রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসলাম স্পেন ও এপ্রিল ফুল।। ফজির আহমেদ (আশরাফ)



অতীতে বহু জাতি বহু দেশ তাদের কৃতিত্বে সাফল্য এনেছে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ মুসলমানদের সোনালী দিন নামে আখ্যায়িত স্পেন সভ্যতা। মুসলমানরা একমাত্র কোরআনের ও আল্লাহর রাসুল (সা.)’র আদর্শ শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নতি লাভ করে। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত প্রায় ৮০০ শত বছর সু-শাসন, সু-শিক্ষা, সু-কর্ম ও সুশীল সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে যারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে তারিক বিন জিয়াদ স্পেনের জনগণকে রক্ষা করেছিলেন রাজা রডরিকের অসহনীয় দুঃশাসন থেকে। তারিক বিন জিয়াদ স্পেনে ইসলামের শ্বাশত সৌন্দর্য ও কল্যাণের যে সূত্রপাত করেছিলেন স্পেনবাসী সুদীর্ঘ প্রায় ৮০০ শত বছর ধরে এর সুফল ও কল্যাণ ভোগ করেছিল। স্পেনের সোনালী যুগের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে অনেক শহর-বন্দর। ইতিহাস কোনো দিন তা অস্বীকার করতে পারবে না সেই শিক্ষা-দীক্ষা, কর্ম, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার।

উন্নতির ফলে দেশটিতে ধন-দৌলত অর্থ সম্পদের কোনো অভাব-অনটন ছিল না। অর্থ সম্পদের পাশাপাশি মানবতার শিক্ষা, ন্যায় বিচার, সভ্যতারও কোনো কমতি ছিল না।

স্পেন থেকে অন্যান্য দেশেও যেমন মিশরের কায়রো পর্যন্ত শিক্ষা জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামের এই কৃতিত্ব পৃথিবীর কোনো ইতিহাস কোনো দেশ কোন জাতি কখনও অস্বীকার করতে পারবে না। পৃথিবীর অনেক দার্শনিক, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক স্বীকার করেছেন মুসলমানেরা ন্যায় বিচার মানবতার শিক্ষা ও সভ্যতার পৃথিবীতে জাগ্রত করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই মুসলমানেরা আজ ঘুমিয়ে পড়েছে।

আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এর আগমনে যেভাবে পৃথিবীতে অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে সভ্যতার ন্যায় নীতির আলো পৃথিবীর বুকে জ্বালিয়ে ছিলেন সেই হযরত ওমরের শাসন, ন্যায় বিচার, রাষ্ট্র পরিচালনার বুদ্ধি দ্বারা জ্ঞান পৃথিবীর ইতিহাস যেভাবে স্মরণ রাখে শ্রদ্ধা করে বর্বর জালিম জুলুমের নিপাত করেছিলেন। একমাত্র কোরআন হাদীস ন্যায় নীতি মানবতা ও সভ্যতার আলো দ্বারা। স্পেনবাসীও সেই আলোকে সূত্রপাত করে সভ্যতা গড়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিধির নির্মম পরিহাস, স্পেন সেই আদর্শ নীতি, ন্যায় বিচার ও আলো থেকে সরে আসায় তাদের কপালে নেমে আসে দূর্ভোগ-দূর্যোগ। মুসলমান শাসকরা কোরআন ও সুন্নাহর আদর্শ থেকে দূরে সরে পড়ায় এবং বিলাসিতা প্রাচুরে‌্য গা ভাসিয়ে দেয়ার ফলে তাদের জীবনে সীমাহীন দুর্ভোগই কেবল আসেনি বরং মুসলমানদের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলীন হয়ে গেছে স্পেনের মাটি থেকে। মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে খ্রিষ্টান নৃপতিরা স্পেনের মাটি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করে। তাদের ধারণা ছিল মুসলমানদের যদি এ সুযোগে হটাতে না পারে বা উচ্ছেদ করতে না পারে তাহলে হয়তো আগামী দিনগুলোতে ইউরোপের সব গীর্জা মসজিদে পরিণত হয়ে আজান ধ্বনি শোনা যাবে। তাই রাণী ইসাবেলা চরম মুসলিম বিদ্বেষী রাজা ফার্ডিন্যান্ডয়ের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিয়ের পর দু’জনে মিলে মুসলিম নেতৃত্ব ধ্বংস ও চিরতরে নির্মূল করার দূরভিসন্ধি করতে থাকে। তারা স্পেনের মুসলিম শাসনকর্তা হাসানকে কোনো অবস্থায় আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারেনি। কৌশল খুঁজতে থাকে। কিছু মুসলমানের মির্জাফরের স্বভাবকে কাজে লাগিয়ে হাসানেরই পুত্র আবু আব্দুল্লাহকে সু-কৌশলে হাত করে তাদের অধীনে নিয়ে আসে। খ্রিষ্টান বাহিনী মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ পেয়ে তাদের যৌথ বাহিনী হাজার হাজার নিরীহ মুসলমান, নর-নারী ও শিশুকে হত্যা করে। খ্রিষ্টান নৃপতিরা আমাদের ঈমান আক্বিদা বিশ্বাসের দুর্বলতার পুরোপুরি সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের বাহিনী নিয়ে ৮০০ শত বছরের সভ্যতার গায়ে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মুসলিম সভ্যতার রাজধানী গ্রানাডার দিকে বাহিনী দু’টি নিয়ে ছুটে আসে।

