিবসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বকুলের সাথে আলাপ-পরিচয়। আমি আপনি আপনি করি। বকুল বাধা দেয়
– আপনি যখন তিন ইয়ার সিনিয়র তখন এ হয় না।এর পর সাক্ষাত হলে সালাম ও সৌজন্য বিনিময় হয়। প্রথম থেকেই বকুল আমাকে আন্দোলিত করে-দোলায়। ওর মার্জিত ব্যবহার চলাফেরা আমাকে টানতে চায়।

কিন্তু প্রেম-টেম, বিয়ে-টিয়ে- না না, আমি ভাবতে পারিনা। আমার দায়িত্ব বোধ আমার সংসার। তবু এ মুহুর্তে আশা নিরাশায় দুলে ওঠে বুক।
আমি এগিয়ে যেতে চাই ক্যান্টিনের দিকে। বকুল বাধা দেয়। ক্যান্টিনে না। ওই গাছটার নিচে বসি, চলুন।
তথাস্ত। পাশাপাশি বসি দু’জন। মুখে আমার কোন কথা সরে না। তাকিয়ে দেখি, আকাশে এই ভাদ্রের ভরদুপুরে খন্ড কন্ড মেঘ।
এই কলেজের ক্যাম্পাসটা কি সুন্দর, কাব্যিক- রোমান্টিক। তাই না?
শুরু করে বকুল।

হ্যাঁ, এই শহরের ঐতিহ্যবাহী কলেজ এটা।
এমনি টুকটাক কথা চলতে থাকে। হঠাৎ আমার অনেক দিনের লালিত অদম্য ইচ্ছেটা ফুটে ওঠে।
বকুল কিছু মনে করে না। আমার ভীষণ ইচ্ছে করে তোমার সম্পর্কে, তোমার পরিবার সম্পর্কে জানতে। তোমার আপত্তি না থাকলে-
চমকে ওঠে বকুল। ওরকম বলতে পারি, সে বোধ হয় ভাবতে পারেনি।
থাক বকুল, থাক।
তাড়াতাড়ি শুধরিয়ে নিই আমি।
ক্রমশ: সহজ হয়ে আসে বকুল। নির্দ্বিধায় বলে যায় সব।

শহরে খালার ওখানে থেকে পড়ে বকুল। ভাই নেই, পাঁচ বোন, সে-ই বড়। মুক্তিযোদ্ধা বাবা প্যারালাইসসে আক্রান্ত। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত। হতাশাগ্রস্থ। স্বপ্নহীন-আশাহীন। পুর্ব পরুষের রেখে যাওয়া জমিজমা পানির দামে কিনে নিচ্ছে গ্রামের ফজলু। রাজাকার ফজলু। বাবা ওর কাছে বিক্রি করতে নারাজ। কিন্তু উপায়হীন।
বকুলের নিজের সম্পর্কে, পরিবার সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে শুনতে শুনতে আমি একাত্ব হয়ে যাই ওর সাথে। আশ্বর্য, কি সুন্দর মিল আমার সাথে। শুধু আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবা বেঁচে নেই। চুয়াত্তরের আকালে একরাশ: হতাশা বুকে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে।
বুকটা আমার ভারী হয়ে ওঠে। ব্যাথায়-বেদনায়। আমি বাবার প্রথম সন্তান। আমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন-সাধ ছিল বাবার।
বকুলকে আমি ও সব কথা খোলামেলা বলি। বলি বাবার কথা। অসুস্থ মার কথা। ভাই-বোনের কথা। আমার দায়িত্ব বোধ ও স্বপ্নের কথা। ম্যাচের কষ্টকর জীবনের কথা।
চুপচাপ কেটে যায় কিছু সময়। উৎফুল্ল হয়ে ওঠে আমার মন।

বকুল, তুমি আমাকে তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাবে? আমি তাঁর পা ছুয়ে দোয়া নেব। তোমার আপত্তি না থাকলে তাঁকে বাবা বলে ডাকব। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বেড়ে ওঠা নূতন প্রজন্মের কথা, স্বপ্নের কথা, জীবনের কথা, আগামী দিনের কথা বলব। বলব বাবা, আমরা তোমাদের উত্তরসূরীরা আছি; থাকব।
উচ্ছাসিত কন্ঠে কথাগুলো বলে আমি বকুলের দিকে তাকাই। ও আমার চোখে চোখ রাখে।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
আমি জোর দিয়ে বলি।
তারপর ডান হাতটা এগিয়ে দিই ওর দিকে।
পরম নির্ভরতায় বকুল তার হাতটা তুলে দেয় আমার হাতে।
রাতুল ভাই, আপনি খুব ভালো, মহৎ।
অকৃত্রিম ভালোবাসা ও বিশ্বাস ওর কন্ঠে।
আনন্দের ঢেউ খেলে যায় হৃদয়ে হৃদয়ে। আকাশে আর খন্ড খন্ড মেঘের ভেলা নেই। নির্মল-উজ্জল আকাশ।
এর পরও আপনি আপনি করে দূরত্ব রাখা কেন, বকুল?
আমি অনুযোগ করি। এক পলক আমার চোখে চোখ রেখে মাথা নত করে বকুল। শরমে রাঙা হয়ে গেছে মুখ। আঁচলে মুখ ঢেকে ফের মৃদু কন্ঠে বলে তুমি খুউব ভালো, রাতুল।
মাথা আরো নত হয়।
জানি এখনো সময় হয়নি তবুই ইচ্ছে করে, আলতো করে বকুলের রাঙা মুখটা তুলে ধরি। সমগ্র আবেগ-ইচ্ছ্বাস দিয়ে বুকে আঁকড়ে ধরে অনন্ত:কালের জন্য জুড়াই এ তপ্ত বুক।

 

 

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!