মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফজির আহমদ (আশরাফ): অনুভবে অনুভূতি।। আব্দুর রশীদ লুলু



সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বালাগঞ্জ উপজেলার ৩ নং দেওয়ান বাজার ইউনিয়নের তালতলা (বড় বাড়ি) নিবাসী ফজির আহমেদ (আশরাফ) আমার সহপাঠী। নবগ্রাম হাজী মো. ছাইম উচ্চ বিদ্যালয় (মাদারবাজার, ওসমানীনগর)-এ আমরা একসাথে ক’বছর পড়াশোনা করেছি, হইচই করেছি। বর্তমানে আশরাফ আমেরিকা প্রবাসী। হাই স্কুলে আশরাফের পড়ালেখার ইতি টানার পর দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আমার সাথে যোগাযোগ ছিল না। সত্যি বলতে কি, আমি পড়ালেখা, লেখালেখি, ক্যারিয়ার, শূন্য থেকে শুরু জীবন সংগ্রাম ইত্যাদি কারণে তার নাম প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। অপরদিকে আশরাফ নিজের ও পারিবারিক প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে পাড়ি জমায় আমেরিকায়। ক্রমে সে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে সুখী- স্বচ্ছল জীবন যাপন করে। আর আমি স্বদেশের মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরানো জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। প্রসঙ্গত বলে নেয়া যায়, কেন জানি স্বদেশের মাটি ও কৃষি আমাকে খুব টানে। সুযোগ পেলেই মাটি ও কৃষির সাথে আমি সময় কাটাই। মনে হয়, এই বিষয়টা আমার ছেলের মাঝেও সংক্রমিত হয়েছে। সেও এই নিয়ে বেশ ঘাটাঘাটি করে।

যা হোক, ২০০৭ সালের দিকে আশরাফ আমেরিকা থেকে দেশে বেড়াতে এসে আমার খুঁজে হানা দেয় পশ্চিম গৌরীপুর ইউনিয়নের প্রত্যান্ত অঞ্চলে। আমি তখন আমার কাজে ডুবে আছি। তথাকথিত বন্ধুদের নিয়ে ভাবছি-লিখছি -‘সরাও তোমার প্রলোভন অথবা সর তুই প্রতারক।’ সত্যি কথা বলতে গেলে তখন ‘বন্ধু ‘ শব্দের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে আমি বিরক্ত, ‘বন্ধু ‘ আমার কাছে অপ্রিয় শব্দ। অনেকে সব সহপাঠিকে বন্ধু বলে, যাকে তাকে বন্ধু ডাকে আমি তা পারি না। বলতে গেলে আমার কোন বন্ধু নেই। তথাকথিত অনেক বন্ধুর সাথে আমার সম্পর্ক ঠেকে না। একটু গভীরভাবে তাকাতে গেলে দেখি, বন্ধু বলে অনেকে আমাকে ব্যবহার করতে চায়। অনেকেই এভাবে আমার অনেক সময় ও শ্রম চুষে নিয়েছে। তথাকথিত আমার বন্ধু দেখি আমার ক্ষুদ্র সাফল্যে খুশি নয়, দুঃখী। সামনে ঠেলতে নয়, নানা ছলে পেছনে রাখতে সচেষ্ট। এরকম মানসিকতায় আমি আশরাফের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাই না। আমি আমার কাজ- ধর্ম, হোমিও, কৃষি ও লেখালেখি নিয়ে থাকতে চাই। কিন্তু আশরাফ নাছোড় বান্দা। এলাকার বিশিষ্টজনদের সাথে আশরাফ আমাকেও তার বাড়িতে দাওয়াত করে, আমি এড়িয়ে যেতে চাই। শেষ পর্যন্ত তার বারবার ফোনের কাছে হার মেনে ভূরিভোজনে অংশ নিই। তারপর সতর্ক দৃষ্টি রাখি আশরাফের প্রতি। ক্রমে আশরাফ আমার আস্থাভাজনে পরিণত হয়। সে আমার ইতিবাচক কাজে আগ্রহ দেখায়, আমার ছোট-বড় সাফল্যে আনন্দ প্রকাশ করে, আমার কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। আমাকে দোস্ত সম্বোধন করে, তার আন্তরিক দোস্ত সম্বোধনে আমি আপ্লুত হই। বিশেষ করে আমার এবং আমার ছেলের কৃষি কর্মে সূদূর আমেরিকা থেকে বিভিন্নভাবে অনুপ্রেরণা প্রদান করে। এরপর অনেকবার আশরাফের বাড়িতে গিয়েছি-খেয়েছি। সেও বউ-বাচ্চা নিয়ে একদিন আমার এখানে ঘুরে গিয়েছে। দিনে দিনে অনেক ভাবে আশরাফ আমাকে ঋণী করেছে। জানি সে ঋণ এ জীবনে আমার পক্ষে পরিশোধ করা কোনভাবে সম্ভব নয়।

