রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘উচ্চ বিদ্যালয়’ না কি ‘উচ্চ‌বিদ্যালয়’।। দীপংকর শীল



আমা‌দের উচ্চ‌বিদ্যাল‌য়গু‌লোর গেই‌টে ‘উচ্চবিদ্যালয়’কে এক শ‌ব্দে না লি‌খে দু‌টি শ‌ব্দে লেখা হয়। প্রশ্ন হ‌চ্ছে কোনটা লেখা উচিত? ‘উচ্চ বিদ্যালয়’ না কি ‘উচ্চ‌বিদ্যালয়’?

উচ্চ‌বিদ্যাল‌য়ের মা‌ঝে ফাঁক রাখা না-রাখা নি‌য়ে একটু খোঁজাখুঁ‌জি ক‌রে দেখা গেল গ্রন্থগু‌লো ফাঁক ব‌ন্ধের কথাই ব‌লে‌ছে। যেমন, ব্যবহা‌রিক বাংলা অ‌ভিধা‌নে আছে ‘উচ্চ‌বিদ্যালয়’। ‘উচ্চ পর্বত’ বল‌লে আমরা পর্ব‌তের উচ্চতা বু‌ঝি। অর্থাৎ, ‘পর্বত’ হ‌লো বি‌শেষ্য পদ, আর ‘উচ্চ’ তার বি‌শেষণ। তাহ‌লে ‘উচ্চ বিদ্যালয়’ আলাদা ক‌রে লিখ‌লে অর্থ দাঁড়ায় ‘‌বিদ্যাল‌য়ের উচ্চতা’। কিন্তু বাস্তবতা হ‌লো ‘উচ্চবিদ্যালয়’ অর্থ আমরা বু‌ঝি এমন এক‌টি বিদ্যালয় যেখা‌নে সরকার কর্তৃক গৃহীত নী‌তি দ্বারা নির্ধা‌রিত স্তর পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হয়। আমরা বলার সময়ও একশ‌ব্দে উচ্চারণ ক‌রি ‘উচ্চ‌বিদ্যালয়’। মহা‌বিদ্যালয়, বিশ্ব‌বিদ্যালয় শব্দগু‌লো সমাসবদ্ধ ক‌রে লেখা হ‌য়ে‌ছে। এই নামশব্দ দ্বারা এক‌টি অখণ্ড ধারণা বোঝা‌য়। আলাদা ক‌রে লিখ‌লে সেই অখণ্ড ধারণা থা‌কে না। অর্থ বদ‌লে যায়। তাই ‘উচ্চ‌ বিদ্যালয়’ না লি‌খে ‘উচ্চ‌বিদ্যালয়’, ‘গণ মহা‌বিদ্যালয়’ না লি‌খে ‘গণমহা‌বিদ্যালয়’ অর্থাৎ, একশ‌ব্দে লেখা উচিত।

‌কেন ফাঁক রাখা হ‌লো? এর উত্ত‌রে কেউ কেউ বলেন high school থে‌কে শব্দ‌টির অনুবাদ করা হ‌য়ে‌ছে, তাই মূ‌লের ফাঁক বজায় রাখা হ‌য়ে‌ছে। তা‌ঁদের এই জবা‌বের উত্তর খোঁজ‌তে গি‌য়ে দেখা যায়, ইং‌রে‌জি ভাষায় অ‌নেক শব্দ ফাঁক ক‌রে লেখা হয় কিন্তু বাংলায় অনুবাদ ক‌রার সময় সমাসবদ্ধ ক‌রে লেখা হয়ে‌ছে- যাকে ভাষাতা‌ত্ত্বিকগণ ‘প‌রিভাষা’ ব‌লে থা‌কেন। নি‌ম্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অন্যান্য ভাষা‌বিজ্ঞানী যেসব প‌রিভাষা সৃ‌ষ্টি ক‌রে‌ছেন তার ক‌য়েক‌টি নমুনা দেওয়া হ‌লো। যেমন:

