শুক্রবার, ১ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

খনা: কৃষি উন্নয়নে এক কিংবদন্তি নারী।। আব্দুর রশীদ লুলু



চার শতকের মতান্তরে চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি থেকে পনের শতকের মাঝামাঝি সময়ের এক বিদ্যুষী মহিলা খনা। তবে খনা তাঁর প্রকৃত নাম নয়। প্রকৃত নাম লীলাবতী। খনা নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। তাঁর বচনে সংরক্ষিত হয়েছে বাংলাদেশ, পশ্চিম বঙ্গ, নেপাল, ভুটান, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা ও বিহারের প্রাচীণতম কৃষি বিজ্ঞান। কৃষি ও কৃষক তথা মানব কল্যাণে ছন্দ-ছড়ায় তিনি অনেক ‘বচন’ রচনা করেছেন। কৃষি ক্ষেত্রে এই একবিংশ শতাব্দীর জয়-জয়কার সময়েও তাঁর বচন অহরহ উচ্চারিত হচ্ছে।

খনার জীবৎকাল থেকে অদ্যাবধি বহুল উচ্চারিত খনার কৃষি বিষয়ক কয়েকটি বচন হলো- ০১. বার মাসে বার ফল, না খেলে যায় রসাতল, ০২. কলা রুয়ে না কেটো পাত/তাতেই কাপড় তাতেই ভাত; ০৩. যদি বর্ষে মাঘের শেষ/ধন্যি রাজার পূণ্যি দেশ; ০৪. মানের গোড়ায় ফেল ছাই/তাতেই মান বাড়বে ভাই, প্রভৃতি।

যতদূর জানা যায়, সিংহলের ভাগ্য বিড়ম্বিত রাজ কন্যা ছিলেন খনা ওরফে লীলাবতী। তাঁর পিতা সিংহল রাজ প্রতিপক্ষের হাতে পরাজিত ও নিহত হলে শিশু লীলাবতী নিজ গুরু আচার্য্য মুঞ্জালসহ বন্দী দিন যাপন করেন শক্র দূর্গে। সেখানেই মুঞ্জালের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন তিনি। জ্যোতিষী মুঞ্জাল তাঁকে সযত্নে গড়ে তুলেন, শিক্ষা দেন জ্যোতিষ শাস্ত্র।

এ সময় একদিন আচার্য্য মুঞ্জাল সাগর তীরে কুড়িয়ে পান এক শিশু। সে শিশু ছিল উজ্জয়িনী (ভারতের মধ্যপ্রদেশের সুপ্রাচীন ও ইতিহাস বিখ্যাত স্থান) জ্যোতিষী বরাহের পুত্র মিহির। জ্যোতিষী বরাহ শিশু পুত্র মিহিরের কুষ্টি বিশ্লেষণ (গণনা) করে পান, তার আয়ু মাত্র বারো দিন। তাই বরাহ পুত্র মিহিরকে জন্মের সাত দিন পর মতান্তরে পাঁচ দিন পর তামার পাত্রে রেখে ভাসিয়ে দেন সাগরে। কিন্তু জ্যোতিষী বরাহের গণনা ভুল ছিল। সাগর তীর থেকে কুড়িয়ে পাওয়া শিশু মিহিরকে আচার্য্য মুঞ্জাল পুত্র স্নেহে লীলাবতীর সাথে লালন পালন করেন এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রে পারদর্শী করে তুলেন।

এক সাথে বেড়ে ওঠা লীলাবতী ও মিহির ক্রমে একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের গভীর সম্পর্ক। গুরু মুঞ্জালের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সূর্য স্বাক্ষী রেখে তারা বিয়ে করেন। এর মাঝে ষোড়শী লীলাবতী গণনা করে জানতে পারেন মিহির উজ্জয়িনীর রাজ জ্যোতিষী বরাহের পুত্র। সময়-সুযোগে লীলাবতী আর মিহির পালিয়ে যান উজ্জায়িনীতে।

