রবিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

পাঠশেষে ডা. সুমনা তনু শিলা-এর গল্পগ্রন্থ ‘ক্ষত’: মিহির রঞ্জন তালুকদার



প্রকৃতপক্ষে কোনো লেখকের সাথে যদি পূর্ব পরিচয় থাকে তবে তাঁর বই পড়ার আগ্রহটা একটু বেশিই থেকে থাকে। যদিও লেখকের সাথে আমার ভার্চুয়ালি পরিচয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর প্রতিটি লেখাই আমি মনোযোগসহকারে পড়ি, তাঁর প্রতিটি লেখায় রয়েছে মৌলিকতার ছাপ। কপি-পেস্টের এই যুগে এরকম লেখা পাওয়া কঠিন। লেখাতে যেমন মৌলিকতা রয়েছে তেমনি রয়েছে সৃজনশীলতা।

বই বিক্রীর সবচেয়ে বড় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রকমারি ডট কম। সেই রকমারিতে বই খোঁজা-খুঁজি করতেই হঠাৎ চোখে পড়ল ‘ক্ষত’ বইটি। লেখকের নাম দেখেই চমকে উঠলাম আরে! উনিতো আমার পরিচিত! সাথে সাথেই কনফার্ম করে নিলাম। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারনে হাতে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বই যখন হাতে পাই তখন আমি যাত্রাপথে। রাস্তায়ই বহটি রিসিভ করি। বইটি সাথে নিয়েই চলে গিয়েছিলাম সুনামগঞ্জের সুইজারল্যান্ড খ্যাত সেই ‘পাহাড় বিলাস’ এ। এতো সুন্দর মনোরম পরিবেশ পেয়ে বই পড়ার লোভ আর সামলাতে পালাম না। সেই বই পড়া অবস্থায়ই ছবিটি তুলেছেন প্রিয় বন্ধু কংকণশ্রী তালুকদার। তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ সুন্দর মূহুর্তটি ক্যামেরায় ধারণ করার জন্য।

৯১ পৃষ্ঠার ‘ক্ষত’ বইটি শেষ করতে সময় লেগেছিল মাত্র কয়েক ঘন্টা। দুই বন্ধুর গল্প-আড্ডার ছলে বইটি পড়ে শেষ করে ফেললাম। প্রতিটি গল্প পড়ার পর পরই কল্পনা করতাম এতো গল্প নয়! যেন বাস্তব। লেখক প্রতিটি গল্পে বাস্তবতার ছোঁয়া রেখেছেন।

শুধু বাহ্যিক রক্তক্ষরণই ক্ষত নয়! প্রিয়জনদের অবহেলা, আপনজনদের দ্বারা অপমানীত হৃদয়েও যে দাগ কেটে যায় তাও ক্ষত, এবং ভয়ঙ্কর ক্ষত। এর কোনো চিকিৎসা নেই। এই ক্ষত বাহ্যিক না হলেও এর কষ্ট সীমাহীন। বাহ্যিক ক্ষত হয়তো ওষুধে ছেড়ে যায় কিন্তু হৃদয়ের ক্ষত কদাচিৎ সম্ভব। আমি যে বইটির কথা বলছি তা হলো ডা. সুমনা তনু শিলার ‘ক্ষত’।

লেখক ২৪ তম বিসিএস এর একজন কর্মকর্তা তথা ডাক্তার। বর্তমানে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপক (ফিজিওলজি)। এতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে প্রচুর ব্যস্ততা সত্যেও তিনি সাহিত্য তথা লেখা লেখিতে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর প্রতিটি লেখায় বাস্তবতার নিরিখে অত্যন্ত সুকৌশলভাবে সমাজের বিচ্ছিন্ন ঘটনার ক্ষতগুলো তুলে ধরেছেন তাঁর ‘ক্ষত’ গ্রন্থে। এটি লেখকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। এতে ছোট ছোট ২০টি গল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পেই লেখক কোনো কোনো ক্ষতের চিহ্ন রেখে গেছেন। প্রতিটি গল্পেই পাঠককে মনোযোগী করে তুলবে।

প্রথম গল্প ক্ষত: বইয়ের শুরুতে লেখক ক্ষত গল্পের সারমর্ম দিয়েছেন এমন- রোদেলা খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলার আজকের এই দৃষ্টি সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। যে গভীর ক্ষতটা তৈরি হয়েছিল বুকের ভিতরে, সে ক্ষত আমার মেয়ে দেখে ফেলে কষ্ট পাক, তা আমি চাই না। কেন ক্ষত তৈরি হয়েছিল মায়ের বুকে? লেখক এভাবে বর্ণনা দিলেও গল্পের এক জায়গায় লেখক লিখেছেন। ‘আমার ভাশুর বিপদে যে ওগুলো কিনতে রাজি হয়েছেন, সেটাই বড় কথা।’ এই কথাতেই এক নারীর অসহায়ত্বের তুলনা নেই। অন্তরে কতটুকু ক্ষত থাকলে কেউ একথা বলতে পারে, পাঠক ভালোভাবেই বুঝতে পারবেন।

ছেলেমানুষি গল্পে আবার লেখক বলেছেন অন্যকথা। সন্তানের সাফল্যে পিতা-মাতা কতটুকু আনন্দ পান তা প্রকাশ করা কঠিন। সন্তানের সফলতায় পিতা-মাতার আচরণ হয়ে উঠে ছেলেমানুষি। এটাই মনে হয় মানুষের খুশির শেষ পর্যায়। সন্তানের সফলতাই পিতা-মাতার স্বর্গীয় সুখের অনুভূতি। যদিওবা সন্তানের সাফল্যের পেছনে অনেক ক্ষত রয়েছে তথাপি সফলতাই এখানে প্রাধান্য।

লেখক বলেছেন “সমাজের ক্ষতগুলো আমাকে ঘুমাতে দেয়না জাগিয়ে রাখে। দেখতে থাকি ক্ষতগুলো, লিখতে থাকি আনাড়ি হাতে। ভালোবাসার টানা পোড়েনগুলো দেখে যে ক্ষতগুলো তৈরী হয় মনের গভীরে সে ক্ষতগুলো লিখতে পারি না, তেমন করে শুধু অনুভব করি। যদি কখনো লেখাগুলো পাঠকের মন ছুঁয়ে যায় তবেই আমার লেখা সার্থক হবে।”

একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও যে লেখক হয়ে উঠতে পারেন তা বিস্ময়ের সাথে জেনেছি তাঁর ক্ষত বইটি পড়ে। পড়ার সময় কেবলই মনে হয়েছে গল্পগুলো যেনো চেনাজানা যা প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে  আমাদের সমাজে। যেন সমাজের বাস্তব প্রতিবিম্ব। তাই আমার নিজেরো খুব ইচ্ছে করে আর একবার যাই সমুদ্র স্নানে, ধুয়ে ফেলি লুকানো ক্ষতগুলো সব নির্জনে। লেখককে অনেক অনেক অভিনন্দন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা। পরবর্তী বইয়ের অপেক্ষায় রইলাম।

মিহির রঞ্জন তালুকদার : প্রভাষক, বালাগঞ্জ সরকারি কলেজ, সিলেট

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!