Book fair= বই‌মেলা
Prime minister= প্রধানমন্ত্রী
Short story= ছোটগল্প
Nominal stem= প্রা‌তিপ‌দিক
Non resident=অনাবা‌সিক
Wrong reading=অপপাঠ
Vulgar speech=অপশব্দ
Proper name=নামসংজ্ঞা
Oblique form= তির্যকরূপ
Vowel insertion=স্বরভ‌ক্তি
Vice principal= উপাধ্যক্ষ
Academic year= শিক্ষাবর্ষ
Year book=বর্ষপ‌ঞ্জি
Vice president=উপরাষ্ট্রপ‌তি
Vice Chancellor=উপাচার্য

উপর্যুক্ত শব্দগু‌লোর অনুকর‌ণে High School= উচ্চ‌বিদ্যালয় লেখা যু‌ক্তিযুক্ত।

কেউ কেউ ব‌লেন, ব্যক্তি বা প্র‌তিষ্ঠা‌নের নাম যে যেভা‌বে লে‌খে সেটাই শুদ্ধ। এক্ষে‌ত্রে ব্যাকরণ ধর্তব্য নয়। এই যে বলা হয় ‘‌সেটাই শুদ্ধ’, এটা তো একটা আপে‌ক্ষিক বিষয়। আজ যা শুদ্ধ কাল তা ভুল হি‌সে‌বে গণ্য হ‌তে পা‌রে।এমন‌কি এও বল‌া হয়, এটা প্রচ‌লিত হ‌য়ে গে‌ছে। এই যু‌ক্তির প্রে‌ক্ষি‌তে বলা যায়, গেই‌টে বড় বড় অক্ষ‌রে একশ‌ব্দে ‘উচ্চ‌বিদ্যালয়’ লেখা হ‌লে তাও প্রচ‌লিত হ‌য়ে যা‌বে।

বাংলা একা‌ডে‌মি প্রণীত ব্যবহা‌রিক বাংলা অ‌ভিধা‌নের ১৪৮ নং পৃষ্ঠায় লেখা আছে ‘উচ্চ‌বিদ্যালয়’ যার ব্যাখ্যা দেওয়া হ‌য়ে‌ছে, “‌যে প্র‌তিষ্ঠা‌নে প্র‌বে‌শিকা বা মাধ্য‌মিক স্তর পর্যন্ত পাঠ দেওয়া হয়।” প্র‌মিত বাংলা বানা‌নের নিয়‌মে ব‌লা আছে, “সমাসবদ্ধ শব্দগু‌লো‌তে ফাঁক রাখা যা‌বে না, একসা‌থে লিখ‌তে হ‌বে।” ভাষা‌বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. শি‌শির ভট্টাচা‌র্য তাঁর এক‌টা প্রব‌ন্ধে ‘উচ্চ‌বিদ্যালয়’কে একশ‌ব্দে লি‌খে‌ছেন। অধ্যাপক ড. সৌ‌মিত্র শেখর দেশ টি‌ভির ‘দূরপাঠ’ অনুষ্ঠা‌নে ব‌লে‌ছেন লিখ‌তে হ‌বে ‘উচ্চ‌বিদ্যালয়। প্রথম সা‌রির জাতীয় দৈ‌নিকগু‌লো‌তে লেখা হয় ‘উচ্চ‌বিদ্যালয়’। এত‌ নির্ভুল নমুনা থাকার প‌রেও উচ্চ আর বিদ্যাল‌য়ের ফাঁক বন্ধ হ‌চ্ছে না! সাইন‌বোর্ড বা গেই‌টে কিছু লেখা হ‌লে তা সহ‌জে সরা‌নো হয় না। ভুল হ‌লেও তার প‌ক্ষে বহু যু‌ক্তি দেখা‌নো হয়। কিন্তু যারা শিক্ষার্থী তা‌দের কথাও বি‌বেচনায় রাখ‌তে হয়।

তাই বিদ্যাল‌য়ের নামফলক থে‌কে উচ্চ আর বিদ্যাল‌য়ের ফাঁক বন্ধ ক‌রে একশ‌ব্দে ‘উচ্চ‌বিদ্যালয়’ লেখার জন্য সং‌শ্লিষ্ট কর্তৃপ‌ক্ষের দৃ‌ষ্টি আকর্ষণ কর‌ছি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও ভাষা গবেষক।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!