ষাটের দশকের অন্যতম এক লেখক ও কথাশিল্পী ছিলেন-মরহুম মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ। আশির দশকের এক তরুণ লেখক-এই আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে তাঁর কাছে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছি। নিজের অপরিপক্ক লেখা নিয়ে তাঁর সাথে আলোচনায় মেতেছি। তিনি হাসি মুখে প্রসন্ন মনে আমাদের সময় দিয়েছেন। তাঁর সম-সাময়িক লেখকদের কাছ থেকে এমনটা আশা করা আমাদের অন্তত: আমার জন্য ছিল কল্পনার অতীত।
সংগত কারণেই মরহুম কথাশিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল হামিদকে ঘিরে আমার অনেক কথা; অনেক স্মৃতি। তিনি ছিলেন আমার- প্রিয় হামিদ ভাই। কিন্তু আমি তাঁর কাছে অপরাধী; লজ্জিত। হামিদ ভাইয়ের কাছ থেকে যতটুকু আদর কিংবা আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছি সে অনুযায়ী তাঁর জন্য আমি তেমন কিছু করতে পারিনি। এ অপরাধ বোধ আমাকে এই ব্যস্ত সময়েও ভীষণ পীড়া দেয়।
খুব সহজ সরল মানুষ ছিলেন মরহুম কথাশিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ। তাঁর শৈশব-কৈশোর-যৌবন কেটেছে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের প্রাণ পুরুষ, বই প্রেমিক মরহুম মুহাম্মদ নূরুল হকের সান্নিধ্যে। যিনি ছিলেন তাঁর চাচা। খুব সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যন্ত মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ স্বচ্ছল হওয়ার পরও অর্থাৎ তাঁর বড় ছেলে ইংল্যান্ড প্রবাসী হওয়ার পরও একই ব্যান্ডের সিগারেট খেতেন। অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন।
মরহুম কথাশিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ মৃত্যুর আগে তাঁর উপর লেখা বই দেখে যেতে চেয়েছিলেন। সে অনুযায়ী আমি তাঁকে নিয়ে একটা বই লেখার চেষ্টা করেছি কয়েক বার। কিন্তু কি এক অদৃশ্য কারণে আমি তা পারিনি। সে ব্যর্থতা আমাকে দীর্ঘ দিন কুরে কুরে খেয়েছে। পরবর্তীতে আমার বই “হৃদয়ে মম”তে ছাব্বিশ জন পরলোকগত ব্যক্তিত্বের সাথে তাঁকে নিয়ে ‘কথাশিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল হামিদকে মনে পড়ে’ লিখে বুকটা কিছুটা হাল্কা বোধ করেছি।
আমার সম বয়সী মামাতো ভাই ইংল্যান্ড প্রবাসী শক্তিমান কবি মুকুল ইকবালের টেবিলে একদিন আবিষ্কার করি সাহিত্য-সাপ্তাহিকী “সুর” প্রথম সংখ্যা। যা ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ সালে কবি সিরাজ চৌধুরীর সম্পাদনায় পশ্চিম সুবিদ বাজার, সিলেট থেকে প্রকাশিত হয়। তো “সুর” এর ওই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল মরহুম কথাশিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের ধারাবাহিক উপন্যাস “জীবন জাগার গান”। লেখাটি পড়ে আমি তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ বোধ করি। তারপর এক বিকেলে মামাতো ভাই মুকুল ইকবালের সাথে “সুর” অফিসে যাই। মুগ্ধ চোখে দেখি সহজ-সরল মানুষ “জীবন জাগার গান” -এর লেখককে। এই আমার প্রথম দেখা প্রিয় হামিদ ভাই।
তারপর লেখালেখির আকর্ষণে সাপ্তাহিক “সুর” অফিসে অনেক বার গিয়েছি। শ্রদ্ধেয় সিরাজ ভাই আমাকে “সুর”-এর নিজস্ব প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। “সুর” কর্তৃপক্ষের নিকটাত্মীয় হামিদ ভাইয়ের সাথে দিনে দিনে ঘনিষ্টতা বেড়েছে।
মনে পড়ে আমার বিয়ের কথা। ব্যস্ততার জন্য তাঁকে হাতে হাতে কার্ড দিতে পারিনি। ডাকে পাঠিয়ে ছিলাম। তারপর দাম্পত্য জীবন একটু গুছিয়ে গেলাম তাঁর বাসায়। তিনি অনুরোধ করলেন- ‘ভাবীকে নিয়ে একদিন এসো’। আমার স্ত্রীকে তিনি ‘ভাবী’ সম্বোধন করছেন। আমি খানিকক্ষণ হা করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাঁর আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা-উদারতায় মুগ্ধ হই। সত্যি তাঁর মতো এমন নিরহংকার ভালো মানুষ আমাদের সমাজে বিরল।
আমি তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে ছিলাম এবং তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ ও একটি কবিতা লেখা লিখেছিলাম। তিনি খুশী হয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের প্রাণ পুরুষ মুহাম্মদ নুরুল হক মারা গেলে স্থানীয় পত্র- পত্রিকার চিঠি-পত্র কলামে আমি দাবী করেছিলাম মোহাম্মদ আব্দুল হামিদকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হোক। যেহেতু হামিদ ভাই দীর্ঘদিন মরহুম মুহাম্মদ নূরুল হকের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু সবখানেই আমার সে দাবী উপেক্ষিত হয়। সহজ-সরল, প্রচার বিমুখ মানুষেরা বোধ হয় সবখানেই এ রকম উপেক্ষিত হন।
