শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

‘গরিবের বিচার নাই, আমরার আল্লাহর গেছে সবর’

বালাগঞ্জে নিহত স্কুলছাত্রী সুমাইয়ার পরিবার এখন আতঙ্কে



ছবিতে বা থেকে: প্রতিবেদক এসএম হেলাল, সুমাইয়ার মা ও ভাই।

।।সরেজমিন প্রতিবেদন।।

বালাগঞ্জের বাণীগাঁও এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী নিহত সুমাইয়ার পরিবার এখন আতঙ্কে রয়েছে। প্রাণের ভয়ে ঘরের বাহির হচ্ছে না। গত শুক্রবার (৭ এপ্রিল) উপজেলার বোয়ালজুড় ইউনিয়নের নুরপুর (হাকিম আলী) গ্রামে এই প্রতিবেদক যান নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার কিশোরী সুমাইয়া এবং তার পরিবার সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে। স্কুল বন্ধ থাকায় সহপাঠী বা শিক্ষকদের সরাসরি পাওয়া না গেলেও পরিচালনা কমিটির সভাপতি, শোকাহত এলাকাবাসী এবং তাঁর বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলা ও সুমাইয়ার কবর জিয়ারত করার সুযোগ হয় এই প্রতিবেদকের। এতে জানা যায় দরিদ্র সুমাইয়া ছিলেন একজন মেধাবী, পরিশ্রমী ও প্রাণবন্ত মেয়ে। পরিবার তথা মানুষকে নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু তিনি বিগত ২২ মার্চ সকাল ৮টার দিকে শুধুমাত্র পেঁয়াজ দিয়ে অল্প সাদা ভাত খেয়ে প্রতিদিনের মতো মাকে চুমু খেয়ে প্রাইভেট পড়তে ঘর থেকে বাহির হন আর বিকেলে লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরেন সুমাইয়া। দশ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে নিহত সুমাইয়া ছিলেন সবার ছোট।

চোখেমুখে ভীতি ও হতাশার ছাপ সুমাইয়ার মা ফাতেহা বেগমের কাছে সুমাইয়ার বিষয় তুলতেই তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন – ৪দিন, ৫দিন যায় না তথ্য বারই জায়গি। আইজ ১৬-১৭টা দিন অইগেছে আমার বাচ্চার, একজরা তথ্য বারকরতা পারইন না। আর তথ্যতো এক হিসাবে তারা বারখরি লাইছইন। না অইলে আনতাজি ধরিয়া নেইনগিনি?গরিবের বিচার নাই, আমরার আল্লাহর গেছে সবর। ফুড়িগুরে পেঠভরি ছাইটটা ভাত খাওয়াইতে পারছি না। কিন্তু কোনো দিন কোন…. বলে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। একটু পরে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন আমার বাচ্চাগুরে জিগিশসা করি মারিলিছে। যেগুরে পুলিশে ধরছে তারে ভালো করি জিকাইলেই সবকিছু বারইয়া জাইবো। আমরা এখন ঘুমাইনা, খুব ভয় হয়। সন্দয় না থাকা সত্ত্বেও যখন আমার বাচ্চারে মারতো পারছে এখনতো সন্দেহ হয় যদি আমার পুয়ারেও মারিলায়। আমার বাচ্চাইন রাতে বিশেষ দরকার হলেও বারইন না ভয়ে। পুলিশ যারে ধরছে, তারা অনেক শক্তিশালী। তারা আটজন। এরমধ্যে লণ্ডন ৩জন ও ৫জন বাড়িত আছে। আর আমার ১ ফুয়া। যদি তারা মারিলায়!