লীলাবতী প্রমাণ করেন মিহিরের আয়ু সম্পর্কে শ্বশুর বরাহের গণনা ভুল ছিল। এ সম্পর্কে খনা বলেছেন- “কিসের তিথি কিসের বার/জন্ম নক্ষত্র এ কর সার/ কি কর শ্বশুর মতিহীন/পলকে জীবন বার দিন/নরা গজা বৃষে শয়/তার অর্ধেক বাঁচে হয়/বাইশ বলদা তের ছাগলা/তার অর্ধে বরাহ পাগলা।”

প্রথমে জ্যোতিষী বরাহ পুত্র মিহির ও পুত্র বঁধু লীলাবতীকে সাদরে গ্রহণ করেন। কিন্তু লীলাবতীর অসামান্য প্রতিভা কাল হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমে শ্বশুর বরাহ পুত্র বঁধুর প্রতি ঈর্ষাতুর হয়ে ওঠেন। উজ্জয়িনীতে খনা কৃষি ও কৃষকের কল্যাণে ‘বচন’ রচনা করতে থাকেন। তাঁর বচনে কৃষকদের প্রভুত উন্নতি হতে থাকে এবং কৃষি জনপদে তাঁর বচন মুখে মুখে ফিরতে থাকে। লীলাবতীর নাম-যশ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

কথিত আছে, লীলাবতীর পূর্বাভাসে আসন্ন দূর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পায় উজ্জয়িনী। লীলাবতী তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্বীকৃতি স্বরূপ চার শতকে গুপ্ত রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ সভায় দশম রত্ন হিসেবে স্থান লাভ করেন। কিন্তু ঈর্ষাকাতর শ্বশুর বরাহ পুত্রবঁধুর শ্রেষ্টত্ব কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। বরাহের আদেশে অবশেষে মিহির স্ত্রী লীলাবতীর জিহবা কর্তন করেন, যাতে লীলাবতী আর কোনে ‘বচন’ উচ্চারণ করতে না পারেন। সেই থেকে লীলাবতী হন ‘খনা’ বা ‘জিভ কাটা’।

আরো কথিত আছে, মিহির স্ত্রীর জিভ কর্তন করে লুকিয়ে রাখেন। খাদ্য-দ্রব্য মনে করে টিকটিকি লীলাবতীর সে জিভ খেয়ে ফেলে। সেই থেকে টিকটিকির শব্দে ভূত-ভবিষ্যত প্রকাশ পায় বলেন অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মনে করেন।

খনার জন্ম-মৃত্যু ও সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডে তাঁর জন্ম এবং বিয়ের পর তিনি স্বামী মিহিরের সাথে পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগানায় বসবাস করেন। যা হোক, কৃষি ও কৃষকের জন্য রচিত ‘বচন’ আজও তাঁকে অমর করে রেখেছে এবং ‘বচন’ গুণে তিনি কৃষি ক্ষেত্রে কিংবদন্তি হয়ে আছেন।

তাঁর সম্পর্কে বিশিষ্ট কৃষিবিদ ডঃ কামাল উদ্দীন আহমদ যথার্থই বলেছেন- “প্রাচীন বাঙ্গালার অসাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন জ্ঞানী মহিলা খনা।” লেখক-গবেষক মোঃ ওসমান গণী বলেছেন- “বৈচিত্রময় প্রকৃতির ভিন্নধর্মী প্রকাশের প্রেক্ষিতে শিক্ষণীয় ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কৃষককে পরামর্শ দিয়েছেন খনা।”

তথ্যপঞ্জি ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
০১. আমার দেশ- ১৫ ডিসেম্বর ২০০৭; ০২. খনার বচন: কৃষির কালজয়ী সুবচন- মো: ওসমান গণী, মাসিক কৃষি কথা- অগ্রহায়ণ ১৪১৫; ০৩. মাসিক কৃষিকথা- শ্রাবণ ১৪১৬ এবং ০৪. সাপ্তাহিক কাগজ ৫ এপ্রিল ২০০৯

লেখক: ইসলাম ধর্ম, হোমিওপ্যাথি ও কৃষি বিষয়ক লেখক ও গবেষক।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!