রবিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

বিরাট প্রান্তরে বিশাল কিছু।। হাবীব নূহ



১.
এক ইয়াহূদী উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বি আল্লাহু আনহুকে বলল,

(يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ)
আমীরুল মু’মিনীন!

(آيَةٌ فِي كِتَابِكُمْ تَقْرَءُونَهَا)

আপনাদের কিতাবে একটি আয়াত আছে, যা আপনারা পাঠ করে থাকেন।

(لَوْ عَلَيْنَا مَعْشَرَ الْيَهُودِ نَزَلَتْ لاَتَّخَذْنَا ذَلِكَ الْيَوْمَ عِيدًا‏.)

তা যদি আমাদের ইয়াহুদীদের জন্য অবতীর্ণ হত, তবে আমরা, অবশ্যই দিনটিকে ঈদ বানিয়ে উদযাপন করতাম।

তিনি বললেন,
(أَىُّ آيَةٍ)

আয়াতটি কি?

সে বলল, আয়াত হলো :

‏(‏الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا‏)‏‏

(আজ তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্ম হিসাবে মনোনীত করলাম।)

[৫ নাম্বার সূরাহ, আল-মায়িদাহ্ এর ৩ নাম্বার আয়াতের এটি একটি অংশ]

উমার রাদ্বি আল্লাহু আনহু বললেন :

(قَدْ عَرَفْنَا ذَلِكَ الْيَوْمَ وَالْمَكَانَ الَّذِي نَزَلَتْ فِيهِ عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم وَهُوَ قَائِمٌ بِعَرَفَةَ يَوْمَ جُمُعَةٍ‏.‏)

আমরা জানি সে দিন আর সে স্থানের কথা যখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর উপর আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল।দিনটি ছিল জুমু‘আহ’র দিন এবং তখন তিনি আরাফায় অবস্থান করছিলেন।

( তারিক ইবনু শিহাব রাহিমাহুল্লাহ বর্ণিত এই হাদীস অনেক হাদীস ও তাফসীর গ্রন্থে বিদ্যমান, যেমন সাহীহ বুখারীর ৪৫ নাম্বারে আর সাহীহ মুসলিমের ৩০১৭ নাম্বারে রয়েছে)

২.
তাঁরা স্রষ্টা কর্তৃক পরীক্ষিত ভাল মানুষ।তাঁরা পৃথিবীর সব সময়ের সেরা সত্য মানুষ।তাঁরা সাহাবা।
এক লাখ চৌদ্দ হাজার অথবা এক লাখ চব্বিশ হাজার এই পূত মানুষগুলো মক্কার অদূরে দুই কিলোমিটার বিস্তৃত আরাফাত মাঠে একত্রিত হয়েছিলেন। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারির আগে এত বিপুল সৎ মানুষের সমাগম এ মাঠে আর কখনো হয়নি।

দশম হিজরির নবম জুলহিজ্জার,মধ্যাহ্নের পর,
বিশাল ঐ হাজ্জ পূর্ব সমাবেশে,মানব ইতিহাসের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ভাষণটি পেশ করেছিলেন,সৃষ্টির সেরা মহামানব।
আরাফাতের রাহমাত তথা দুআ’র পাহাড়ে,উটনি কাছওয়ারের পিঠে আরোহণ করে দেওয়া তাঁর বিদায়ী খুতবার পরতে পরতে আছে দেশ ও সমাজ এবং মানবতার উৎকর্ষ পাথেয়।

মক্কা থেকে পূব দিকে ২২ কিলোমিটার দূরের, ১০ দশমিক ৪ কিলোমিটার প্রসারিত আরাফাতের এই প্রান্তর সাক্ষী হয়ে আছে বিদায়ী হাজ্জের ( حَجَّةِ الْوَدَاعِ) বিদায়ী খুতবার।

[সাহীহ মুসলিমের ১২১৮ নাম্বার অথবা সুনান ইবনু মাজাহ’র ৩০৭৪ নাম্বার সহ বিভিন্ন সাহীহ হাদীস থেকে জানা যাবে, শেষ নাবীর পালন করা একমাত্র হাজ্জের ঈষৎ ও বৃহৎ বিবরণ।]

৩.
আরাফাতের মাঠ এবং আরাফার দিবস দুটোরই Dignity বা মর্যাদা আছে।আরাফাতের মাঠ হজ্বের জন্য অপরিহার্য।হজ্ব আরাফা কেন্দ্রিক।তবে আরাফা দিবসের বৈশিষ্ট্য শুধু হজ্বের জন্য নয় বরং নবম যিল-হাজ্বের ঐতিহাসিক আরাফা দিবসটির স্বতন্ত্র বিশেষত্বও রয়েছে।

তাৎপর্যময় আরাফাতের উল্লেখ কুরআনুল কারীমেও কয়েকবার করা হয়েছে তবে সরাসরি নাম নিয়ে শুধু দ্বিতীয় সূরার ১৯৮ নাম্বার আয়াতে করা হয়েছে।ঐ আয়াতটি হাজ্জ বিষয়ক আলোচনায় অবতীর্ণ।

৫ নাম্বার সূরা আল-মায়িদাহ্ এর ৩ নাম্বার যে আয়াতটি কুরআন ও ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,সেটি এই দিবসে অবতীর্ণ হওয়াতে আরাফা-দিনের সম্মানকে বহু উঁচু করে দেয়া হয়েছে।আবার এই আয়াতে নির্দিষ্ট করে الْيَوْمَ (আজ) উল্লেখ করে আরাফার মাঠে অবস্থানের দিবসকে বুঝানো দ্বারা দিনটিকে আরো মহিমান্বিত করে দেওয়া হয়েছে।

৪.
স্রষ্টার মহানত্বের যেমন কোন সীমা নেই, তাঁর কাছে তাঁর সৃষ্ট কোন জিনিষের তুচ্ছতারও কোন সীমা থাকার নয়।তারপরও স্রষ্টা তাঁর কুরআনে তাঁর সৃজিত বহু বস্তু বা বিষয়ের শপথ নিয়ে কথা বলেন।
মহান কেন নগণ্য বিষয়ের শপথ নিচ্ছেন, এমনটি প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক।
আসলে এখানে ব্যাপারটি অন্য জায়গায়।আর সেটি হচ্ছে মহান এখানে তাঁর মহামতি দ্বারা শপথকৃত বিষয়কে লক্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য করে তুলেন।
যেমন আরাফার শপথ নেওয়াতে,সচেতন মানুষের কাছে আরাফা আকর্ষণীয় হচ্ছে।

দুটো জায়গায় কুরআনে আরাফার শপথ নেওয়া হয়েছে।
প্রথম জায়গা হল,৮৫ নাম্বার সূরা, “আল-বুরুজ” এর ৩ নাম্বার আয়াত :

وَشَاهِدٍ وَمَشْهُودٍ

“এবং শপথ সাক্ষ্যদাতার এবং যার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়া হবে তার।”
আর এ শপথ বিষয়ে আবূ হুরাইরাহ রাদ্বি আল্লাহু আনহু বর্ণিত সুনান আত তিরমিযীর ৩৩৩৯ নাম্বার হাদীছে বলা হয়েছে :

الْيَوْمُ الْمَوْعُودُ يَوْمُ الْقِيَامَةِ وَالْيَوْمُ الْمَشْهُودُ يَوْمُ عَرَفَةَ وَالشَّاهِدُ يَوْمُ الْجُمُعَةِ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

“আল ইয়াউমুল মাওউদ”— (সূরা বুরুজ-২)—অর্থ, কিয়ামতের দিন, “আল-ইয়াউমুল মাশহুদ” (সূরা বুরুজ ৩)—অর্থ, আরাফাতে (উপস্থিতির) দিন এবং “আশ-শাহিদ” (সূরা বুরুজ ৩)—অর্থ,জুমুআর দিন।

{এই হাদীসের একজন বর্ণনাকারী মূসা ইবনু উবাইদাহ রাহিমাহুল্লাহ’র স্মরণশক্তির দুর্বলতার কিছু সমালোচনা থাকলেও, আলবানী রাহিমাহুল্লাহ’ও হাদীসটি সাহীহ আখ্যা দিয়েছেন।}

সুতরাং খোলাসা কথা হল, “আল-ইয়াউমুল মাশহুদ” কে আরাফাতের দিন অনেকে প্রমাণ করেন উল্লিখিত হাদীস থেকে।
তবে উল্লেখ্য, কুরআনের ১১ নাম্বার সূরা, “হুদ” এর ১০৩ নাম্বার আয়াতের “ইয়াউমুল মাশহুদ” হল ক্বিয়ামাতের দিনের আরেক নাম।

আরেকটি জায়গায় আরাফার শপথ নেওয়া হয়েছে আর সেটি হল, ৮৯ নাম্বার সূরা, “আল-ফাজর” এর তৃতীয় আয়াত।
বলা হয়েছে :

وَالشَّفْعِ وَالْوَتْرِ

“শপথ যা জোড় ও যা বিজোড়।”

জোড় এবং বিজোড় নিয়ে তাফসীরকারগণের অভিমত অথবা মতামত অসংখ্য।

তবে জাবির রাদ্বি আল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “বিজোড় এর অর্থ আরাফা দিবস (নবম যুল-হাজ্জাহ এবং জোড় এর অর্থ ইয়াওমুন্নাহর (দশম যুল-হাজ্জাহ)”।
[মুসনাদে আহমাদ: ৩/৩২৭ or 14511]

মোটকথা, এ ক্ষেত্রে সবগুলো অভিমত সঠিক ধরলেও তো কোন সমস্যা নেই।আর অনেক মতের মাঝে আরাফার বিষয়টিও অগ্রাহ্য নয়।

৫.
ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি হাজ্জ। আর হাজ্জ সাজানো হয়েছে আরাফাতকে ঘিরে।
নিচের জা’মে তিরমিযীর ২৯৭৫ নাম্বার হাদীছের প্রথমাংশ অনুধাবনযোগ্য :

عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ يَعْمَرَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏”‏ الْحَجُّ عَرَفَاتٌ الْحَجُّ عَرَفَاتٌ الْحَجُّ عَرَفَاتٌ

আবদুর রহমান ইবন ইয়া’মুর রাদ্বি আল্লাহু আনহু বর্ণনা করে বলেন, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হাজ্জ হল আরাফাতের (অবস্থানের) নাম। হাজ্জ হল আরাফাতে অবস্থান।হাজ্জ হল আরাফাত।”

ইমাম তিরমিযী রাহিমাহুল্লাহ সমৃদ্ধ তথ্য দ্বারা সুফইয়ান ইবন উয়ায়না রাহিমাহুল্লাহ’র উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন :

قَالَ سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ وَهَذَا أَجْوَدُ حَدِيثٍ رَوَاهُ الثَّوْرِيُّ ‏.‏

এটি হল (ইমাম) ছাওরী (রাহিমীহুল্লাহ) বর্ণিত একটি শ্রেষ্ঠ হাদীস।

৬.
সাহীহ মুসলিমের ১১৬২ নাম্বার হাদীছটি আরাফাকে ঘিরে উন্মুক্ত করেছে আনন্দদায়ক আরেক তথ্য।যেখানে খুলে দেওয়া হয়েছে তিক্ত পাপ মোচনের একটি দরোজা।

আবূ কাতাদাহ্ রাদ্বি আল্লাহু আনহু বর্ণিত এই হাদীছ,সাহীহ মুসলিম ছাড়াও আরো অনেক গ্রন্থে আছে।
এই হাদীছে আরাফা দিবসে রোযা রাখা নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন :

صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِي بَعْدَهُ

“আরাফাহ দিনের সাওম নিয়ে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তাতে পূর্ববর্তী বছর ও পরবর্তী বছরের গুনাহের ক্ষতিপূরণ হবে।”

৭.
রোযার রাখার পাশাপাশি,যদি একজন মুমিন, শর্ত পূরণ করে তাওবায় লিপ্ত ও মগ্ন হয় তখন বড় পাপ আর প্রকান্ড গোনাহও গলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।একজন পাপী মুমিনও ক্ষমা পাওয়ার আশাবাদী হতে পারবে।হজ্বে না গেলেও পৃথিবীর যে কোন জাগা থেকে এ দিনটির মহত্ত্বের সুযোগ নিতে পারবে যে কোন মুসলিম এবং মুসলিমাহ।

অপরদিকে, পাহাড়বেষ্টিত আরাফার দুই কিলোমিটার বিস্তৃত মাঠে, বছরের শুধু একটি দিনে (নবম যুল-হিজ্জাহ) মাত্র কয়েক ঘন্টা প্রসারিত (আরাফার) অবস্থান, সমবেত হাজ্বীদের জন্য, গরিমা ও মহিমার দিক দিয়ে বিশাল কিছু।

আবার,শয়তানের জন্য এ দিনটি চরম হতাশা ও ব্যর্থতার।শায়তানের দুশমনরা অর্থাৎ স্রষ্টার বান্দারা, এ দিনটির কল্যাণে স্রষ্টার নৈকট্য যেমন পাচ্ছে তেমনি ক্ষমার সুসংবাদও পেয়ে যাচ্ছে।

লেখক: মুফতি

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!