শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের অজুহাত

পেঁয়াজের কেজি ছাড়াল ১২০ টাকা : প্রতিযোগিতা করে দাম বাড়িয়ে চলেছেন ব্যবসায়ীরা



পেঁয়াজের বাজারে চলছে রীতিমতো নৈরাজ্য। বাংলাদেশে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানো অব্যাহত রেখেছেন।

সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি থাকায় এর অপব্যবহার করছেন সুযোগসন্ধানী কিছু ব্যবসায়ী। বলা চলে, যেন প্রতিযোগিতা করে দাম বাড়িয়ে চলেছেন তাঁরা। এ অভিযোগ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ক্যাবের পক্ষ থেকেও। অন্যদিকে বাজারে নেই সরকারের কার্যকর নজরদারি। সরকারি সংস্থা টিসিবির খোলাবাজার পদক্ষেপও কমাতে পারছে না পেঁয়াজের উত্তাপ। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, তারা পেঁয়াজের এ দামের নৈরাজ্য ঠেকাতে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করেছে। অন্তত দুই হাজার বিক্রেতাকে শাস্তি দিয়েছে তারা। কিন্তু এর পরও মিলছে না সুফল। অতিরিক্ত দামে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ভোক্তাসাধারণ।

গতকাল শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, কেজিপ্রতি পেঁয়াজের জন্য গুনতে হচ্ছে ১২০ টাকা পর্যন্ত, যা এক দিন আগেও ছিল ১১০ টাকা। অর্থাৎ এক দিনের ব্যবধানে কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। দেশি বা আমদানি—সব ধরনের পেঁয়াজের দামেই ঊর্ধ্বগতি। গত এক মাসের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ১২০ টাকায় উঠল পেঁয়াজের দাম।

ব্যবসায়ীদের দাবি, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকার কারণে পেঁয়াজের দাম না কমে বাড়ছে। অথচ পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ পর্যাপ্ত। কিছু খুচরা বিক্রেতা বেশি দামের কারণে পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ রাখার কথা জানালেও অনেক খুচরা বিক্রেতাই বলছেন, পাইকারি বাজার থেকে চাহিদা অনুযায়ী পেঁয়াজ পাচ্ছেন তাঁরা।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের ভেতরে বেগুনবাড়ী কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ওই বাজারে চারজন বিক্রেতা। তাঁদের মধ্যে দুজনের কাছে পেঁয়াজ আছে। অন্য দুজন পেঁয়াজ বিক্রি করছেন না। তাঁদের একজন জানান, ‘দাম বেশি, কাস্টমার চেঁচামেচি করে। হেইল্লাইগা বেচাই বাদ দিছি। ’

পেঁয়াজ বিক্রি করছেন এমন একজন বিক্রেতা সুমন মিয়া। তিনি বলেন, ‘পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের অভাব নাই। দামটা বেশি, এটাই সমস্যা। ’

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, দেশি, ভারতীয়, মিসর ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। মেসার্স মাতৃভাণ্ডার ৫৬ নম্বর আড়তের মূল্যতালিকায় দেখা গেল, দেশি পেঁয়াজ ১০৮ টাকা, ভারতীয় পেঁয়াজ ১১৫ টাকা, মিসরের পেঁয়াজ ১০০-১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পেঁয়াজের দাম কেন কমছে না জানতে চাইলে আড়তের বিক্রেতা লোকমান হোসেন দাবি করে বলেন, ‘পেঁয়াজ আমদানি কমে গেছে। দেশি পেঁয়াজের মজুদও কম। সব মিলিয়ে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। যে কারণে দাম বাড়তি। ’

অন্য এক আড়তদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বাজারে যাঁরা প্রভাব বিস্তার করছেন, তাঁরা অনেক বড় ব্যবসায়ী। তাঁদের ধরা উচিত। আমরা তো চুনোপুঁটি। দাম কমা বা বাড়াটা তাঁদের ওপরই নির্ভর করে। ’

শ্যামবাজারের আমদানিকারকরা বলছেন, আগে দিনে ভারত থেকে সাড়ে ছয় হাজার টন পেঁয়াজ আসত। এখন সেখানে মিয়ানমার থেকে দিনে ২৫০-৩০০ টন পেঁয়াজ আসছে। অন্যান্য দেশ থেকে আরো কিছু পেঁয়াজ আসছে। তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়।

টেকনাফ স্থলবন্দর শুল্ক বিভাগ জানায়, গেল ২৬ দিনে মিয়ানমার থেকে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। আমদানির এ হার আগের চেয়ে বাড়ছে।

পেঁয়াজের আমদানিকারক ও শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. মাজেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যত কথাই বলি, ভারতের পেঁয়াজ আমদানি শুরু না হলে দাম কমবে না। কারণ আমরা অন্যান্য দেশ থেকে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ পাচ্ছি না। আবার আমদানিও করতে হচ্ছে চড়া দামে। ’

তবে এই বিক্রেতা স্বীকার করলেন, বাজারে কিছু সমস্যা হচ্ছে। যেমন—মিসরের পেঁয়াজ আমদানিকারকরা ৮০-৮২ টাকার মধ্যে বিক্রি করছেন। সেটা খুচরা বাজারে ৯০ টাকা থাকার কথা। তবে এ পেঁয়াজও ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৯০-৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে আড়তে। সেটা খুচরায় ১০০-১০৫ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এটিও ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অস্থিরতার বাজারে এ সুবিধা বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা নিচ্ছেন বলে কালের কণ্ঠ’র কাছে স্বীকার করেছেন হাজি মো. মাজেদ।

পেঁয়াজের বাজারের এ অস্থিরতার শুরু হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসের ২৯ তারিখে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার মধ্য দিয়ে। সে সময় রাতারাতি পেঁয়াজের দাম কেজি ১৩০ টাকায় উঠেছিল। কিন্তু এটি আবার কমে ৭০-৯০ টাকার মধ্যে আসে। কিন্তু তা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দ্রুতই আবার ১০০ টাকা, পরের ধাপে ১১০ টাকা এবং সব শেষে গতকাল ১২০ টাকায় উঠে আসে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করা হলেও দাম বাড়ার নৈরাজ্য আর ঠেকানো যাচ্ছে না।

ভোক্তাদের দাবি, বিক্রেতারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। কারণ বাজারে গেলে পেঁয়াজের ঘাটতি দেখা যায় না। দাম যখন বেড়ে যায় তখনই সব দোকানদার একসঙ্গে বাড়ায়। এটা সম্ভব তখনই, যখন বিক্রেতারা একজোট থাকে।

গুলশান গুদারাঘাটে বাজার করার সময় বিক্রেতা হাবিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব ব্যবসায়ীই এখন একজোট হয়ে ফায়দা তুলছেন। দাম বাড়ার গন্ধ পেলেও তাঁরা সবাই একসঙ্গে, সমান হারে দাম বাড়িয়ে দেন। ’

আরেক ক্রেতা আরিফ হোসেন বলেন, ‘বাজারে সরকারের নজরদারি নেই বললেই চলে। নজরদারি হলে অন্তত দিনে দিনে দাম বাড়তে পারে না। ’

এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) খোলাবাজারে ৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। কিন্তু তাতেও বাজারে কোনো প্রভাব পড়ছে না। প্রতিষ্ঠানটি এখন ঢাকার ৩৫টি স্থানে ট্রাকে করে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। প্রতিটি ট্রাকে প্রতিদিন এক হাজার কেজি করে পেঁয়াজ বিক্রির জন্য দেওয়া হচ্ছে বলে জানান টিসিবির তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার চেম্বারের সভাপতি এস এম নূরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পাশাপাশি পেঁয়াজের চাহিদা বেড়েছে চীন এবং মিয়ানমারেও। আর যোগাযোগব্যবস্থার সহজলভ্যতায় বাংলাদেশের চেয়ে চীনেই বেশি পেঁয়াজ চলে যাচ্ছে। তাই মিয়ানমারের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি জানান, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে ভারতে নতুন পেঁয়াজ উঠবে। তখন দাম কমে আসবে। ’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. জাফর উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই বাজারে যেকোনো পণ্যের দাম বাড়ে। গত দুই দিনে পেঁয়াজের বাজারের ঊর্ধ্বগতিও বৃষ্টির কারণে। ’ নজরদারির অভাব রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত বাজার নজরদারি করছি। তবে নজরদারিতেও ফল আসছে না। গত এক মাসে দুই হাজার ব্যবসায়ীকে প্রায় দুই কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে; কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। ’ আগামী নভেম্বরে নতুন পেঁয়াজ এলে বাজার স্বাভাবিক হবে বলে জানান তিনি।

 

 

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!