মুহম্মদ নূরুল হক (১৯০৭-১৯৮৭) কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ ও ‘আল-ইসলাহে’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। একজন ত্যাগী মানুষ ও নিরব সাধক। তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণে সারাটা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। বিগত দিন গুলোতে এই কৃতি পুরুষের জীবন ও কর্ম নিয়ে অনেক লেখালেখি ও আলোচনা হয়েছে।
এখানে আমি তাঁর কর্মবহুল জীবনের যে তিনটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করছি, আমার ধারনা তুলনামূলকভাবে এ বিষয় গুলো কম আলোচিত হয়েছে। বিশেষ করে মুহম্মদ নূরুল্প হকের রাজনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কে বলা চলে আলোচনা হয়-ই নি। বলাবাহুল্য, তাঁর প্রথম জীবনীকার মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ বলেছেন- তিনি কখনো রাজনীতিতে সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়েননি।
যা হোক আশা করি, এখানে আলোচিত তিনটি বিষয় মুহম্মদ নূরুল হকের জীবন ও কর্মের কিছু নতুন দিক উন্মোচিত করবে। অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের তাঁর সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে। হয়তো মুহম্মদ নূরুল হক গবেষকদের কাজে আসবে।
এক।। ভাষা সৈনিক মুহম্মদ নূরুল হক।।
“একুশে ফেব্রুয়ারী, জাতীয় শোক ও শহীদ দিবস। স্বাধীনতার উৎস, মুক্তির পথ নির্দেশক এই দিন। বাঙ্গালী জাতির জাতীয়তাবোধের দিন, স্বকীয় চেতনার দিন, সংস্কৃতি বিকাশের সূচনা একুশে ফেব্রুয়ারী শুধু একটি দিন নয়। একটি প্রতীক, একটি পবিত্র প্রত্যয়, একটি আদর্শ।”
একুশে ফেব্রুয়ারী তথা ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে এই মুহম্মদ নূরুল হকের নিজের মূল্যায়ন।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন ওঠে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু হবে? এ নিয়ে সর্ব প্রথম সিলেটে আলোচনা শুরু হয় এবং তা করেন মুহম্মদ নূরুল হক। ‘আল-ইসলাহে’ তিনি এ নিয়ে লেখালেখি করেন। তিনি যুক্তির মাধ্যমে মন্তব্য করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিৎ। এখানেই শেষ নয়, তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে আলোচনার জন্য সাহিত্য সংসদের পক্ষ থেকে ১৯৪৭ ইংরেজীর ৯ই নভেম্বর এক মহতী সভার আয়োজন করেন। এতে বেশ কিছু কবি- সাহিত্যিক আলোচনা করেন। তাঁরা তাঁদের আলোচনায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের পক্ষে যুক্তি দেখান। এর পরপর ‘৪৭ ইংরেজীর ৩০শে নভেম্বর নূরুল হক সাহিত্য সংসদের পক্ষ থেকে আরেকটি ব্যাপক আলোচনা সভার ব্যবস্থা করেন। আলোচনার বিষয়বস্তু-‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু হওয়া উচিত।’ নূরুল হকের আহবানে এতে প্রধান বক্তা হিসেবে আসেন সুসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। বলা বাহুল্য দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক সালেহ চৌধুরীর মতে সৈয়দ মুজতবা আলীর “পাকিজনের রাষ্ট্র ভাষা” বিষয়ক বইটির জন্ম এ আলোচনা থেকে। উক্ত সভায় প্রায় দুই হাজার দর্শক উপস্থিত হয়ে ছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক কথা হলো, প্রতিক্রিয়াশীলদের উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য বাংলা ভাষার পক্ষে দেয়া জ্ঞানগর্ভ ভাষন সৈয়দ মুজতবা আলী শেষ করতে পারেননি। কিন্তু নূরুল হক থেমে যাননি। বাংলা ভাষার পক্ষে তিনি তাঁর প্রচেষ্টা-আন্দোলন চালিয়ে যান। পরবর্তীদে তিনি সৈয়দ মুজতবা আলীর জ্ঞানগর্ভ ভাষন ‘আল-ইসলাহে প্রকাশ করে জনসমক্ষে তুলে ধরেন।
এভাবে মুহম্মদ নূরুল হক ভাষা আন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। এবং ভাষা সৈনিক রূপে ইতিহাস হয়ে আছেন থাকবেন।
দুই।। রাজনৈতিক মুহম্মদ নূরুল হক।।
রায়কেলী এম, ই, স্কুলে পড়াশোনা কালে মুহম্মদ নূরুল হক খেলাফত আন্দোলনে