সব মিলিয়ে বিশিষ্টজনদের নিয়ে লেখা আমার প্রকাশিতব্য বই, ‘অনুভবে অনুভূতি’তে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমি এ লেখা লিখছি। এছাড়া ‘আলোকিত নবগ্রাম চাই’ শীর্ষক লেখায়ও আগ্রহ সহকারে আমি আমার সহপাঠীদের অধ্যায়ে আশরাফের কথা লিখেছি। আমি প্রায়ই বলি, উন্নত দেশে বসবাসের প্রেক্ষিতে আশরাফের মন অনেক বড় ও উন্নত হয়েছে। সুদূর আমেরিকা থেকে আশরাফ নিরবে-নিভৃতে দেশের জন্য, মানুষের জন্য অনেক কাজ করে যাচ্ছে। যার সাক্ষী আমি এবং আমার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আনিসুল আলম নাহিদ। বিশেষ করে তার অসাম্প্রদায়িক ভাবনা ও কাজ আমাদের বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হয়েও আশরাফ অনেক অমুসলমান ও নিম্ন বর্ণের মানুষকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে কোন রকম প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই। আমার অনুরোধে আমার দোস্ত আশরাফ লক্ষ লক্ষ টাকা মানুষের জন্য ব্যয় করেছে। যত সময় যাচ্ছে, আশরাফের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। অবশ্যই সেটা তার নিঃস্বার্থ কাজকর্ম এবং মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক ভাবনার জন্য। তার কাছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নাই। আশা করছি, সারা জীবন আশরাফ আমার দোস্ত ও ভাই হয়ে থাকবে, মানবীয় ভুল- ভ্রান্তি উপেক্ষা করে।

বিগত শতকের ষাটের দশকে জন্মগ্রহণকারী লেখক, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী আশরাফের পিতা মরহুম মো. নিম্বর আলী ছিলেন সহজ- সরল ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ। ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি ৬ ছেলে-মেয়ে রেখে নিজ বাড়িতে স্বজ্ঞানে কলেমা পড়ে ইন্তেকাল করেন। নির্লোভ ও নিরহংকারী পিতার অনেক বৈশিষ্ট্য আমার দোস্ত আশরাফ লাভ করেছে। তার মাতা মরহুমা মরতুজা খাতুনও ধর্মপ্রাণ ও আল্লাহ ভীরু ছিলেন।

ছাত্র জীবন থেকেই সাহিত্য- সংস্কৃতির প্রতি আশরাফের আগ্রহ থাকলেও তার লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে আমার সম্পাদিত শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা ‘আনোয়ারা’য়। তার বই ‘তবু মনে পড়ে এবং বাবার মহৎ জীবন’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন তৎকালীন সাংসদ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস। বাবা-মাকে উৎসর্গিত সেই বইয়ের গ্রন্থ প্রসঙ্গে শীর্ষক বইয়ের ভূমিকা লিখেন আমাদের শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় শিক্ষক জনাব মোঃ আব্দুর রউফ। ভূমিকার ইতি টেনেছেন স্যার এভাবে – “পিতা ও সহপাঠীর প্রতি শ্রদ্ধা ও আবেগ নিবেদনের সাথে সাথে সমাজ সচেতন লেখক ফজির আহমেদ (আশরাফ) তবু মনে পড়ে এবং বাবার মহৎ জীবন বইয়ে প্রসঙ্গত: দেশ ও দুনিয়ার অনেক কিছু বলেছেন। আশা করা যায়, এ বই পাঠে সবাই উপকৃত হবেন।”

