স্কুল বন্ধ। দুপুর প্রায় দেড়টা। ৬ বলে ৮ রান প্রয়োজন। হঠাৎ কেউ স্ট্যাম্প, কেউ ব্যাট, কেউ বল নিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ভোঁ দৌড় . . . . .!
চৈত্রের খররৌদ্র মাথায় বয়ে বাবা বাড়ির দিকে আসছেন। এমনিতেই খেলতে গেলে বকুনি, বেতের বাড়ি, কান ধরে উঠাবসা, আরও কত কি! তার উপর দুপুর দেড়টা, আবার চৈত্রের কাঠফাটা রোদ। আজ না জানি কি ফাটার জন্য অপেক্ষা করছে। খুব ধীর পায়ে বাবা বাড়ি ঢুকলেন। প্রথমেই আমি মুখোমুখি। তবে বকুনি খেতে হয়নি। আজ আর সেই তিরিক্ষি মেজাজ নেই। সাথে দেখলাম এক বৃদ্ধ লোক। বেচারার পেটে সারাদিন একটি দানাও পড়েনি। মা তাড়াতাড়ি ভাত দিলেন। আমি বসে বসে দেখলাম, আমার খুব আনন্দ লাগল। মনে হলো আমার খুব প্রিয়জনকে বাবা দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছেন। খাওয়া শেষে যাওয়ার সময় বাবা বলে দিলেন যেকোনো দিন দুপুরে এদিকে আসলে যেন খেয়ে যায়।
মানুষটি একজন ষাটোর্ধ্ব চা-শ্রমিক। উনার এক ছেলে ছিল, কিন্তু সে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। ছেলের দিকে দুই নাতি ও এক নাতনি। অনেক কষ্টে বেশ কিছুদিন ধরে চলছিল। হঠাৎ ঐ চা বাগান মালিক বন্ধ করে দিলেন। ফলে ভিক্ষার ঝুলিকেই অবলম্বন হিসেবে বেছে নিলেন তিনি। ঐ দিনের পর থেকে প্রায়ই উনি আমাদের বাড়িতে খেয়ে যেতেন। কিছুদিন পর ভাত খাওয়ার সাথে থালাটি ধোয়ার দায়িত্বও বর্তায় লোকটির উপর। তারপর যেহেতু থালা ধুইতে ঘরের পিছনে যেতে হয় তাই পেছনেই খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। ফলে থালা আর পিছনে নিয়ে যাওয়ার কষ্ট করতে হয় না। এতে ভাত খাওয়ার সাথে সাথে মশার কামড় খাওয়ারও বন্দোবস্ত হলো। তাতে কি! ভালোই হয়েছে। একসাথে একজন মানুষ ও অনেক মশা অর্থাৎ অনেক অভুক্ত প্রাণিকে খাওয়ানোর পুণ্যি অর্জন করে স্বর্গে যাওয়া যাবে।
বিষয়টি চূড়ান্ত অমানবিক মনে হলো। তাই এ নিয়ে কথাবার্তা, যুক্তি-তর্ক শেষ পর্যন্ত ঝগড়া বিবাদে গিয়ে পৌঁছালো। একপর্যায়ে আমাকে ধমকের সুরে শুনতে হলো, ‘তুই পারলে থালা ধুয়ে নে।’ তা অবশ্য ঠিক, আমিও তো করতে পারি। ঘরের সকল কাজ মায়েদের আর বোনদের করতে হয়, এটাওতো ঠিক মানবিক না। তাই আমি থালা ধুয়া শুধু নয়, সুযোগ থাকলে আমি ভাত দেওয়ার কাজটাও করব বলে ঠিক করলাম।
তারপর থেকে উনি আসলে কাউকে ডেকে কষ্ট দিতাম না। ভাত দিয়ে পাশে বসে অনেক গল্প করতাম। কখনো কখনো উনি খাওয়া-দাওয়া ভুলে শুধুই গল্প করতেন। বারবার খাবার কথা মনে করিয়ে দিতে হতো। এবার আমি এক নতুন আনন্দের স্বাদ পেলাম। আগে উনি আসলেই মনের মধ্যে চাপ থাকত, কেউ না আবার না বুঝে কষ্ট দিয়ে দেয়। উনিতো নীরবে সে অপমান সহ্য করবেন ক্ষুধার জ্বালায়। এই চিন্তা থেকে মুক্তি পেলাম। আমি উনাকে দাদু ডাকতাম। দাদু চোখে ঝাপসা দেখতেন। মানুষ চিনতে পারতেন না। কিন্তু আমাকে ঠিকই চিনতেন। তখন এ এক আশ্চর্য বিষয় ছিল আমার কাছে। বুঝতাম না কীভাবে চিনতেন। আসলে দাদু বলে হয়তো এ পাড়ায় আর কেউ ডাকত না। একদিন দাদু আসার পর আমি ভাত দিতে চাইতেই একজন বাধা দিয়ে জানালো, ‘মা এখনও খাননি।’ আমি বললাম, ‘মা তো বেশি ভাত খান না। যা আছে তা দিয়ে মা খেয়েও অল্প কিছু থাকবে। আর যদি দাদুকে খাওয়াতে গিয়ে মায়ের একটু কম হয় তাহলে একবেলা না হয় একটু কমই খেলেন। বেচারা তো সারাদিন ধরে খাননি।’ ধীরে ধীরে তীব্র বাকবিতন্ডার আওয়াজে বাবা মা’র ঘুম ভাঙে। সবকিছু বুঝার আগে আমার চওড়া গলা শুনে আমাকেই উত্তম-মধ্যম দিয়ে দিলেন বাবা। অনেক রাগারাগি আর কথাবার্তা হলো। কিন্তু সবার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যুক্তি করার মতো গণতান্ত্রিক সমাজের বহু আগেই মৃত্যু ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমার যুক্তি তাদের বিরক্তি ছাড়া আর কিছু দিতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত বললাম আমার দুপুরের খাবারটাই যেন দাদুকে দেওয়া হয়, আমি আর দুপুরে খাব না। আরেকজন বলে উঠল, ‘উনি প্রতিদিন আসেন না, ফলে প্রতিদিন ভাত রান্না করে নষ্ট করা যাবে না।’ বললাম, ‘নষ্ট হবে না। উনি না আসলে আমি সন্ধ্যায় খাব।’ এমনি করে বহুদিন চলতে থাকল। কত ঘটনা হলো খাওয়ার জন্য। কাজ হলো না। পরে একদিন বাবা রাগ করে বললেন, ‘যা বের হ ঘর থেকে। না খেলে আমার ঘরে তোর জায়গা নেই।’ আমি দরজা খুলতে উদ্যত হলাম। তখন আবার আদুরে গলায় বললেন, ‘আচ্ছা বাবা, খাওয়া লাগবে না, থাক থাক।’
এমনি করে ছয় মাস কাটার পর একদিন দুপুরে কাহিল শরীর নিয়ে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিলাম। অপেক্ষা করছি ৩ টা হওয়ার। খেলতে যাব যে! ওহ! আরেকটি কথা তো বলাই হয়নি। এরমধ্যে দুপুরে সাথে সাথে যদি কোনোদিন সকালের খাবারও বাদ পড়ে তবু বিকেলের খেলাটা বাদ পড়ার উপায় ছিল না। যাইহোক, আমার এমন কাহিল অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই সবাইকে কষ্ট দিল। আমাকে আদর করা, ধমক দেওয়া, বেত মারা সহ সর্বপ্রকার অস্ত্রের ব্যবহার যখন শেষ তখন মাকে বকাঝকা শুরু করে দিলেন বাবা, যেন সকল দোষ মায়ের। শুধু এই ঘটনা না, পকেটের দশ টাকার হিসাব না মিললে তাও মায়ের দোষ। যদিও দুঘণ্টা পর এসে বলবেন ১০টাকার তো পান কিনেছিলাম। আমি যদি ভালো কিছু করি বলবেন, দেখলে আমার সোনার টুকরো ছেলে। আবার একটু এদিক-সেদিক হলেই, ‘দেখলে, তোমার কুলাঙ্গার ছেলের অবস্থা দেখলে!’
এমনি করে অসংখ্য দোষের বোঝার সাথে আমার দুপুরের না খাওয়ার দায়ও মাথায় নিয়ে কষ্টে রাগে মা বাড়ি থেকে চলে যাবেন বলে কাপড় গোছানো শুরু করে দিলেন। ভারি বিপদে পড়লাম! কোনো ঘটনার সমাধানে যেতে না পারলে আমি নিজেকে কষ্ট দিয়ে সবার আচরণের প্রতিবাদ করতাম। কিন্তু আমার আচরণে কেউ কষ্ট পেলেও তো খারাপ লাগে। এমন পরিস্থিতিতে আর জিদ ধরে রাখতে পারলাম না। অবশেষে ঘরে ভাত থাকলে দাদুকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না, ঘরের পেছনে খাবার দেওয়া হবে না, উনার থালা উনাকে ধুইতে দেয়া হবে না, এই তিন ‘না’-এর সাপেক্ষে দুপুরের অনশন আন্দোলনের সমাপ্তি টেনে ভোজন সারলাম। কিছু দিন বেশ ভালোই চলল। এরপর আমি পড়তে চলে এলাম শহরে। মাঝে মাঝে বাড়িতে যেতাম, কিন্তু দাদুর সাথে আর দেখা হয়নি। কাউকে জিজ্ঞেস করেও সন্তোষজনক কোনো উত্তর পাইনি। কয়েক বছর কেটে গেল। হঠাৎ এক দাদার মুখে ঐ চা বাগানের কথা শুনলাম। তারা নাকি বাগান চালুর জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছিলেন। বাগানও চালু হয়েছিল। শুনেছি অনাহারে-অর্ধাহারে, বিনা চিকিৎসায়, শীতে কয়েকজন শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন। ঐ কয়েকজনের মধ্যে আমার দাদুটিও ছিল না তো! মনে পড়ছে দাদুর কথা। আর মনে পড়ছে একটি কবিতার লাইন, ‘পরাস্ত মানবতাবাদ দিচ্ছে গণআন্দোলনের সংবাদ।’