ইতিহাস স্বাক্ষী, আপনারা স্পেনবিজয়ের ইতিহাস পড়ে আরো বেশি জানতে পারবেন। পৃথিবীতে সব জাতিকে সমানভাবে জ্ঞান বুদ্ধিদান করেছেন। ভালো কাজ করলে ভালো ফল সব জাতির জন্যই। মুসলামন হিসাবে আল্লাহ সাহায্য অবশ্য করবেন। যদি আমরা আমাদের আত্ম বিশ্বাস, ন্যায়-নীতি, মানবতা, কাজ-কর্মে, শিক্ষা-দীক্ষায় এখানে আসি। যেমন স্পেন বাসীকে করেছিলেন। আবার আমরা যখন এগুলো ত্যাগ করব, তিনি ছিনিয়ে নিবেন। স্পেনের মুসলমানরা যখন অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, রাহাজানি আর তাদের নিজেদের আত্মগৌরবে ভেসে গেলো, ঐক্য বিশ্বাস আর তখন কাজ করল না। সেই সুযোগ খ্রিষ্টান বাহিনী কাজে লাগিয়ে রাজধানী গ্রানাডায় ঢুকে পড়ল। আসার পথে মুসলমানদের বাড়ী ঘর শস্য খামার আগুনে পুড়িয়ে জ্বালিয়ে দিল। শহরের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে সব খাদ্য গুদাম আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এমনকি পানি সরবরাহের রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে দেয়। যার ফলে গ্রানাডা শহরে দুর্ভিক্ষ প্রকট আকার ধারণ করে। খাদ্যের অভাবে, পানির অভাবে মানুষের জীবন মরণাপন্ন হয়ে উঠে। প্রতারক ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলা মুসলমানদের উদ্দেশ্যে মিথ্যা আশ্বাস ঘোষণা করে। মুসলমানরা যদি আত্মসমর্পণ করে, নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয় তাহলে তাদের উপর আর আক্রমণ করা হবে না। মুসলমানেরা এই কঠিন সময়ে ক্ষুধার জ্বালা এবং পানির পিপাসা সহ্য করতে পারেনি। তাদের আশ্বাসে সহজভাবে বিশ্বাস করে আত্মসমর্পণ ও নিরস্ত্র হয়ে গ্রানাডাবাসী মুসলমানেরা ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলার ধোঁকা বুঝতে না পেরে অবোধ শিশু কন্যা নর-নারীদের চরম দুর্ভিক্ষের কথা ভেবে নিজেদের ও অবুঝ শিশুদের প্রাণ রক্ষার্থে গ্রানাডার মুসলমানেরা মসজিদে আশ্রয় নেয়। নরাধম জালিম ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলা মুসলমানদের সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে, অবুঝ শিশু কন্যা নর-নারীকে মসজিদের ভেতর আটকিয়ে রেখে, একযোগে শহরের সবকটি মসজিদে আগুন লাগিয়ে দিয়ে বর্বর উল্লাসে মৃত্যু ঘটায়। লক্ষ লক্ষ অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুর আর্তনাদে আল্লাহর আরশ ও গ্রানাডার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। হায়রে পৃথিবী ও ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমানেরা মসজিদের ভেতরেই জীবন্ত দগ্ধ হয়। সেই দিনটি ছিল ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল। দীর্ঘ ৮০০ শত বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং রাণী ইসাবেলা আনন্দ উল্লাসে ক্রুর হাসি হেসে উচ্চ কণ্ঠে বলেছিল, হায়রে এপ্রিলের বোকা শত্রুরা। শাসনকর্তা হাসানের পুত্র আবু আব্দুল্লার মীরজাফরীর কারণে ও ইসলামের আদর্শ থেকে দূরে সরে আসার কারণে মুসলমানদের অস্তিত্ব স্পেন থেকে প্রায় বিলীন হয়ে গেল। শত্রুর আশ্বাস বিশ্বাস করে প্রতারিত হয় মুসলমানেরা। আর সেই বোকা বানানোর এই নিষ্ঠুর খেলাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই তারা প্রতি বছর ১ এপ্রিল ‘এপ্রিল ফুল’ নামে মহা আনন্দের সাথে পালন করে থাকে। আজ আমরা মুসলমানেরাও আমাদের ইতিহাস- ঐতিহ্য না জেনে অনেকে তাদের মত আমরাও ‘এপ্রিল ফুল’ পালন করে থাকি। যা দুঃখজনক। আমাদের এটা পরিত্যাগ করা উচিত।

লেখক: আমেরিকা প্রবাসী সমাজসেবক

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!