শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বোরকা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য যুক্তরাজ্যের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর, ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি



বোরকা বিতর্কে দলীয় তদন্তের মুখ বরিস জনসন। ছবি : ইন্টারনেট

বিতর্ক থেকে কখনো দূরে ছিলেন না যুক্তরাজ্যের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। বার বার নানা বিরূপ মন্তব্যে জনগণের মনযোগ আকর্ষণের নজির রয়েছে এই রাজনীতিকের। কিছুদিন আগে টোরি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর অনেকটা আলোচনার বাইরে ছিলেন বরিস। সম্প্রতি মুসলিম নারীদের বোরকায় ‘লেটার বক্স ও ব্যাংক ডাকাত’ এর মতো লাগে মন্তব্য করে ব্রিটিশ রাজনীতিতে গরম পানি ঢেলেছেন।

ডেইলি টেলিগ্রাফে লেখা একটি কলামে এ বিরূপ মন্তব্য করেন বরিস। এরপর থেকে চারিদিক থেকে তাঁর এ বিদ্বেষপ্রসূত ঠোঁটকাটা মন্তব্যের প্রতিবাদ ও নিন্দা অব্যাহতভাবে চলছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে বরিস জনসনের বিতর্কিত মন্তব্যকে একটি অপরাধ আখ্যা দিয়ে এর জন্যে তাকে ক্ষমা চাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। প্রথমে কনজাভেটিভ পার্টির চেয়ারম্যান ব্রাণ্ডন লুইসের পক্ষ থেকে মন্তব্যের জন্য জনসনকে ক্ষমা চাওয়ার দাবী উত্থাপিত হয়। প্রধানমন্ত্রী পার্টি চেয়ারম্যানের দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, মানুষ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বরিস এমন কিছু পরিভাষা ব্যবহার করে থাকেন যা সুস্পষ্টরূপে অবমাননাকর তাই আমি ব্রাণ্ডন লুইসের সাথে একমত। উদ্ভুত কঠিন সমস্যা ও বিতর্ক বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ইউরোপ ভ্রমণে থাকা বরিস জনসনকে বার বার টুইটারের মাধ্যমে ক্ষমা চাওয়ার আদেশ প্রদান করেন পার্টি চেয়ারম্যান। এমন কি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীসহ দলের বহু নেতাকর্মী বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য বরিসকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানালেও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ক্ষমা চাইবেন না। বরিস জনসনের একটি ঘনিষ্টসূত্রে জানিয়েছে, বরিস এবিষয়ে ক্ষমা চাইবেন না এবং তাঁর মতামতকে আক্রমণ করার বিষয়টি হাস্যকর বলে দাবী করেছেন তিনি।

এদিকে, বরিস জনসনের বোরকা বিষয়ক কটাক্ষে সমালোচনা ক্রমশঃ বাড়ছে। নিজ পার্টি টোরি, বিরোধী দল লেবার বিভিন্ন এমপি এবং মুসলিম গ্রুপের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন বরিস। তাদের অনেকের অভিমত, ভবিষ্যত লিডারশীপ দৌড়ে পার্টির ডানপন্থী মেম্বারদের সমর্থন করায়াত্ত করতেই তিনি এ কৌশল গ্রহণ করেছেন। ডোনাব্ব ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা স্টিভ ব্যাননের সাথে মিটিংয়ের পর ব্যাপক সমালোচিত হন তিনি। এছাড়া অনেকে মনে করছেন, চরম জাতীয়বাদী ও কট্টর ডানপন্থীদের কাছে নিজেকে জনপ্রিয় করে তুলতেই আমেরিকান প্রেসিডেণ্ট ডোনাব্ব ট্রাম্পের বিতর্কিত পথে এগুচ্ছেন বরিস।

ব্রিটিশ পার্লামেণ্টের প্রথম ব্রিটিশ-বাংলাদেশী এমপি রুশনারা আলী বোরকা নিয়ে বরিস জনসনের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, তাঁর এ মন্তব্য মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে। তিনি আরো বলেন, মহিলারা কী পরিধান করবে তা বাছাই করার অধিকার একমাত্র মহিলাদের। তাদের এ অধিকার রক্ষার ব্যাপারে আমি আপোসহীন। মুসলিম মহিলাদের যারা হিজাব, বোরকা, নেকাব পরতে চান এবং যারা পরতে চনা না তাদের সকলের পোশাক বাছাইয়ের অধিকার এর মধ্যে শামিল।

বরিস পার্টির লিডার হলে পার্টিই ছেড়ে দেবেন বলে হুশিয়ারি প্রদান করেছেন সাবেক এটর্নি জেনারেল ডমিনিক গ্রীভ। এছাড়া রেডিও ফোর এর সাথে দেয়া সাক্ষাৎকারে বরিসের আচরণ ‘খুব বিব্রতকর’ ছিলো বলেও মন্তব্য করেন গ্রীভ।
বরিস সুপার হিউম্যান নন মন্তব্য করে কনজারভেটিভ মুসলিম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড শেইখ তাঁর কাছ থেকে সব ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার জন্যে পার্টির প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

