দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দেরিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয় বাংলাদেশে। সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রস্তুতির জন্য বেশি সময়ও পাওয়া গেছে। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বলছে, কম সময়ে বাংলাদেশেই তুলনামূলক সংক্রমণ ছড়িয়েছে বেশি।
দেশে এখন পর্যন্ত দুই লাখের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও মোট জনসংখ্যার বিবেচনায় ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে আক্রান্তের হার বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য দেশের তুলনায় পরীক্ষা কম হলেও সংক্রমণ শনাক্তের হারও বেশি।
করোনা মহামারির শুরু থেকে সংক্রমণ কমাতে পরীক্ষা, আইসোলেশন (আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন রাখা), কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং (আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসাদের চিহ্নিত করা) এবং লকডাউনের (অবরুদ্ধ) ওপর জোর দিয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে শুরু থেকেই সংক্রমণ প্রতিরোধের কার্যক্রম খুব দুর্বল। এখনো সে দুর্বলতা কাটেনি। কাজে শৃঙ্খলা ও সমন্বয় নেই। মধ্যে পরীক্ষা বাড়ানো হয়েছিল, এখন সেটা আবার কমে যাচ্ছে। আইসোলেশন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং—এসব হচ্ছে না বলা চলে। সব দিকে একটা গা–ছাড়া ভাব, এ কারণেই দেশে সংক্রমণের তীব্রতা বেশি হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার চিত্র
এখন দক্ষিণ এশিয়ায় সংক্রমণ বেশি। দেশে সংক্রমণের ১৩৩তম দিনে এসে গতকাল শনিবার করোনাভাইরাসের নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৬৬। এর মধ্যে ২ হাজার ৫৮১ জন মারা গেছেন। আর সুস্থ হয়েছেন ১ লাখ ১০ হাজার ৯৮ জন।
এই দুই লাখের বাইরে আরও কত মানুষ এখন আক্রান্ত হয়ে আছেন, প্রয়োজনের চেয়ে পরীক্ষা কম হওয়ায় সেটা অনুমান করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের মোট জনসংখ্যার বিচারে গতকাল পর্যন্ত দেশে আক্রান্তের হার প্রতি ১০ লাখে ১ হাজার ২৩৯।
ভারত ও পাকিস্তানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়েছে, পাকিস্তানে আক্রান্ত আড়াই লাখের বেশি মানুষ। তবে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে দেশে আক্রান্তের হার ভারতের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। পাকিস্তানের চেয়েও বেশি।
দেশে শনাক্তের ৭৬% ‘লকডাউন’ তোলার পরে
বিশ্বে প্রথম চীনের উহানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার তিন মাস পর গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্তের কথা জানানো হয়। সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। যোগাযোগব্যবস্থা, ব্যবসা, বাণিজ্য, কলকারখানা সব বন্ধ করে অনেকটা লকডাউন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। অবশ্য ক্রমে সেটা ঢিলেঢালা হয়েছে। আর বেড়েছে সংক্রমণ। ৩১ মে থেকে ছুটি পুরোপুরি তুলে দেওয়া হয়। লকডাউন পরিস্থিতি পুরোপুরি উঠে যাওয়ার পর থেকে সংক্রমণ আরও বেড়েছে।
৩১ মে পর্যন্ত সংক্রমণের ৮৫ দিনে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজারের কিছু বেশি। লকডাউন তুলে দেওয়ার পরের ৪৮ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ। অর্থাৎ গতকাল পর্যন্ত মোট আক্রান্তের ৭৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়েছে লকডাউন তুলে দেওয়ার পরে।
অবশ্য জুলাইয়ের শুরু থেকে নিয়ন্ত্রণ আরোপের ফলে পরীক্ষার সংখ্যা কমে গেছে। এতে নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যা কমছে। তবে শনাক্তের হার কমছে না, বরং বাড়ছে। গতকাল নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা জানান, শুক্রবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০ হাজার ৯২৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ৭০৯ জনের দেহে সংক্রমণ পাওয়া যায়। শনাক্তের হার ২৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। এই সময়ে মারা গেছেন ৩৪ জন।
নাসিমা সুলতানা বলেন, কিছুদিন ধরে নমুনা পরীক্ষা কম হচ্ছে বলে অনেকে প্রশ্ন করছেন। যাঁদের নমুনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তাঁরা যেন অবশ্যই বুথে বা হাসপাতালে গিয়ে নমুনা জমা দেন এবং পরীক্ষা করান।
শুরু থেকে দেশে আইসোলেশন ও কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং খুব দুর্বল। এখন সেটা আরও নাজুক হয়েছে। সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির সবাইকে আইসোলেশনে থাকতে হয়। কিন্তু দেশে সেটা কতটুকু হচ্ছে, এটা নিশ্চিত করার মতো জনবল আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দেশে মোট আক্রান্ত ব্যক্তির প্রায় ৩৬ শতাংশের এলাকাভিত্তিক তথ্যই নেই।
হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন ১০ শতাংশের কম রোগী। বেশির ভাগ আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিন হচ্ছে নিজ নিজ বাসায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যথাযথভাবে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের নিয়ম মানছেন কি না, সেটাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদারক করা হয় না। একটি বড় অংশের মানুষের পক্ষে বাড়িতে একা একটি কক্ষে থাকা বা নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রাখার মতো অবস্থাও নেই। ফলে এটি খুব বেশি কার্যকর হচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার এলাকাভিত্তিক লকডাউন করার সিদ্ধান্ত ও কৌশলপত্রও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সংক্রমণ যখন বাড়ছে, তখন মহামারি মোকাবিলায় স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে।