শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হ্যানিম্যানের স্ত্রীদ্বয়।। আব্দুর রশীদ লুলু



ছবিতে বা থেকে – স্যামুয়েল হ্যানিম্যান, স্ত্রী জোহানা হেনরিয়েটা লিওপেন্ডাইন ও মাদাম মেলানী

হোমিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান (১৭৫৫-১৮৪৩) রোগ-ব্যাধি জর্জরিত আর্ত-মানবতার সেবায় অসীম-অফুরন্ত অবদানের জন্য বিশ্বজোড়ে সুপরিচিত। তাঁর স্ত্রীদ্বয়-জোহানা হেনরিয়েটা লিওপেন্ডাইন কুসলার এবং মাদাম মেরি মেলানী ডি হারভিলী। চিকিৎসা বিজ্ঞানী হ্যানিম্যানের সুখ-দুঃখ সফলতা-বিফলতার সাথে তাঁর স্ত্রীদ্বয় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর প্রথমা স্ত্রী ছিলেন জোহানা হেনরিয়েটা লিওপেন্ডাইন কুসলার। ১৭ নভেম্বর ১৭৮২ সালে ২৭ বছর বয়সে জার্মানীর গোমেরনে থাকার সময় হ্যানিম্যান হেনরিয়েটাকে বিয়ে করেন। তখন হেনরিয়েটার বয়স ১৮ বছর মতান্তরে ১৯ বছর। বিয়ের পরের বছর অর্থাৎ ১৭৮৩ সালে তাঁদের প্রথম সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। হেনরিয়েটা ছিলেন হ্যানিম্যানের দুঃসময়ের দিনগুলোতে সহমর্মী-সঙ্গীনি। সমস্ত জীবন তিনি হ্যানিম্যানের পাশে ছিলেন সার্থক ও যোগ্য সহধর্মীনি হিসেবে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি আবিস্কারের প্রথম পর্যায়ে হ্যানিম্যান যখন প্রতিকূলতার মধ্যে ছিলেন তখন হেনরিয়েটা অভাব-অনটনের সংসার সামলিয়েছেন। অনেক সময় অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন। দুঃখের বিষয়, হ্যানিম্যানের জীবনে প্রতিকূলতা দূর হয়ে আলোর আভা তথা সুখের দিন যখন আসতে শুরু করল তখন ৩১ মার্চ ১৮৩০ সালে হেনরিয়েটা পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৭ বছর।

হেনরিয়েটা ছিলেন জার্মানীর দেশাউ নগরের ঔষধ ব্যবসায়ী কুসলারের মেয়ে। তাঁদের (হ্যানিম্যান ও হেনরিয়েটার) দাম্পত্য জীবনে ১১ (এগারো) সন্তানের জন্ম হয়। ২ (দুই) জন পুত্র এবং ৯ (নয়) জন কন্যা। হেনরিয়েটা ছিলেন সুন্দরী ও বুদ্ধিমতি। বিয়ের আগে তাঁদের জানা-শোনা ছিল। তাঁরা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। উভয়ের সম্মতিতে খুব সম্ভব তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। ঔষধ ব্যবসায়ী হেসলারের পালিতা কন্যা ছিলেন হেনরিয়েটা। রসায়নের প্রতি আগ্রহী হ্যানিম্যানের আসা-যাওয়া ছিলো ঔষধ ব্যবসায়ী হেসলারের বাড়ীতে। দাম্পত্য জীবনে তাঁদের ভালোবাসা ছিলো অটুট। দুঃখ-কষ্ট তাতে বাঁধ সাধেনি। বলা হয়, হেনরিয়েটা ছিলেন হ্যানিম্যানের জীবনে প্রকৃত অর্থে দুঃখী, দরিদ্র, নিপীড়িত ও যাযাবর জীবনের সঙ্গীনি, সহযোদ্ধা ও পরম বন্ধু।