এই ঝোঁপ-জঙ্গল থেকে সুমাইয়ার লাশ উদ্ধার করে বালাগঞ্জ থানা পুলিশ।

সুমাইয়া হত্যা মামলার বাদি ও তার একমাত্র ভাই ইসকন্দর মিয়া বলেন, আমি রোজা রাখরাঅইছি থাকি মসজিদও গিয়া তেরাবি পড়ি। এবার প্রথম তারাবি মসজিদে গেছি। এরপর থাকি আর ভয়ে মসজিদে যাইনা। কারণ পুলিশ অকলে যারারে নিছে এরাতো এখন চক্কর- চাক্করদের। আমি মনেকরি, আমি যদি না থাকি তবে এই হত্যাকান্ডর বিচার হইতো নায়। তারা চাইবো আমারে মারিলিতো। আর আমি দুনিয়াইত থাকা অবস্থায় চাই যে কোনো উপায় হোক, তথ্যটা বারঅউক, কে বা কারা খুন করছে। এরার বিচার হোক, এরার ফাঁসি হউক। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব আনহার মিয়া চেয়ারম্যান, প্রশাসন ও আমাদের এমপি হাবিবুর রহমান হাবিব আমাদেরকে দেখতে এসে তাঁরা সঠিক বিচার পাওয়ার আশ্বাস দিছইন, কইছইন তোমার কোনো সমস্যা অইলে আমরারে কলদিও৷ এমনি করে করুণ সূরে কথাগুলো বলে সুমাইয়ার ভাই ইসকন্দর মিয়া বোনের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

বাণীগাঁও এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়। যে বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ছিল সুমাইয়া।

এ ব্যাপারে আলাপকালে – বালাগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি রজত দাস ভুলন বলেন, সুমাইয়া হত্যাকাণ্ড খুবই দুঃখজনক। এই ঘটনার সাথে যে বা যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা খুবই জরুরী। হত্যাকাণ্ডকে যারা বিভ্রান্ত করে মূল ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে চাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে এধরনের ঘটনা ঘটবে না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রকৃত অপরাধীকে ধরলেই এর সমাধান হবে বলে আমার বিশ্বাস।

বানীগাঁও মডেল উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি বদরুজ্জামান বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ও ভালো একজন ছাত্রী ছিল সুমাইয়া। তার আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত বিভিন্নভাবে আমরা সহযোগিতা করেছি। তার নির্মম হত্যাকাণ্ডে আমরা অত্যান্ত ব্যতিত ও মর্মাহত। দ্রুত খুনিদের গ্রেফতারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

বালাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বোয়ালজুড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনহার মিয়া বলেন, এ ধরনের ঘটনা অত্যান্ত ন্যাক্কারজনক। আমি আমার অবস্থান থেকে পূর্বেও বলেছি আবারও বলছি সুমাইয়া হত্যাকাণ্ড আমাদের প্রত্যেকের নিরাপত্তার জন্য এবং প্রত্যেকের সন্তানের নিরাপত্তার জন্য কঠিন হুশিয়ারি। আমাদের আগামী প্রজন্মের তথা এলাকাবাসীর সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকৃত দোষীদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐ ঘটনার আসল রহস্য উদঘাটন হোক প্রশাসনের কাছে এটাই কামনা।

বালাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাকুর রহমান মফুর বলেন, আমারও মেয়ে আছে। আমার অবস্থান থেকে যতটুকু প্রয়োজন করছি এবং করে যাবো। এই হত্যাকাণ্ডের আসল রহস্য অচিরেই উদঘাটন হবে এবং  প্রকৃত অপরাধীরা গ্রেফতার হবে এমনটা আশা রাখছি।

বালাগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ রমা প্রসাদ চক্রবর্তী বলেন, এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আমরা ইতোমধ্যে একজনকে আটক করেছি। ঘটনার রহস্য উদঘাটন এবং বাদির নিরাপত্তা বিষয়ে পুলিশ তৎপর রয়েছে।

সুমাইয়ার কবর।

উল্লেখ্য, গত ২২ মার্চ বালাগঞ্জের বোয়ালজুড় ইউনিয়নের বাণীগাঁও মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার পথে খুন হয়। পেকুয়া ব্রিজের নিকটবর্তী একটি খালের পাশে ঝোঁপ-জঙ্গল থেকে বিকেলে তাঁর লাশ উদ্ধার করে বালাগঞ্জ থানা পুলিশ। পরদিন (২৩ মার্চ) সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে নিহত সুমাইয়ার দাফন সম্পন্ন হয়। এবং ঐদিন নিহতের ভাই ইসকন্দর মিয়া বাদি হয়ে বালাগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলা (নং-৬)। এ ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে ইতোমধ্যে একজনকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃত লিটন মিয়া (৩৫) বোয়ালজুড় ইউনিয়নের মোবারকপুর (ঘাগরাকান্দি) গ্রামের মানিক মিয়ার ছেলে। নিহত সুমাইয়া বোয়ালজুড় ইউনিয়নের নুরপুর (হেকিম আলী) গ্রামের মৃত আইন উল্যার কনিষ্ঠ মেয়ে।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!