বিগত ক’বছর ধরে আশরাফ নিয়মিত লিখছে। আমার ছেলের সহযোগিতায় প্রায়ই আমি তার লেখা পড়ছি। বিচিত্র বিষয়ে বিশেষ করে সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম- অসংগতি সম্পর্কে তার লেখাগুলার মান দিন দিন ভালো হচ্ছে। বিগত শতাব্দীর আশির দশক থেকে নিয়মিত লেখালেখি বিশেষ করে বইপত্র আলোচনা- সমালোচনা লেখালেখির আলোকে আমার এ কথা বলা। আশা করছি অদূর ভবিষ্যৎতে বাছাইকৃত লেখা নিয়ে আমাদের আনোয়ারা ফাউন্ডেশন থেকে আশরাফের বই বাজারে আসবে।

আশরাফের লেখার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যথাপযুক্ত স্থানে বিশিষ্ট কবিদের কবিতার ব্যবহার। আমি তাকে প্রায়ই রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ বলি। ঠিক সময়ে তার মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার অংশ বিশেষ বেরিয়ে আসে, যা আমার খুবই ভালো লাগে। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের মত রবীন্দ্রনাথের কবিতাও আমার খুব প্রিয়। সেই প্রেক্ষিতে অনেকের সমালোচনা সত্ত্বেও রাজীব স্মৃতি গ্রন্থাগারে আমি রবীন্দ্র কর্নার চালু করেছি আগ্রহ সহকারে। শুধু রবীন্দ্রনাথের কবিতা নয়, কাজী নজরুল, জীবনানন্দ সহ বহু খ্যাতিমান কবিদের কবিতা আশরাফের কণ্ঠস্থ, যা সময় বিশেষে প্রয়োগ হয়ে থাকে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, উন্নত দেশে বউ-বাচ্চা নিয়ে কর্মব্যস্ত জীবনযাপন করে সাহিত্য- সংস্কৃতি চর্চার এত সময় আশরাফ পায় কোথায়?

নিজের শিক্ষকদের প্রতি, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের প্রতি আশরাফ সবসময় উদারহস্ত। আমার জানা মতে, প্রবাস জীবন থেকে আশরাফ নিয়মিত তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছে এবং প্রয়োজনে তাদের আর্থিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এছাড়া, মসজিদ- মাদ্রাসা এবং শিক্ষা খাতেও তার নীরব অবদান রয়েছে। আগেই বলেছি, অন্যান্য বিষয়ের সাথে কৃষির প্রতিও আশরাফের আগ্রহ প্রবল।

আমার উৎপাদিত ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদির ফেসবুকে পোস্ট দেখে আশরাফ উৎফুল্ল হয়। উন্নয়ন ও উৎপাদনের সাথে আমার সম্পৃক্ততায় সে আমাকে নিয়মিত ধন্যবাদ ও উৎসাহ দিয়ে চলে। সে উপলব্ধি করতে পারে কৃষি আমার কত প্রিয় সাবজেক্ট। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ নিয়ে আনোয়ারা এগ্রো ভিশন নামে একটি বহুমুখী ও সমন্বিত খামার করার স্বপ্ন আমার অনেক দিনের । যেখানে বাণিজ্যিক লাভের চেয়ে কৃষি প্রধান দেশে কৃষি বিষয়ক একটা সফল কিছু করে দেখানোর প্রত্যয় আমার প্রবল। কৃষিপ্রেমী আশরাফ এ কাজে আমার সঙ্গে থাকার স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গীকার করেছে এবং আমার বিশ্বাস লাভ- ক্ষতি চিন্তা না করেই আশরাফ একাজে আমার সঙ্গে আজীবন থাকবে।

বিভিন্ন সমাজকর্মের পাশাপাশি দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও আশরাফ এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালের বন্যায় এলাকার মানুষের পাশে ব্যতিক্রমভাবে আশরাফের অবস্থান আমি কাছে থেকে দেখেছি। যেখানে অনেকেই দান- অনুদানকে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ফলাও করে তুলে ধরতে পছন্দ করেন, সেখানে আশরাফ এক ব্যতিক্রম। এছাড়া আশরাফের আরেকটি বিশেষ গুণ হল, কথা দিয়ে কথা রাখা। বিগত কয়েক বছর ধরে দেখেছি, আশরাফের কোন অঙ্গীকার অপূরণ হয়নি। মানুষের মুখের কাছে মুলা ঝুলিয়ে রাখে না কখনো আশরাফ।

আমি সাধারণত:মোবাইল ফোনে কম কথা বলি, যেটা আমার ছেলের অপছন্দ। যদিও একসময় তথাকথিত বন্ধুদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে কান ঝালাপালা করেছি, কানের বারোটা বাজিয়েছি, ঘন্টার পর ঘন্টা এমনি এমনি বয়ে গিয়েছে। প্রবাসী আত্মীয়-স্বজনের সাথে কুশল বিনিময় ও জরুরি বিষয়-আশয়ে সংক্ষেপে কথা বলি, যদিও এতে অনেকেই নাখোশ হন। অনেককেই জরুরি না হলে নিজ থেকে ফোন দেই না, সেখানে ইদানিং ব্যতিক্রম হচ্ছে আশরাফের সাথে। আশরাফ কয়দিন ফোন না দিলে আমি নিজ থেকেই তাকে ফোন দেই, এমনই হয়ে গেছে আশরাফের সাথে সম্পর্ক।

দেশের ভালো-মন্দ দেশপ্রেমিক আশরাফকে দোলায়। দেশের ভালো খবর তাকে আনন্দ দেয়, মন্দ খবর ব্যথিত করে। সুদূর প্রবাস থেকে সেসব সংক্ষেপে হলেও আমার সাথে শেয়ার করেন আশরাফ। আমি উপলব্ধি করি, স্বদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি তার আলাদা মমত্ববোধ। খেলাধুলা ও সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতায়ও রয়েছে তার নীরব অবদান। স্বচ্ছল-সুন্দর সমাজ, দেশ ও পৃথিবী দেখার তার প্রত্যাশা আমি অনেকবার উপলব্ধি করেছি। মহান আল্লাহতালার কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়ার আকুতিও তার প্রবল।

আমার ভাই, আমার দোস্ত আশরাফ স্ত্রী ও সন্তানাদি নিয়ে আমেরিকায় সুখী সুন্দর জীবন যাপন করছে এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের। আমি সর্বান্তকরণে তার ও তার পরিবার- পরিজনের দীর্ঘায়ু কামনা করছি। আশা করছি, মানব ও প্রকৃতি কল্যাণে তার প্রচেষ্টা আজীবন অব্যাহত থাকবে।

পাদটীকা: আশরাফের জন্মস্থান তালতলা, সেই তালতলা গ্রামের কথায় আমার আরো দু’জন পছন্দের মানুষের কথা বলতে হয়; এদের একজন বইপ্রেমী শ্রদ্ধেয় মোঃ আব্দুল্লাহ মিঞা (অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি শিক্ষক), যিনি আমার অনেক সিনিয়র অথচ ইদানীং তাকে বন্ধু ভাবি । অপরজন তালতলা বশিরপুরের অনুজ প্রতীম মুহাম্মাদ শরীফুজ্জামান (ইংল্যাণ্ড প্রবাসী ও প্রধান সম্পাদক, বালাগঞ্জ প্রতিদিন), আমার জুনিয়র অথচ আমি তাকে আপনি বলি।

লেখক: ইসলাম ধর্ম, হোমিওপ্যাথি ও কৃষি বিষয়ক লেখক ও গবেষক।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!