কিন্তু জেনো ভাই
ইহার চেয়ে নাম যে মধুর
ত্রিভুবনে নাই।”
ম অক্ষরের সাথে আকার যুক্ত ‘মা’ শব্দটি আবেগ উচ্ছাস এবং অনুভূতির এক অনুপম আধার। দ্যেৎনাময় এই শব্দটির সাথে মানুষের নাড়ীর সম্পর্ক। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর দেশে দেশে অনেক লোক আছে পিতৃ পরিচয়হীন। কিন্তু মাতৃ পরিচয়হীন মানুষ পৃথিবীতে একজনও নেই।
যে মানুষ যে জাতি শিকড়ের সন্ধান করে না, তারা ব্যক্তিত্বহীন অস্তিত্বহীন স্বাতন্ত্রহীন এক শংকর জাতিতে পরিণত হয়। এই শংকর অবস্থায় মানুষে বেঁচে থাকে অবশ্য কিন্তু সুখে সম্মানে তার অস্তিত্ব আর ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে না। কাজেই বলা যায়, ব্যক্তির নিজের আত্ম পরিচয় অস্তিত্ব ব্যক্তিত্ব এবং স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শেকড় বা নাড়ীর সন্ধান অপরিহার্য্য। এমনি এক অপরিহার্য চিন্তা চেতনার আবেগের বহিঃ প্রকাশ আব্দুর রশীদ লুলুর সাহিত্য পত্র- “আনোয়ারা”। তার কৈফিয়ত থেকে জানা যায, এ সাহিত্য পত্রের আনোয়ারা নামকরণে কোন বিশেষ বিশেষত্ব নেই। মূলতঃ আনোয়ারা নামে এক আজন্ম দুঃখী নারী ছিলেন। আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে অকালে মারা যান তিনি। মৃত্যুর পর থেকেই আত্মীয়-স্বজন প্রায় সবাই তাকে ভুলতে বসেছেন ক্রমান্বয়ে। সে প্রেক্ষিতে তার অভাগা একমাত্র সন্তানের পক্ষে তাকে স্মরণীয় করে রাখার সামান্য প্রচেষ্টা হিসাবে এই আনোয়ারা নামকরণ।
আসলে সকল পুরুষের জীবনেই কোন না কোন নারীর প্রভাব থাকে। এই প্রভাব কখনো তাকে এগিয়ে দেয় আবার কখনো পেছনে টানে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে প্রিয় নারীর জন্য সবাই নিজের ভিতরে রাখেন উচ্চ আসন। যে আসন অনেক শ্রদ্ধার, অনেক ভালবাসার। এই শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার নারী নিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দুই তারকা যথাক্রমে তপন চৌধুরী এবং শাহেদ বলেন, ‘আমার প্রিয় নারী আমার মা। আমার মায়ের আদর ভালবাসাই আমার বেড়ে ওটা।’ আমার জন্য আমার মায়ের যে ত্যাগ তা কখনো ভুলার নয়। আমার মনে হয় জগতে আমার মায়ের মতো আরও একজন মা খুজে পাওয়া কষ্টকর। যদিও সবার কাছে তার মায়ের ব্যাপারটা এরকমই।
প্রত্যেক পুরুষের জীবনেই নারী চরিত্রগুলো আসে বিভিন্ন ভাবে নানা আবেগ অনুভূতি নিয়ে। ঠিক যেন উপন্যাসের মতো। আর উপন্যাস তো মানুষের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। আমার জীবনেও নারী চরিত্রগুলো এসেছে বিভিন্ন ভাবে। তবে আমি সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছি আমার মাকে। যতই দেখেছি ততই মুগ্ধ হয়েছি। মা অসাধারণ। আমার মার হাতে আমি নির্দিদ্ধায় তুলে দিতে পারি পৃথিবীর সেরা মায়ের অ্যাওয়ার্ড। আমার-মা-ই আমার জীবনের সেরা নারী।