যোগদান করেন। মূলতঃ এখান থেকেই তাঁর রাজনীতিতে হাতে খড়ি। বলা বাহুল্য, বিলেতী পণ্য বয়কট ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে সে সময় দেখার ও উললা করার সুযোগ তাঁর হয়েছে। তিনি ১৯৩৬-১৯৪৭ ইংরেজী পর্যন্ত দেশ মাতৃকার মুক্তি আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে, অখন্ড ভারতের সমর্থক কতিপয় মাওলানা বিভিন্ন সময়ে এগারো বার তাঁকে ‘কাফের’ ফতোয়া দেন। যদিও নূরুল হকও ছিলেন ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত। এতদসত্ত্বেও তিনি দেশের মুক্তি আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। সিলেটের গণভোট অনুষ্ঠানের সময় মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি ব্যাপক সফর করেন। তাঁর এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল সিলেটকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত করা ও স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জন সাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, মুহম্মদ নূরল হকের এই রাজনৈতিক তৎপরতায় সবচেয়ে বেশী প্রভাব ছিল সিলেটের খেলাফত আন্দোলনের অগ্রদূত মাওলানা আব্দুল হকের। তিনি তাঁর আত্মকথায়, তৎকালীন খেলাফত আন্দোলন তথা রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে বার বার মাওলানা আব্দুল হকের কথা বলেছেন। মুহম্মদ নূরুল হকের রাজনীতি জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাবেক পৌর চেয়ারম্যান এডভোকেট আ.ফ.ম কামাল বলেছেন-“১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আন্দোলন, ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও পরবর্তী সময়ে তাঁর দুঃসাহসিক পদক্ষেপের কথা মনে পড়লে মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা হেট হয়ে যায়।”
যা হোক, স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুহম্মদ নূরুল হক সাহিত্যাঙ্গনে সক্রিয় হলেও পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সিলেটের গণভোট অনুষ্ঠানে তাঁর কর্ম তৎপরতা কোন অবস্থাতেই খাটো করে দেখা যায় না। এখানেও তিনি ইতিহাস হয়ে আছেন- থাকবেন।
তিন।। ধর্ম প্রচারক মুহম্মদ নূরুল হক।।
ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত মুহম্মদ নূরুল হক সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতির সাথে যুক্ত হলেও ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত ধর্ম পরায়ণ। জামালুদ্দীন আফগানী ও আল্লামা ইকবালের তিনি ছিলেন ভাবানুসারী। যৌবনে তিনি তাঁর দু’জন সহকর্মী-মাওলানা সখাওয়াতুল আম্বিয়া ও মাওলানা মমতাজ উদ্দীনকে নিয়ে উপজাতীয়দের মাঝে ইসলাম প্রচারের ব্রত নিয়ে সক্রিয় ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এবং অধ্যাপক কবি আফজাল চৌধুরীর মতে, ধর্ম প্রচারনার এই কাজে সাফল্যও অর্জিত হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে, মাওলানা সখাওয়াতুল আম্বিয়া সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ গ্রহন ও মমতাজ উদ্দিন কাদিয়ানী মতবাদ গ্রহন করলে উপজাতীয়দের মধ্যে ইসলাম প্রচারের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তাই বলে কি মুহম্মদ নূরুল হক হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন? না, তা হতে পারে না। তিনি, কলমের মাধ্যমে নিরবে-নিভৃতে সারা জীবন সাহিত্য-সংস্কৃতির পাশাপাশি ধর্মের কথা, ইসলামী জাগরণের কথা, মুসলিম সমাজের অতীত-ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা, নৈতিকতার কথা প্রচার করে গেছেন। তাঁর সম্পাদিত ‘আল-ইসলাহ’র বিগত সংখ্যা গুলোর দিকে তাকালে ও তাঁর লেখা পড়লে এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে। বলাবাহুল্য, মাসিক ‘মদীনা’ সম্পাদক মাওঃ মুহিউদ্দীন খান নির্দ্বিধায় ‘আল-ইসলাহ’কে ধর্ম ও তমদ্দুন বিষয়ক পত্রিকা বলে অভিহিত করেছেন। মুসলিম দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন- “তিনি ছিলেন সিলেটের মুসলিম সংস্কৃতির এক বিশিষ্ট কেন্দ্র।”
যা হোক, ঘুমন্ত ও কুয়াশাচ্ছন্ন মুসলিম জাতির জাগরণে এবং ইসলামের প্রচার- প্রচারণা ও খেদমতে মুহম্মদ নূরুল হক যে অবদান রেখে গেছেন, তা অনন্তকাল ধরে প্রজ্জ্বলিত থাকবে। ধর্মের প্রচারণার ক্ষেত্রেও তাই নিঃসন্দেহে তিনি ইতিহাস হয়ে আছেন- থাকবেন।
তথ্যপঞ্জী ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: হারানো দিনের স্মৃতি: আমার সাহিত্য জীবন (আত্মকথা)-মুহম্মদ নূরুল হক, কালজয়ী নূরুল হক-মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ, স্মৃতির মুকুরে ও নূরুল হক স্মারক-সম্পাদনায়ঃ- মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ।
লেখক: ইসলাম ধর্ম, হোমিওপ্যাথি ও কৃষি বিষয়ক লেখক ও গবেষক। ইমেইল: lulucenter2013@gmail.com