প্রিয়তমা স্ত্রী হেনরিয়েটাকে হারিয়ে বিজ্ঞানী হ্যানিম্যান শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। নিজেকে বড় অসহায় ও নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকেন। কেননা, তখনো যে দূর্গম-দুস্তর অনেক পথ পাড়ী দেয়ার বাকী। এহেন অবস্থায় ৮ অক্টোবর ১৮৩৪ সালে ফ্রান্স থেকে জার্মানীতে এলেন এক সুন্দরী যুবতী- মাদাম মেলানী। তিনি চর্ম রোগে আক্রান্ত। অনেক চিকিৎসার পরও তা সারছে না। হাত চর্ম পীড়ায় আক্রান্ত হওয়ায় বিগত তিন বছর যাবৎ সখের ছবি আঁকা ও লেখা বন্ধ। হ্যানিম্যানের কাছে তিনি চিকিৎসা নিতে চান। মেলানী ছিলেন ফ্রান্সের তৎকালীন আইনমন্ত্রী এবং সাবেক রাষ্ট্রপতির পালিতা কন্যা। মেলানী হ্যানিম্যানের সুচিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেন।

সুস্থ- অভিভূত মেলানী সিদ্ধান্ত নেন হ্যানিম্যানের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করার। তাই বয়সের বিরাট ব্যবধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ১৮৩৫ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারী (মতান্তরে ২৮ জানুয়ারী) প্রায় ৮০ (আশি) বছর বয়সের হ্যানিম্যানের সাথে বিয়ে হয় ৩২ (বত্রিশ) বছর বয়সের (মতান্তরে পঁয়ত্রিশ বছরের) মাদাম মেলানীর। বিয়ের পর মেলানী হ্যানিম্যানকে নিয়ে প্যারিসে চলে যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হ্যানিম্যান মেলানীর সাথে প্যারিসে বসবাস করেন।

বলা বাহুল্য, মেলানীর সাথে বিয়ের পর সত্যানুসন্ধানী হ্যানিম্যান এক সময় স্বস্ত্রীক মুসলমান হয়ে যান। খৃস্টান ধর্ম ত্যাগের কারণে জার্মানীর পরিচিত পরিবেশ হ্যানিম্যানের বিরুদ্ধে চলে যায়। হ্যানিম্যান তাই সহায়-সম্পদ আত্মীয়-স্বজন ও উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগ-বন্টন করে ১৮৩৫ সালের জুন মাসে মেলানীর হাত ধরে প্যারিসে হিজরত করেন।

মেলানী স্বামীর সাথে ইসলাম ধর্মে অটল ছিলেন। তাই হ্যানিম্যানের মৃত্যুপূর্ব ওসিয়তের কারণে কোনো অমুসলমানকে মেলানী তাঁর (হ্যানিম্যানের) দাফনে অংশ গ্রহণ করতে দেননি। বহু প্রতিকূলতা অতিক্রম করে মেলানী শেষ পর্যন্ত দু’জন নওমুসলিমের সহযোগিতায় ইন্তেকালের ৯ (নয়) দিন পর (১১ জুলাই ১৮৪৩ সালে) হ্যানিম্যানকে দাফন করেন।

মাদাম মেলানীর গর্ভে কোনো সন্তানাদি জন্ম গ্রহণ করেনি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী, ধনবতী এবং নামকরা কবি ও চিত্রকর। মেলানীর সযত্ন পরিচর্যা ও হোমিওপ্যাথির সফলতায় হ্যানিম্যানের শেষ জীবন বেশ ভালোই কেটেছে।

শেষ বয়সে হ্যানিম্যান স্ত্রী মেলানীকে সঙ্গে না নিয়ে কোথাও যেতেন না। অর্থাৎ মেলানী ছিলেন শেষ বয়সে হ্যানিম্যানের প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গীনি। রোগীদের ঔষধ-পত্র প্রদানের সময় হ্যানিম্যান প্রয়োজনে মেলানীর সাথে পরামর্শ করতেন।

হ্যানিম্যানের দ্বিতীয়া স্ত্রী মাদাম মেলানী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ছিলেন রূপে-গুণে অদ্বিতীয়া। তবে হ্যানিম্যানের মৃত্যুর পর “অর্গানন” (বিজ্ঞানী হ্যানিম্যানের লেখা মূল্যবান বই। যেটাকে হোমিওপ্যাথির সংবিধান বলে আখ্যায়িত করা হয়) ষষ্ঠ সংস্করণ প্রকাশে মেলানীর বিতর্কিত ভূমিকার জন্য অনেকেই তাঁকে অর্থলিপ্সু মহিলা বলেও আখ্যায়িত করেন।

লেখকঃ আব্দুর রশীদ লুলু, ধর্ম, হোমিও ও কৃষি বিষয়ক লেখক ও গবেষক।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!