শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাথায় পাহাড় – ১।। হাবীব নূহ



আড়াই ফুট বাই দেড় ফুট ব্যাপ্তি ছিল ফ্রেমটির। অথবা এর কাছাকাছি সাইজের ছিল। অর্থাৎ বেশ বড় না হলেও এক ধরণের বড়। আয়তক্ষেত্রাকার বা রেকট্যাংগুলার শেইপের সম্পূর্ণ গ্লাসের ফ্রেম। তবে বর্ডার ছিল ডিজাইন করা কাঠে বাঁধানো এবং তা ম্যাট কালো রঙে রঙানো ছিল। মূল গ্লাস শিটের উপর শৈল্পিক ভাবে অয়েল পেইন্টিং দিয়ে আঁকা চিত্রাঙ্কন। অনন্তর মধ্য চিত্রে, সম আয়তন স্টাইলে হাতে লেখা বাংলা রাইটিং ছিল।তাতে,হিন্দি অথবা উর্দু এক শ্লোকের বাংলা লিপ্যন্তর ছিল।বাংলা কবিতার দ্বিপদী পয়ারের মত চরণটি ছিল এই;
“তাক্বদীর মেরি বদ নাসিবি ফারিয়াদ কিয়া করে,
সার পর ঘিরে পাহাড়,শিকায়েত কিয়া করে।”

উপরের এই পদ্যবন্ধ আদৌ কোন কাব্যের ছন্দ ছিল কি না আমি তা খুঁজে পাইনি। তবে এটি একটি চিত্রকর্ম-চিত্রকল্প অথবা মামুলি ফ্রেম যা’ই বা বলা হোক এটি ছিল তখনকার আমাদের “Drawing room” -এ সাঁটা অন্যতম ফ্রেম।

আমার আম্মার অবিশ্বাস্য সৃষ্টি ছিল এটি। তবে এর সাথে অনবদ্য দুষ্টুমিতে ঠাসা আমার স্মৃতি মাখানো আজাইরা প্যাঁচালও রয়েছে।

আমার আম্মার দু হাত ছাড়াও আরো কিছু হাত ছিল। এসব হাত—পারদর্শিতার হাত। স্রষ্টা তাঁর অদৃশ্য হাত দিয়ে আমার আম্মাকে এসব বিশেষ হাত প্রদান করেছিলেন। স্বল্পভাষী আমার আম্মার অনেকগুলো বিষয়ে তাঁর নীরব দক্ষতা ছিল।

‘তখনকার সময়’ অর্থাৎ কয়েক দশক আগে অভিজাত মহিলারাও ঘরসজ্জা আর দেয়াল সজ্জার জন্য মনের খুশিতে নিজ হাতে অনেক ‘নিভৃত’ ‘শিল্প’ সৃষ্টি করতেন যা আজকের উলঙ্গ-বিশ্বের মত যদি চাউর হতে পারত তাহলে তো নব প্রজন্ম আরো বেশি মেডেলের ছড়াছড়ি দেখতে পেত।

অবশ্য সেই মহিলাগণ এ সব সর্জন ও সৃজন, পদ ও পদকের জন্য করেননি। তাঁরা তো করেছেন পরিবার,আত্মীয় ও সমাজের সুখ, শোভন এবং সুন্দরের জন্য।

সেই মহিলাদের অনেকের অনেক সৃজনশীল উৎপন্ন আজ হয়ত গুম হয়ে হারিয়ে গেছে। যেমন আমার বর্ণিত ফ্রেমটিও নিখোঁজ হয়ে লাপাত্তা রয়েছে।

ঘর-বাড়িতে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় নতুনত্বের স্বাদ আনতে অনেক সময় আমরা পুরাতন অনেক কিছুকে গায়েব ও উধাও করে ফেলি। অথচ কতক ‘পুরানা যে সোনা’ সেই অনুভবটি আমরা অনেকে বেমালুম ভুলে গিয়ে গুম-সংস্কৃতিতে জড়িয়ে যাই। অর্থাৎ চিরতরে গুম করে ফেলি। যদিও এগুলো শুধু স্মরণে নয় বরং ভুবনেও হয়ত রাখার জরুরৎ ছিল।

এ লেখার বিবৃত ফ্রেমটি বহু বছর আমাদের বাড়িতে রুপ ও মাধুর্য ছড়িয়েছে ঠিকই অতপর একসময় আবার নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যায় তবে এর গাথা এবং এর সাথে গাঁথা আমার নগণ্য স্মৃতি আজো জাগরুক আছে।

শিশু বয়সে আমার কোন এক বিষণ্ণ মুহূর্তে আমার আম্মা আমাকে কাছে টেনে নিয়ে এবং ঐ ফ্রেমটি দেখিয়ে ছন্দটি আবৃত্তি করে শোনান। তখন এর মর্ম আমি তেমন বুঝিনি বরং আসলে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত প্রকৃতই আমি কিছু বুঝিনি কিন্তু আম্মার সুকণ্ঠ ও ভঙ্গিমা আমাকে বিমোহিত করে ফেলেছিল অধিকন্তু, কি যেন এক ‘ম্যাসেজ’ আমার হৃদয়-গর্তে চাপা এক ছাপ ফেলে দিয়েছিল। এর ফলে পরবর্তী কয়েকটি বছর আমি প্রায়ই বায়না ধরতাম তাঁর কাছ থেকে ঐ কবিতাটি শুনতে।

বিশেষ করে আম্মার বিমর্ষ-সময়ে, আমি বাঁদরামি করে জিদ ধরতাম যাতে তিনি এটি আবৃত্তি করে আমাকে শুনান। আমার উদ্দেশ্য তখন থাকতো তাঁকে হাসানো এবং শান্ত করা। চালাক তিনি সহজে বুঝে ফেলতেন আমার দাবি।

অনন্যোপায় হয়ে তিনি বাধ্য হতেন গাইতে—

“সের পর ঘিরে পাহাড় ফরিয়াদ কিয়া করে”…

(চলবে)

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!