হামিদ ভাই’র বাসায় ষাটের দশকের বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা ও সংকলন ঘাটা- ঘাটির সুযোগ আমার হয়েছিল। সেই সময়ের পত্র-পত্রিকা ও সংকলনে হামিদ ভাই’র প্রচুর লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। প্রধানত: গল্প লিখলেও বিচিত্র বিষয়ে তাঁর প্রচুর লেখা রয়েছে।
আমাদের অনুরোধে হামিদ ভাই একটা গল্পের বই বের করেছিলেন- ‘মোহ মুক্তি’। আমি তখন প্রায়ই “সুর” এর বই-পত্র বিভাগ লিখতাম। অর্থাৎ একজন আলোচক- সমালোচক হিসেবে আমার একটু পরিচিতি ছিলো। হামিদ ভাই দিলেন তাঁর “মোহমুক্তি” কিছু লেখার জন্য। আমি ধীরে-সুস্থে একটা আলোচনা লিখি। দৈনিক সিলেটের ডাক অথবা দৈনিক জালালাবাদে (সঠিক মনে করতে পারছিনা) আমার সে আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। ২/১টি গল্পের উপসংহার এবং মূল বক্তব্য নিয়ে আমি বিরূপ মন্তব্য করে ছিলাম। আমার ধারনা ছিল, আমার এমন মন্তব্যে হামিদ ভাই মন খারাপ করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো হামিদ ভাই আমাকে হাসি মূখে গ্রহণ করেন। বললেন- ‘তুমি ঠিক বলেছ। আমি অমন করে ভাবিনি।’ আমি আরেক বার তাঁর উদারতায় মুগ্ধ হই।
বাস্তবে হামিদ ভাই নিজে লেখক হওয়ার চাইতে, লেখক তৈরীতে ভূমিকা রেখেছেন অনেক বেশী। নতুন লেখকরা তাঁর কাছে গেলে উৎসাহ ও দিক নিদের্শনা পেতো আন্তরিক ভাবে। তাঁর হাত দিয়ে তৈরী অনেক লেখক এখন প্রতিষ্ঠিত।
আমার ছোট মামা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব মোঃ লুৎফুর রহমান (লাল মিয়া)-এর সাথে হামিদ ভাই’র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে আমার জানা ছিল না। একদিন কথায় কথায় বেরিয়ে আসে সে কথা। সাধারনতঃ তাঁরা সন্ধ্যার পরে এক সাথে বসেন, গল্প-গুজব করেন। পরস্পর পরস্পরকে ভাই সম্বোধন করেন। সে কথা জানার পর আমি বিব্রত বোধ করি। অ্যাঁ, সারা জীবন আমি হামিদ ভাই, হামিদ ভাই করে এসেছি।
একবার হামিদ ভাই শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যায় বেশী পরিমাণে ভূগলে আমার উক্ত মামার মাধ্যমে আমাকে খবর দেন, তাঁকে এক নজর দেখতে। সে অনুযায়ী তাঁকে দেখতে গেলে তিনি খুব খুশী হোন।
কাজে-অকাজে যখন-তখন আমি হামিদ ভাইকে বিরক্ত করেছি। “সুর” অফিসে না পেয়ে বাসায় হাণা দিয়েছি। সব সময়ই তিনি আমাকে হাসি মুখে সাদরে গ্রহণ করেছেন।
কখনো কিছু না খেয়ে আসতে দেননি। তথ্য উপাত্তের জন্য বিভিন্ন সময়ে আমাকে তাঁর দ্বারস্থ হতে হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের বই-পত্র ঘাটা-ঘাটি করেছি। কখনো হাতে করে নিয়ে এসেছি। তিনি বিরক্ত হননি। বরং আমার উৎসাহ দেখে মনে হয়েছে, তিনি খুশী হয়েছেন।
সিলেট রেডিও’র সাথে হামিদ ভাই শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন। রেডিও’র জন্য তিনি অনেক পরিশ্রম করেছেন, অনেক লিখেছেন বিচিত্র বিষয়ে। হামিদ ভাই দু’দুবার আমাকে রেডিও’তে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন লেখালেখির সাথে সাথে আমি রেডিও’র সাথে সম্পৃক্ত হই। আমার ব্যক্তিগত নানা অসুবিধার কারণে যদিও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে হামিদ ভাই’র কাছে অনেক ঋণী। ঋণী হয়তো আমার মতো অনেকে। লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি নানা ভাবে আমাকে সহযোগীতা করেছেন। নিয়ে গিয়েছেন কবি লাভলী চৌধুরী, কবি রাগীব হোসেন চৌধুরী ও কবি শামসাদ হুসামের বাসায়। বিনিময়ে বলতে গেলে আমি প্রিয় হামিদ ভাইয়ের জন্য কিছুই করতে পারিনি। মরহুম হামিদ ভাইয়ের কাছে আমি তাই সবিনয় ক্ষমা প্রার্থী। আমি শুধু চেষ্টা করছি তাঁর অনুসরণে একটি সহজ-সরল সাধারণ জীবন-যাপন করার এবং লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকার।
প্রিয় হামিদ ভাইয়ের জন্য আজ আমার প্রার্থণা- আল্লাহ তুমি তাঁকে দয়া করে তোমার প্রিয় মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করো, মাফ করো, জান্নাত নসীব করো।
লেখক: ইসলাম ধর্ম, হোমিওপ্যাথি ও কৃষি বিষয়ক লেখক ও গবেষক। ইমেইল: lulucenter2013@gmail.com