বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

হাবীব নূহ

টার্কি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে!



হাবিব নূহ, লেখক

যুক্তরাষ্ট্রের গত ১২০ বছরের ইতিহাসে এবার সবচেয়ে বেশী মার্কিনী ভোট দিয়েছেন। জানা গেছে,  এবার প্রায় ১৫ কোটি মার্কিনী ভোট দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ পর্যন্ত যত প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদে লড়েছেন তাদের সবার চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন এবারের দুই মূল প্রতিযোগী। প্রায় আট লাখ ভোটের ব্যবধানে হালফিল নতুন আরেকজন নির্বাচিত হলেও, বর্তমান তিনিও প্রায় সাত কোটি ভোট লাভে ধন্য হয়েছেন, যা কম নয়। এত বিপুল মানুষের রায়কে সম্মান জানিয়ে হালের প্রেসিডেন্টকে শুধু নাম ধরে না ডেকে বরং নামের আগে মিস্টার লাগানো অথবা মি. প্রেসিডন্ট বলা শোভনীয় মনে করি।
এ নিবন্ধ  মি. প্রেসিডন্টের একটি সংবাদের পটভূমিকায় বিন্যাস করার প্রয়াস করা হয়েছে।
১.
T.U.R.K.E.Y দিয়ে গঠিত Turkey একটি দেশ। যাকে বাংলায় তুরস্ক বলে। তুরস্ক প্রজাতন্ত্র। এশিয়ার ভিতরে দেশটি। পশ্চিম এশিয়ার একটি রাষ্ট্র। তবে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, বলকান উপদ্বীপ হয়ে অল্প কিছু আয়তন নিয়ে তুরস্ক ইউরোপের ভিতর ঢুকে গেছে এবং ইউরোপের সঙ্গমস্থলে অবস্থান করছে। মোটামুটি চতুর্ভুজাকৃতির দেশ। আঙ্কারা দেশটির রাজধানী। ইস্তানবুল দেশটির একটি বড় শহর। অধিকাংশ লোক মুসলিমীন। সরকারি ভাষা তুর্কি। আবার,T.U.R.K.E.Y দিয় গঠিত Turkey (টার্কি)একটি পাখি। আমার,আজকের এ লিখার উপজীব্য ঐ পাখি।

তবে এখানে রহস্য আছে। দেশ টার্কির নামেই পাখি টার্কির নাম করা হয়েছে। ইউরোপীয়রা যখন প্রথমবার টার্কিকে আমেরিকায় দেখতে পেল, তখন তারা ভুলবশতঃ পাখিটিকে এক ধরনের গিনিয়া মুরগি (নুমিডা মেলিয়াগ্রিস) ভাবতে লাগলো। পরবর্তী সময়ে তারা তুরস্ক থেকে মধ্য ইউরোপে পাখিটি নিয়ে আসে। গিনিয়া মুরগি বা গিনিয়াফাউল-কে টার্কি ফাউল নামেও ডাকা হয়। তাই উত্তর আমেরিকার এ পাখিটি তুরস্কের নামানুসারে নামকরণ করা হয় টার্কি।
২.
আমি টার্কি পাখির কিছু পরিচয় দেই। বিশ্বের প্রায় সর্বত্র এই টার্কি গৃহপালিত পাখিরূপে লালন-পালন করা হয়। একে টার্কি মোরগ বা মুরগি ও বলা হয়।ইংরেজিতে Turkey বলে। এক ধরনের বড় আকৃতির পাখিবিশেষ। পোষা ও বুনো দু’ধরণের আছে। তাদের সাধারণ ও পরিচিত নাম যেমন আছে তেমনি বৈজ্ঞানিক নাম আছে। তিতির পাখির মত। কিছু পাখি টার্কি নামে থাকলেও টার্কি নয়। টার্কি ডিম থেকে ফোটে।

এই টার্কি পাখিদেরও একটি জগত আছে। গোত্র বা পরিবার আছে। উপ পরিবার আছে। জীববিজ্ঞানে শ্রেণীবিন্যাসের ধাপগুলোর ধারায়, তাদের – অধিজগৎ, জগৎ, পর্ব, শ্রেণী, বর্গ, পরিবার, গণ ও প্রজাতি, সব কিছুই হয়ত আছে। এবং তাদের বিভিন্ন রূপ ও আকৃতি আছে।

মধ্য জুন, ২০১৭ সালের এক সংবাদ থেকে জানতে পারি যে অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানীরা—ক্যাঙ্গারুর মত বড় আকারের একটি ধূসর টার্কি, যা আধুনিক ম্যালিফাউল টার্কির একটি প্রাচীন কাজিন, এবং মেগাপোড টার্কি পাখির বিলুপ্তপ্রায় একটি প্রজাতির সন্ধান পেয়ে প্রচার করছিলেন,যাকে তাঁরা ‘জায়ান্ট উড়ন্ত টার্কি’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। [ইয়া আল্লাহ! তোঁমাকে চিনা ও জানার নিমিত্তে,কত বিচিত্র সব উপাদান দিয়ে এ বসুন্ধরাকে তুমি সাজিয়েছো,আমি তো তার অল্পই যেন উপলব্ধি করছি অথবা করছি না,আমাকে ক্ষমা করে দিও—তোমার এই দোষ-মার্জনাই তো আমার ভরসা,আমার আস্থা।]