আর সাবেক টোরি মহিলা চেয়ারম্যান ব্যরোনেস সাঈদা ওয়ার্সি বলেছেন, বরিসের মন্তব্য হেইট ক্রাইমকে উসকে দেবে। ওয়ার্সি আরো বলেন, আমি মনে করি বরিস আবার লিডারশীপের লড়াইয়ে অংশ নেবেন এবং তাতে সফল হওয়ার জন্যে তিনি যা যা প্রয়োজন তা-ই করবেন, যা তিনি সচরাচর করে থাকেন। তবে তিনি বলেন, আমি আন্তরিকভাবে আশা করি যে, তাঁর পোল রেইটিং বাড়াতে তিনি সুবিধাজন রাজনৈতিক ফুটবল হিসেবে মুসলিম মহিলাদের অবিরত ব্যবহার থেকে বিরত থাকবেন।

এণ্টি মুসলিম অ্যাটাক পরিসংখ্যানকারী সংস্থা টেল মামার প্রতিষ্ঠাতা ফাইয়্যাজ মুঘল বলেছেন, বরিসের মন্তব্য ইসলামোফবিয়া হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হবে। তিনি আরো বলেন, এধরনের বক্তব্য আমরা আগে চরমপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক হতে দেখেছি, যারা মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে তা করে আসছে। অতএব এটা স্পষ্টতই একই বন্ধনীর মধ্যে পড়ে।
শ্যাডো ইক্যুয়ালিটির মিনিস্টার নাজ শাহ বলেছেন, বরিস জনসনের মন্তব্য শুধুমাত্র আক্রমণাত“কই ছিলো না, ইসলামোফবিক ছিলো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা অস্বীকার করে যাচ্ছেন। নাজ শাহ বলেন, আর এজন্যে অ্যাপোলজিই যথেষ্ট নয়। প্রধানমন্ত্রীর উচিত তাঁর পার্টির ভেতরকার ইসলামোফবিয়া খুঁজে পেতে স্বতন্ত্র তদন্তের নির্দেশ প্রদান করা। এই শ্যাডো মিনিস্টার কনজারবেটিভ পার্টির চেয়ারম্যান বরাবরে একটি চিঠি লিখেও বরিস জনসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান। নাজ শাহ তাঁর পত্রে উল্লেখ করেন যে, বরিস যেভাবে তাঁর নির্বাচনী এলাকার মহিলাদের বোরকা খোলার আশা প্রকাশ করেছেন যাতে তিনি সঠিকভাবে কথা বলতে পারেন – এটা শুধু চরম অবমাননাকর ও ইসলামোফবিকই নয়, এটা সেকশন ২৯ (২) এর (এ) এর ইক্যুয়ালিটি এক্ট-২০১০ এর বেআইনীও।

লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস ব্রেক্সিট নিয়ে দলীয় বৃত্তের ভেতরে-বাইরে নানা নাটকীয়তা আর বিতর্ক জন্ম দেওয়ার এক পর্যায়ে মন্ত্রীসভা থেক পদত্যাগ করেন। এরপর থেকেই তিনি আলোচনার বাইরে। গত ৬ আগস্ট, সোমবার বোরকা নিয়ে বিদ্বেষী মন্তব্য করে নতুন করে আলোচনায় আসেন তিনি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফে লেখা এক নিবন্ধে মুসলিম নারীদের বোরকা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, এতে তাদের লেটার বক্স ও ব্যাংক ডাকাতের মতো দেখায়। আর শিক্ষার্থীদের প্রতি তা খুলে ফেলার জন্য বলার অধিকার থাকা উচিত স্কুল ও ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের। তাঁর নির্বাচনী এলাকার সার্জারিতে কেউ বোরকা পরে এলে তা খুলে তিনি ফেলবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন বরিস।
ওই মন্তব্যের পর বিভিন্ন মুসলিম গ্রুপ, কয়েকজন কনজারভেটিভ এমপি এবং বিরোধী দলগুলোর সমালোচনার মুখে পড়েছেন লণ্ডনের এই সাবেক মেয়র। তবে বরিসের মন্তব্য প্রসঙ্গে ফরেন অফিস মিনিস্টার অ্যালিস্টার বার্ট বলেছেন, সরকার পোশাকের বিষয়ে কোনও বিধিনিষেধ আরোপ করবে না। বার্টের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে কনজারভেটিভ পার্টির চেয়ারম্যান ব্রাণ্ডন লুইস টুইটারে বরিস জনসনকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান। তবে টেলিগ্রাফের ওই নিবন্ধে বরিস বোরকা নিষিদ্ধ করার কথা না বললেও একে হাস্যকর হিসেবে উপস্থাপন করেন। এরপর থেকেই বরিস পার্টিসহ সর্বমহলের সমালোচনার মুখে পড়েন।

এদিকে, বোরকা নিয়ে মন্তব্য করে বরিস জনসন কনজারভেটিভ পার্টির আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন কিনা, সেটিই খতিয়ে দেখা হবে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন দলীয় এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বতন্ত্র একটি প্যানেল এ অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখবে।

তবে দলের ঐ মুখপাত্র তদন্তের বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে চাননি। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আচরণবিধির প্রক্রিয়াটি খুবই গোপনীয়। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে জনসন দল থেকে বহিষ্কারের মুখেও পড়তে পারেন।

তাছাড়া কনজারভেটিভ পার্টির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, দলীয় তদন্তে জনসন আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন প্রমাণিত হলে চূড়ান্ত ব্যবস্থা হিসেবে দলে তার সদস্যপদ স্থগিত করাসহ তাকে দল থেকে বের করেও দেয়া হতে পারে।

 

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!