১.
বিগত এক ঈদে,ঈদের খুতবায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুরবানী নিয়ে যখন কথা বলছিলাম, তখনই হঠাৎ বিষয়টি মাথায় আসল যে, আমি সহ এখানে উপস্থিত কোন মুসাল্লিরই হয়ত সৌভাগ্য হবে না আজকের কুরবানী স্বচক্ষে দেখা অথবা স্বহস্তে যাবাহ করা।এমনকি আজ অথবা কাল অবধি হয়ত এক টুকরো কুরবানীর মাংসও খাওয়া হবে না আমাদের।
কারণ ইংল্যান্ডে তো এই পরিবেশ নেই।বরং সব পশ্চিমা দেশের এমনই পারিপার্শ্বিকতা।
এসব দেশে যেখানে বাড়ির চৌহদ্দি অথবা বাসা বা বাড়ির আঙ্গিনায় একটি ছোট্ট প্রাণীও হনন করা যায় না, সেখানে বাসা-বাড়িতে কুরবানীর পশু উদ্বহিয়া বা যাবাহ করার কল্পনা করাই হবে দুঃসাহস।
এসব দেশে প্রাত্যহিক প্রাণীবধ, সাধারণ যে কোন জবাই,ধর্মীয় কোশের অথবা মুসলিম হালাল যাবাহ,সব কিছুই করতে হয় নির্দিষ্ট জায়গায়।যাকে abattoir বা Slaughterhouse তথা কসাইখানা বলা হয়।knacker’s yard নামে আরো কিছু জাগা আছে যেখানে বিশেষ কোন ব্যবস্থাপনার আওতায় জাবাহ বা জবাই করার সুযোগ কখনো কখনো দেওয়া হয়ে থাকে।
উল্লিখিত এ সব নির্দিষ্ট ও আদিষ্ট জায়গা সচরাচর লোকালয়ের বাইরে অথবা দূরে থাকে।আবার সাধারণত এসব জায়গায় সাধারণ্যের প্রবেশাধিকারও থাকে না।
সোজা কথা, পশ্চিমা দেশে চাক্ষুষে অথবা নিজ হাতে কুরবানী দেওয়াকেও কুরবানী দিতে হয়।
ইব্রাহিমী কুরবানীর একটি মহা-আনন্দ এই যে নিজ তত্ত্বাবধানে জবাই করা কিন্তু পশ্চিমা দেশে সাধারণত তা সম্ভব হয় না।
তবে এখানে গায়িবানা কুরবানী অতি প্রচলিত ব্যাপার, অর্থাৎ নিজের কুরবানী অন্যের (butcher) দায়িত্বে দিয়ে দিতে হবে।
তবে কিছু দুঃসাহসিক কুরবানী-যোদ্ধা এমনও আছেন যারা সরাসরি কুরবানী করতে নির্দিষ্ট স্থানে চলে যান।তবে,নিশ্চয় তাঁদের এই অভিযাত্রায় প্রচুর সময় আর প্রভূত শ্রম ব্যয় হয়।কারণ কাজটি এত সহজ নয়।
এবং আরো কিছু ভাগ্যবান আছেন যারা ছুটি নিয়ে বা সময় বের করে নিজ নিজ দেশে সফরে চলে যান শুধু নিজ হাতে কুরবানী পরিচালনা করতে।
এই দুই নগণ্য দল ছাড়া অন্যরা যখন পশ্চিমা দেশে কুরবানী দেন তখন হালাল butcher’s shop (British),butcher shop(American),butchery অথবা এজেন্সি মারফত কুরবানী দিয়ে থাকেন।তাঁদের যাবাহকৃত কুরবানীর মাংস ঈদ-দিবসের বিকেলে অথবা পরের দিন(দ্বিতীয় দিন) এমনকি কখনো কখনো তৃতীয় দিন সকালে পেয়ে থাকেন।
