আজ আমি এমন একজন সমাজ সেবকের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি যিনি শিক্ষা, সমাজ উন্নয়ন, স্থানীয় যোগাযোগের উন্নয়ন, দরিদ্রদের আর্থিক সহযোগিতাসহ নানাভাবে জনসেবা করে যাচ্ছেন। তাঁর নাম মো: তাহির আলী মাস্টার। তিনি ১৯৪৫ সালে সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার উছমানপুর ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হাজী সিকন্দর আলী ও মাতা মরহুমা আয়শা বিবি। পাঁচ ভাই বোনের মাঝে তিনি দ্বিতীয়। তিনি ১৯৬৩ সালে এস.এস.সি ও ১৯৬৯ সালে এইচ.এস.সি পাশ করেন।
বলতে গেলে জীবনের ঊষালগ্ন অর্থ্যাৎ ছাত্র জীবনেই তিনি কিছু সামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। নিজ গ্রামের জামে মসজিদ পরিচালনা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সমবয়সীদের নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং সেই কাঁচা বয়সেই দক্ষতার সাথে সৃষ্ট সমস্যা সমধানে সফল হন। পরবর্তী সময়ে তিনি সামাজিক বিভিন্ন সংস্থা সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। ১৯৮৯ সালে ‘নবগ্রাম কল্যাণ সংহতি সংস্থার’ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকাকালে মাদার বাজার সংলগ্ন বড়ভাঙ্গা নদীর উপর সম্পূর্ণ বেসরকারী উদ্যোগে ও অর্থায়নে প্রায় বাইশ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘নবগ্রাম সেতু’ নির্মিত হয়। এই সেতু নির্মাণে তিনি যে শ্রম দেন স্থানীয় জনমানসে চিরদিন তা স্মৃতি হয়ে থাকবে। এই সেতু নির্মাণের সময় লেগেছিল নয় মাস। এ নয় মাসের পুরো সময়ই তিনি শরীর ও মেধা খাঁটিয়ে সেতু নির্মাণে সময় ব্যয় করেছেন। একজন শ্রমিকের মত সকাল সাতটায় নাস্তা করে বের হয়ে আসতেন, দুপুরের খাবার খেতেন এখানে বসেই। রাত ১২/১টা পর্যন্ত থাকতেন। এমনও ঘটেছে যে, সকালে এসেছেন সারা রাত দিন কাজ করার পর রাতে বাড়ী ফেরা সম্ভব হয়নি, এখানে খেয়ে সারা রাত কাজ করে পরদিন বাড়ী গেছেন। এখানে বলে রাখা ভাল, এই সেতু নির্মাণে আমাদের প্রবাসী আত্মীয় স্বজন (বিশেষ করে লণ্ডন প্রবাসী) সর্বাধিক আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। তাঁর পরিবার থেকে সবচেয়ে বড় অংকের দান এসেছে। লণ্ডন ভিত্তিক ‘প্রবাসী নবগ্রাম উন্নয়ন সংস্থা’-র সম্পাদক ছিলেন তার ছোট ভাই মো: নুরুল ইসলাম (বিশিষ্ট সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী)। এ সংস্থাই সেতু নির্মাণের মূল উদ্যোক্তা।
তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন শিক্ষানুরাগী। মো: তাহির আলী পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন বিধায় তাঁর নামের সাথে মাস্টার পদটি সংযুক্ত আছে এবং এলাকায় তাঁর পরিচিতি এ রকমই। তবে বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। তিনি স্থানীয় মাদার বাজার এফ.ইউ. সিনিয়র (আলিম) মাদ্রাসায় ১৯৮৮ হতে ২০০২ পর্যন্ত এমপিও ভুক্ত শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু শিক্ষকতার বিনিময়ে তিনি কখনো বেতন গ্রহণ করেননি। আইনি জটিলতার কারণে বেতন বইয়ে স্বাক্ষর করতেন ঠিকই তবে পুরো বেতনই তিনি মাদ্রাসায় দান করতেন। সুতরাং আয় রোজগারের তাগিদে তিনি এ পেশায় নিয়োজিত হননি। বরং এ ছিল নিখাদ শিক্ষানুরাগ। এখানেই শেষ নয়, নিজের বেতন দান করার পরও প্রয়োজনে মাদ্রাসায় প্রচুর টাকা দান করতেন এবং এখনও করছেন। মাদ্রাসার নতুন ভবন নির্মাণ ও অখন্ড ভূমি সম্প্রসারণের জন্য তাঁদের পরিবার (তাঁর চাচাতো ভাইগণসহ) অতি মূল্যবান ০.