ইয়েস, স্ত্রী টার্কির তুলনায় পুরুষ টার্কি অধিকতর বড় এবং অনেক বেশি আকর্ষণীয় রঙের হয়ে থাকে। এই শেষের তথ্যটি আরেক বিচিত্র শোভা। তবে পূর্ণাঙ্গ পুরুষ টার্কির মাথা ন্যাড়া থাকে। সাধারণতঃ উজ্জ্বল লাল রঙের মাথা হয়। কখনো আবার সাদা কিংবা উজ্জ্বল নীলাভ রঙেরও হয়ে থাকে। গবলার বা টম নামেও পুরুষ টার্কি পরিচিত।

জীববিজ্ঞানীদের মাঝে টার্কি নিয়ে কিছু ইখতিলাফও আছে। অর্থাৎ মত বিরোধিতা আছে, থাকতেই পারে। ইখতিলাফ নিয়ে আমি অহেতুক কিছুই লিখছি না।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আজকের সময়ে শ্রেষ্ঠ আলোচিত শব্দ ও বিষয় যেন ‘ইখতিলাফ’। অপব্যবহারের কারণে স্বয়ং এ শব্দটিই শ্রেষ্ঠ মাজলুমে পরিণত হয়েছে। এই ‘ইখতিলাফ’ শুনতে বা বলতে এখনকার দিনে কখনো কখনো দিল ও দেহ দুর্বহ তমসাচ্ছন্ন হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হযশীঘ্র যেন এমন কাল ধেয়ে আসছে যে আমার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ, একে অন্যের সাথে অহরহ ইখতিলাফ করতে থাকবে। তখন আমি কিছু লিখতে যাব, হাত কিন্তু ইখতিলাফ করে লিখে দিবে অন্য কিছু।so on.সো অন।

তারও কিছু যুগ পর হয়ত এমন হবে,  প্রতিটি পরিবারের প্রতিজন ছোট বড় সদস্য যেন একেকটি ছোট ছোট দলে পরিণত হবে। দলের সভাপতি, মহাসচিব সবই থাকবে। যেমন, ‘মাথা’ হবে মহাসচিব। চেহারা হবে সভাপতি, হাত হবে সম্পাদক, আঙ্গুল হবে যুগ্ম-সম্পাদক, পা হবে প্রচার সম্পাদক।so on.সো অন।অতপর পরিবারের মধ্যেই, দুই বা তিন দল মিলে ঐক্যের নাটক করবে। জোট হবে এবং এক সময় মহা-ঐক্য, মহা জোট, সব হবে। তবুও ভাঙ্গা কাঁচ জোড়া লাগানোর মত এ ঐক্যের জোড় সে সময়ের জন্য হবে মহা-পূণ্য। এবং তারও কিছু কাল পর কোন কোন দেশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা যেন একেকটি দেশে গণ্য হবে ইখতিলাফের ভিত্তিতে। আজকের দেশ, তখনকার সময়ের অজস্র দেশ নিয়ে হবে একেকটি মহাদেশ। আর এ দেশগুলোকে সামাল দিতে আজকের জাতিসংঘকে তখন প্রতি মহল্লায় একেকটি অফিস খুলতে হবে। পৃথিবী তখন এত বিপুল অফিসের ভারে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে।
(কল্পনা থেকে ফিরে আসি…)
৩.
Thanksgiving Day. থ্যাঙ্কসগিভিং ডে। ধন্যবাদ জ্ঞাপন দিবস। ঐতিহ্যের এই দিন আমেরিকাতে প্রতিবছর নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার পালিত হয়ে আসছে। প্রায় চার শতাব্দীর গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে দিনটি উদযাপনের। আগামী বছর হয়ত চারশত বৎসর পূর্ণ হবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসাহ, উদ্দীপনার সাথে সম্পাদন করা হয় দিনটি। প্রথাগত রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্টান এবং রীতি-রেওয়াজও নির্বাহ করা হয় এই সময়। দিনটি নভেম্বরের চতুর্থ বা শেষ বৃহস্পতি হলেও সপ্তাহ অবধি চলে আয়োজন। যার শুরু হয়ত ২২ নভেম্বর থেকে হয়। দিনটির সৃজন হয়, ১৬২১ সালে।

একদল ইউরোপীয়ান, যারা ‘পিলগ্রিমস’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল, স্থানীয় নেটিভ আমেরিকানদেরে তাদের একটি বড় ভোজের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানায়। এই নিমন্ত্রণের হেতু ছিল ধন্যবাদ জানানো। কারণ, পিলগ্রিমরা খাদ্য সমস্যায় নিপতিত ছিল, তখন আদি আমেরিকানরা তাদেরকে সফলভাবে ফসল ফলানো শিখায়, ফলে তাদের সঙ্কট কেটে গিয়ে তারা লাভবান হতে থাকে।