মোটকথা,পশ্চিমা প্রবাসীরা, যারা প্রবাসে কুরবানী দিয়ে থাকেন তাঁদের দুটি গ্রুপ অর্থাৎ তাঁরা নিচের দুটো প্লান থেকে একটি ফলো করে থাকেন।
(অবশ্য মুষ্টিমেয় লোক আছেন যারা টাকার স্বল্পতার কারণে হোক অথবা অন্য কোন কারণে হোক,প্রবাসেই সবসময় তাঁদের কুরবানী কোনমতে করে নেন।তবে হালে ক্রমবর্ধমান ভাবে পশ্চিমা দেশে কুরবানী বেড়ে চলেছে—যা সুখের বিষয়।)
(এক)
একদল প্রবাসী তাঁদের অনুমেয় কুরবানীর সমুদয় টাকা, গরীব কোন দেশ অথবা নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেন এবং সেখানে আত্মীয়,সংস্থা বা এজেন্সি,এইসব প্রবাসীর পক্ষ থেকে কুরবানী আদায় করে থাকে।এ ক্ষেত্রে প্রবাসীরা কুরবানী সরাসরি দেখেন না আবার সেই মাংসও খেতে পান না।
এইসব প্রবাসীর ঈদানন্দ তাতেই যে অন্যরা তাঁদের কুরবানীর মাংস পেয়ে-খেয়ে আনন্দের ছোঁয়া পাচ্ছে।
(দুই)
আরেক দল প্রবাসী, প্রবাসে থাকা তাঁদের নিজ পরিবারকে কুরবানীর পরিচয় ও স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য অথবা কুরবানীর ইমেজ সৃষ্টি করা বা ধরে রাঁখার জন্যে, এক বা একাধিক ছোট পশু অথবা সাত-তারা(গরু) পশুতে অংশ নিয়ে প্রবাসে কিছু একটা কুরবানী করে থাকেন বটে তবে কুরবানীর বাজেটের আরেক বিরাট অংক গরীব দেশ অথবা নিজ দেশে পাঠিয়ে দেন।সেখানে তাঁদের টাকায় বড় ধরণের কুরবানী হয় তাঁদের পক্ষে।
প্রবাসীদের এই দলটি,যদিও কিছুটা আনন্দ, প্রবাসে নিজ অবস্থানের জন্য ভাগ রাখে তবুও তাঁদের ইচ্ছা প্রথম দলের মত সমানই যে,আত্মীয় বা অন্যরা মাংস বিলি-বন্টন আর খেয়ে নিয়ে মাংসল আমোদে মেতে ওঠুক।এজন্যই তাঁরা কুরবানীর জন্য নিজ বা পর দেশে টাকা পাঠায়।
আসলে, প্রবাসীগণের বাস এক জায়গায় হলেও কুরবানী দেন অন্যত্র।মাংস খাবার সামান্যতম লালসা তাঁদের থাকে না।তাঁদের পরার্থপর উদারতায় মাংসাদ মানুষগুলো উপভোগ করে মাংসল আনন্দ।
সেহেতু বলা যায়, পশ্চিমা দেশ সহ নানান দেশে বসবাসরত মুসলিমগণ নানা কারণে বছরের এই সেরা দিনগুলোর সেরা আমল তথা উদ্বহিয়া বা পশু-কুরবানীর সাথে সাথে তাদ্বহিয়া (تضحية) বা বিশেষ ত্যাগও প্রবাসীরা স্বীকার করে চলেছেন।
যেন কুরবানীর উপর আরো কুরবানী তাঁরা দিচ্ছেন।
যদিও এই বিশাল আয়োজনের নেপথ্যে আছে ইবরাহিমীয় সুননাতের ওয়াজিব রক্ষা।
প্রকৃতপক্ষে, এই ঈদুল আদ্বহার আদর্শ ও আনন্দ দাঁড়িয়ে আছে দুই মহামানব—বাবা ও পুতের বহু তাদ্বহিয়া ও ত্যাগের উপর।
একটি বা একেকটি কুরবানীর পিছনে থাকে আরো কিছু কুরবানী।
২.