সম্প্রতি বৃটিশ কাউন্সিল পরিচালিত এক শব্দ জরিপে বলা হয়েছে ইংরেজী ভাষার সবচেয়ে সুন্দর শব্দ হচ্ছে গড়ঃযবৎ বা মা। ঢাকাস্থ বৃটিশ কাউন্সিলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় প্রায় চল্লিশ হাজার বিদেশী ভোটার ও বৃটিশ কাউন্সিলের টিচিং সেন্টারের ইংরেজী শিক্ষার্থীদের মতামতের উপর জরিপ চালিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বৃটিশ কাউন্সিলের ৭০তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে এই জরিপ চালানো হয়। এই প্রকল্পের দায়িত্বে নিয়োজিত বৃটিশ কাউন্সিলেরর কমিউনিকেশন ও মার্কেটিং অফিসার গ্রেগ চেলসি বলেন, সবেচেয় আকর্ষনীয় বিষয় এই যে, মানুষের সাথে সরাসরি সম্পর্ক বর্ণনার ক্ষেত্রে ৭০টি শব্দের মধ্যে গড়ঃযবৎ বা মা শব্দটি প্রাপ্ত মতামতের সবচেয়ে উপরে স্থান পায়।
আসলে শুধু ইংরেজী বা বাংলায় নয় পৃথিবীর সব ভাষারই সবচেয়ে সুন্দর এবং মধুর শব্দ মা। শুধু মা শব্দটিকে নয়, মা নামক মানুষটিকেও আমরা খুব ভালবাসি। এই পৃথিবীতে মা নামক মানুষটিকে আমরা সব চাইতে বেশী ভালবাসি বলেই মা শব্দটি আমাদের কাছে এত সুন্দর ও প্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাংলা সাহিত্যের শ্লোক, গান, কবিতা, গল্প, নাটক সর্বত্রই এই মমতাময়ী জন্মদাত্রী মায়ের সরব উপস্থিতি রয়েছে। ইংরেজী সাহিত্যের এক গল্পে পড়েছিলাম এতিমখানায় বসবাসরত এক এতিম কিশোর ম্যানবিল নামক স্থানে তার মা জীবিত আছেন কল্পনা করে সে তার মাতৃশূন্যতার দুঃখ ভুলে যেত। বাংলা সাহিত্যের এক দিক পাল নজিবুর রহমান সাহিত্যরতেœর কলমের খোচায় “আনোয়ারা” হয়ে উঠেছিল সর্বজন গ্রহণযোগ্য এক নন্দিত উপন্যাস। ঘরে ঘরে সবার কাম্য ছিল আনোয়ারা চরিত্রের মত প্রিয়তমা প্রেমময়ী এক মহিয়সী নারী।
ইসলাম ধর্ম মাতারুপী নারীর সাথে প্রেম ভালবাসা সম্পর্ক এবং কর্তব্যের বাণী প্রচার করেছে হাজার বছর আগে। মা এবং মায়ের সেবা করার সুযোগ মানুষের জীবনে নিয়ে আসে পরম সফলতা। ওয়াসকুরুনী ও বায়েজীদ বোস্তামী মাতৃসেবার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। যে মায়ের সন্তোষ্ট চিত্তের দোয়ার বদৌলতে ইহকাল পরকাল সফল হয়ে উঠে, সেই মায়ের সাথে কান্ডজ্ঞানহীন পশুরমত আচরণ করে এমন মানুষও এ সমাজে কম নয়। এই হতভাগাদের বলি, শুধু মা শব্দকে এবং মা আশ্রিত সাহিত্যকেই ভালবাসলেই জীবন সুন্দর বা কর্তব্য সম্পাদন হয়ে যায় না। বরং প্রকৃত দায়িত্বশীলতার সাথেই মায়ের প্রতি সকল কর্তব্য এবং দায়িত্ব পালন করে জীবনকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর এবং মৃত্যুপরবর্তী জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে হবে। তেমনি মাতৃহীন স্নেহবঞ্চিত লুলুর দুঃখকে বক্ষে লালন করে আমরা তার প্রতি সমবেদনা জানাই আর নিজের মায়ের প্রতি ভালবাসায় উজ্জীবিত হয়ে জন্মদাত্রী স্নেহময়ী মমতাময়ী মাকে করে তুলি ইহকালীন কল্যাণ এবং পরকালীন মুক্তির সেতুবন্ধন। কারণ মা, আমাদের জন্মদাত্রী মা। মায়ের গুণেই আমরা পৃথিবীর আলো দেখতে পারি এবং মা-ই চরম ধৈর্য্য ও পরম মমতার সবটুকু আদর নিংড়ে আমাদের লালন-পালন করেন। এ জন্যই মায়ের প্রতি আমাদের কর্তব্য বেশী হওয়া উচিত। জাগতিক মানুষের পরলৌকিক পরম আকাঙ্খার বিষয় যে বেহেস্ত, তার অবস্থান ও মায়ের পায়ের নীচে এটা আমাদের ধর্মের কথা। কাজেই লুলু সাহেবের মায়ের মাগফেরাত কামনা করে আমরাও নিজের মায়ের প্রতি গভীর ভালবাসার মাধ্যমে আমরা গ্রহণ করি প্রতিকী মা আনোয়ারাকে এবং বলে উঠিঃ
“মা তুই বেহেস্তেরও ফুলের হাসি মা
পাইছি তোরে এই জীবনে আর কি ভাবনা।”
লেখক: সম্পাদক, বালাগঞ্জ ভিউজ, বোয়ালজুড়, বালাগঞ্জ, সিলেট।