৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশত্যাগ করা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস যেদিন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন, সেই দিন অনুযায়ী গতকাল রবিবার (১ জুন) তার পাঁচ বছর মেয়াদকাল পূর্ণ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গেজেট অনুসারে, ডিএসসিসির মেয়াদকাল ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ফলে নতুন গেজেট না থাকায় বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের মেয়র পদ নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
ইশরাক হোসেনকে শপথ গ্রহণ করানোর দাবিতে তার সমর্থকরা টানা ১৭ দিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে ১৪ দিন ধরে নগর ভবনে তালা লাগিয়ে রেখেছেন তারা। আজ সোমবারও তারা নগর ভবনের সামনে অবস্থান নেন এবং স্পষ্ট করে দেন—ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ালে ভবনের তালা খুলতে দেওয়া হবে না। এই অবস্থায় সংশ্লিষ্ট মহলে তৈরি হয়েছে জটিলতা ও অনিশ্চয়তা।
নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির বৈধ মেয়র ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন এক মাস আগে গেজেট প্রকাশ করলেও, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ১২টি আপত্তি দেখিয়ে এখনো তার শপথের আয়োজন করেনি।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন আইনে মেয়াদ গণনা শুরু হয় প্রথম সভা থেকে, যা তাপস করেছিলেন ২০২০ সালের ২ জুন। সেই হিসাবে ২০২৫ সালের ১ জুন মেয়াদকালের সমাপ্তি ঘটে। এ প্রসঙ্গে ইসির কর্মকর্তারা জানান, যেহেতু নতুন করে গেজেট প্রকাশ হয়নি, বরং পুরনো গেজেটে শুধু নাম প্রতিস্থাপন করা হয়েছে—তাই মেয়াদ গণনার শুরু হবে তাপসের সময় থেকেই।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস ৪ লাখের কিছু বেশি ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন, যেখানে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন পান ২ লাখ ৩৬ হাজার ভোট। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফলাফল বাতিল চেয়ে ৩ মার্চ ২০২০ সালে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ইশরাক। ট্রাইব্যুনাল গত ২৭ মার্চ ইশরাককে বিজয়ী ঘোষণা করতে ইসিকে নির্দেশ দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ এপ্রিল তাপসের নাম বাদ দিয়ে ইশরাকের নাম গেজেটে প্রতিস্থাপন করা হয়।
এই ইস্যুতে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গতকাল রবিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “ইশরাকের বিষয়ে আদালতের কোনো চূড়ান্ত নির্দেশনা এখনো আমরা পাইনি। আদালতের পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনার ভিত্তিতেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো লিখিত কাগজ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে পারছি না।”
এর আগে, গত ২৯ মে ইশরাককে মেয়র হিসেবে ঘোষণার গেজেট স্থগিত চেয়ে করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চাওয়া আবেদন) খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালত বলেন, এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব রয়েছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
আদালতে ইসির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ইয়াসিন খান। লিভ টু আপিলের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন, যাকে সহায়তা করেন জহিরুল ইসলাম মুসা। অন্যদিকে ইশরাকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও আইনজীবী এ কে এম এহসানুর রহমান।
আদেশের পর মোহাম্মদ হোসেন বলেন, “আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়ে আমাদের আবেদন নিষ্পত্তি করেছেন। আশা করি, ইসি এখন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে। না করলে আমরা আবার আইনি পদক্ষেপ নেব।”
তিনি আরও জানান, “হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী, মামলার পক্ষগণ আপিল করতে পারবেন। সময়সীমা অতিক্রম হলেও তা মার্জনা করে আপিল গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। এখন আপিল বিভাগ বলেছে, ইসিকে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। ফলে গেজেটের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ইশরাককে শপথের আর কোনো সুযোগ নেই।”
অন্যদিকে, ইশরাকের আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, “হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে করা লিভ টু আপিলে গেজেট স্থগিত চাওয়া হলেও আপিল বিভাগ তা করেনি। বরং আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, ইসি একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান—তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে। তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আহ্বান সত্ত্বেও ইসি বলেছে, তারা মামলার কোনো পক্ষ নয় এবং আদালতের নির্দেশ অনুযায়ীই গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে তারা আপিল করবে না।”
এর আগে, গত ১৪ মে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মামুনুর রশিদ হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন, যেখানে ইশরাককে শপথ না পড়ানোর নির্দেশনা এবং তার গেজেট স্থগিতের দাবি করা হয়। পাশাপাশি নির্বাচন ট্রাইব্যুনালের বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অনুরোধও রিটে উত্থাপন করা হয়।