এক সজ্জন প্রবাসী প্রশ্ন করলেন : মুফতি! এ সময়ে আমার আর্থিক পতন চলছে।তবুও আমার রুচি বলছে,একটি বড় পশুর টাকা জোগাড় করে কুরবানীর জন্যে দেশে পাঠাব, কিন্তু আমার পার্টনার তাতে প্রসন্ন নন,আপনার উপদেশ জানতে চাই।
বলা হল, সাধ্যের মধ্যে যেখানটায় আছেন সেখানেই দিয়ে দিন।তাই তো মনে হয় ভাল হবে।
তিনি অসম্মতির ‘না’এমন ভাবে টেনে বললেন যেন দেশে না দিলেই বরং বেশি অথবা অপূরণীয় লোকসান হয়ে যাবে।
অতঃপর কিছুক্ষণ মৌনতা ধরে রেখে তারপর বললেন, দেশে তেমন কেউ আপন আমার নেই তবে কিছু আত্মীয় আছেন যারা আমার কুরবানীর মাংসের আশা করে বসে আছেন।
বলা হল, ম্যানেজ করা আর পুষিয়ে নেওয়ার মনের জোর যেহেতু আপনার আছে তাই অগ্রসর হোন।(অর্থাৎ আপনি দেশেই কুরবানীর টাকা পাঠিয়ে দিন।)
তিনি বললেন, সাওয়াব তো পাওয়া যাবে, তাই না?
বলা হল, আপনার নিখাদ নিয়াতই সাওয়াব ডিসাইড করবে।(অর্থাৎ এক্ষেত্রে আপনার নিয়তের উপরই সাওয়াব নির্ভর করছে),এবং আপনার নির্মল অভিপ্রায়(নিয়ত) সাওয়াবকে স্ফীত(বড়) করতে পারে।যেহেতু আপনার ত্যাগের আয়তন বেশ বড় মনে হচ্ছে, তাই উৎপন্ন ফসলও অধিক হতে পারে।(অর্থাৎ আপনি অঢেল সাওয়াব পাওয়ার আশা করতে পারেন।)
৩.
উল্লিখিত প্রকৃতির কোন কথোপকথনে যখন জড়াই তখন প্রায়শ স্মরণ পর্দায় একটি আয়াতাংশ ভেসে ওঠে।৫৯ নাম্বার সূরা, আল-হাশারের ৯ নাম্বার আয়াতের শেষ অংশটি।
আয়াতের বাক্যে إِيثَار (ইছার) এর একটি গুণের কথা তুলে ধরা হয়েছে।এ মহৎ চরিত্র হল, অন্যদেরে ভালো পাওয়া,অন্যের মঙ্গল চাওয়া এবং অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া।সোজা কথা—নিজের চেয়ে অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া—
(تفضيل المرء غيرَه على نفسه)
যদিও এই আয়াতাংশে প্রস্তাবিত গুণের সিকি ভাগ প্রতিফলনও অধুনা বেশ দুরুহ।
আর আয়াতটি মূলত অবতীর্ণ হয়েছিল সেরা মানবদের নিয়ে।এ আয়াত ছিল সাহাবাকে ঘিরে।বিশেষ করে আনসার সাহাবা’র উৎকর্ষ মানবতা নিয়ে এ আয়াতটি :
وَ یُؤۡثِرُوۡنَ عَلٰۤی اَنۡفُسِهِمۡ وَ لَوۡ کَانَ بِهِمۡ خَصَاصَۃٌ ؕ۟ وَ مَنۡ یُّوۡقَ شُحَّ نَفۡسِهٖ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ۚ
“এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের উপর অন্যদের অগ্রাধিকার তাঁরা দেয়।
বস্তুত: যাদেরকে হৃদয়ের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে তারাই সফলকাম।”
৪.
Ibrahim Abd al-Fattah Tuqan.(1905–2 May 1941). ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদী একজন কবি ছিলেন।এই কবির একটি কবিতার একটি চরণ ভাবপ্রবণ চিত্তকে চেতনা যোগায় :
ما نال مرتبةَ الخلودِ
بغيرِ تَضْحيةٍ رضيَّة
عاشت نفوسٌ في سبيلِ
بلادِها ذهبت ضحيَّة
উল্লিখিত চরণের কাছাকাছি অর্থ :
ত্যাগে সন্তুষ্টি বিনা অমরত্বের মর্যাদা অর্জিত হয়নি,
ত্যাগের পথ মাড়িয়েই
দেশের জন্য বেঁচে ছিল (স্মরণীয়) মানবগুলি।
লেখক: মুফতি