সে দিনের সেই স্বল্প অবয়বের যোগাড়, আজকের এই বিশাল পরিসরে বিস্তার—নিখাদ কৃতজ্ঞতা স্বীকারের, পার্থিব সুশোভিত প্রকৃতি। আমেরিকার আদি গোষ্ঠীর সাথে, প্রধানত ইংল্যাণ্ড থেকে আসা যাজকদের এই সম্মিলিত আহার্যের সৌন্দর্য ও মাধুর্য, পরবর্তী সময়ে পরস্পরের মধ্যে উৎপাদিত শষ্য এবং পণ্য বিনিময়ের মধ্য দিয়ে ‘থ্যাংকস গিভিং’-এর এই উৎসবটি ভোজনের অর্জনকে পোষণ করে চালু হয়ে যায় আমেরিকা জুড়ে। এ ধারাবাহিকতায় ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন সেই সাম্য, ঐক্য, মৈত্র্য সৌহার্দ্যের শোভন অবলম্বনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে রাষ্ট্রীয় ভাবে এই দিনটিকে ‘থ্যাংকস গিভিং হলি ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেন। আজকের সময়ের পরিতাপ হল— উৎসবের মৌল বোধ উপেক্ষিত ও অবহেলিত থাকে আর খোলস-লৌকিকতার মহোৎসব চলে।
৪.
এই টার্কি পাখির খুবই কদর হয় থ্যাংকস গিভিং ডে-তে। যেমন হয় ক্রিসমাসের সময়। এ সময়ে টার্কি খাওয়া একটি ট্রেডিশন ও ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।কারণ মনে করা হয় যে, পিলগ্রিমরা সম্ভবত থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের উৎসবের সময় টার্কি খেয়েছিল। ধনী-গরিব সবাই মেতে উঠে ঐতিহ্যবাহী টার্কি ভোজে। পারিবারিকভাবে যেন প্রতিটি ঘরেই চলে টার্কি লাঞ্চ আর টার্কি ডিনার। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবেও চলে টার্কি ভক্ষণের আয়োজন। প্রচুর টার্কির বেচাকেনা হয় এ সময়ে। অনেক মুসলিমীনরা খোঁজে নিয়ে আসেন হালাল টার্কি, মৌসুমী পাখি খাওয়ার লোভ আর ঘরে ভাল ছুটি কাটানোর জন্যে।

১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রীয় টার্কি ডিনারে আরেক রীতি চালু করেছিলেন রাষ্ট্রপতি জর্জ এইচ ডাব্লু বুশ। তিনি,আনুষ্ঠানিকভাবে একটি টার্কি পাখিকে ক্ষমা করে দেয়ার প্রথা শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ ভোজনে ঐ টার্কি না খেয়ে ছেড়ে দিয়ে কোথাও সংরক্ষণ করা হবে। নিয়মানুযায়ী দুটো টার্কি নির্বাচন করা হয়। যাদের পোষা নামও থাকে। তারপর ওয়েব-সাইট বা অন্য ভাবে ভোটাভোটিতে দেয়া হয় যে, কোনটি খাওয়া হবে আর কোনটিকে খানা থেকে রেহাই দেয়া হবে। ভোটে বিজয়ী টার্কিকে ঘোষণা করে মুক্তি দেয়া হয়। আর এ সব কিছু করা হয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রেসিডন্ট চাইলে অবশ্য অপরটিকেও মুক্তি দিতে পারেন তবে অনুষ্টান ছাড়া।

তবে এই ধারণাটির মূলে আব্রাহাম লিংকনের পুত্র টেড। বিশ্বাস করা হয় যে, টেড পরিবারের টেবিলের জন্য নির্ধারিত পাখিটি না খেয়ে রক্ষা করতে অনুরোধ করেছিলেন। গত ২৬শে নভেম্বর ছিল থ্যাংকস গিভিং ডে। তবে দুদিন আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট, মি. ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের বার্ষিক ডিনারে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি থ্যাঙ্কসগিভিং টার্কিকে ক্ষমা করেছেন।

ক্ষমা পেতে দুটি পাখি কর্ন এবং কোবকে জনগণের ভোটের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। কর্ন জিতেছে, তবে তাদের দু’জনই রাতের খাবারের টেবিল থেকে রেহাই পায় এবং আইওয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তারা অবসর জীবন কাটাবে।

মি.প্রেসিডন্ট, কর্ন-এর উপর হাত মেলে বল্লেন :
“corn,I hereby grant you a full pardon”
“কর্ন,আমি আপনাকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দিলাম”
ধন্যবাদ মি.প্রেসিডন্ট। আমি যদি কখনো কর্ন-এর দেখা পাই, তার উপর হাত রেখে বলবো—
“কর্ন, পৃথিবীর সব মজলুম মানুষগুলো  আজ যদি তোমার মত মুক্তি পেত—বড় ভাল লাগতো”।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!