৩৭ শতাংশ জমি দান করেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও তাঁদের পরিবারের প্রচুর জমি দান করা হয়েছে। নবগ্রাম হাজী মো. ছাইম হাই স্কুলের জন্য গ্রামে গ্রামে হেঁটে তিনি চাঁদা সংগ্রহ করেছেন। স্থানীয় শিক্ষার উন্নয়নে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। মাদার বাজার মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটিতে শিক্ষক প্রতিনিধি থেকে শুরু করে সহসভাপতি এবং বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘নবগ্রাম ইসলামিক কিন্ডার গার্টেন’ প্রতিষ্ঠাতাগণের অন্যতম জনাব মো: তাহির আলী প্রতিষ্ঠাতা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত পালন করছেন। প্রচলিত ব্যবসায়ী চিন্তাধারার বাইরে শত ভাগ শিক্ষানুরাগই এ কিন্ডার গার্টেন প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। এলাকার শিক্ষানুরাগী কয়েকজন ব্যক্তি যে মহৎ উদ্দেশ্যে এ কিন্ডার গার্টেন প্রতিষ্ঠা করেন তা হচ্ছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো আশানুরূপ মানসম্পন্ন শিক্ষা দানে ব্যর্থ হচ্ছে, তাই প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতিতে মান সম্পন্ন শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা এবং যেহেতু এ পদ্ধতি আর্থিক দিক থেকে লাভজনক সেহেতু এ থেকে অর্জিত লভ্যাংশ পুরোটাই সমস্যা জর্জরিত মাদার বাজার মাদ্রাসার ফান্ডে জমা করার অঙ্গীকার। তাঁদের এ মহতি সিদ্ধান্ত ও কর্মকান্ড সকল বিবেচনায়ই প্রশংসার দাবীদার এবং শিক্ষানুরাগের মূর্ত উদাহরণ। শিক্ষানুরাগী জনাব মোঃ তাহির আলীর আরো দু একটি কর্মকান্ডের বর্ণনা দিয়ে এ প্রসংগের ইতি টানব। মাদার বাজার এফ. ইউ. সিনিয়র মাদ্রাসার হিফজ শাখার চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রদের প্রতি বছর তিনি পাগড়ি দিয়ে উৎসাহিত করে যাচ্ছেন। অনেক গরীব ছাত্র-ছাত্রীকে বই-পুস্তক ও কাপড়-চোপড় দিয়ে লেখা পড়া চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে চলেছেন। ২০১১ সালের দাখিল পরীক্ষার্থী কয়েকজনের বোর্ড ফি তিনি পরিশোধ করেছেন। আমার জানামতে, কিছু ছাত্রের পুরো শিক্ষা জীবনের ব্যয়ভার চালিয়ে দেবার দায়িত্ব নিয়েছেন। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি এলাকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি।
এবার দরিদ্র বান্ধব হিসেবে তাঁর কিছু সেবার কথা উল্লেখ করছি। আমাদের এলাকার দরিদ্র লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। এদের কিছু সংখ্যককে সংঘবদ্ধ করে দারিদ্র বিমোচনে কয়েক দফা প্রচেষ্টা তিনি চালিয়েছেন কিন্তু সফলতা আসেনি। তবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তহবিল থেকে বিপন্ন লোকজনকে প্রায় সব সময় আর্থিক সহায়তা করে যাচ্ছেন। দারিদ্রহেতু অনেক কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা-মাতাকে দায়মুক্তির জন্য সহযোগিতা করেন। তাঁর বড় গুণ কোন প্রার্থীকে সচরাচর তিনি বিমুখ করেননা। কখনো কোন প্রার্থীর আব্দার পূরণ করতে না পারলে পরবর্তীতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে মিষ্ট বচনে তাকে বিদায় করেন। দানের টাকাও তিনি খামের ভেতর ভরে দিয়ে থাকেন। সম্ভবত: দান গ্রহীতার সম্মান হানির আশংকায় এবং দানের গোপনীয়তা রক্ষার তাগিদে এরূপ ব্যবস্থা। অনেক গরীব বিদেশ যাত্রীকেও তিনি আর্থিক সাহায্য করেছেন। ভিটে মাটিহীন কিছু পরিবারকে তাঁর নিজস্ব জায়গায় বসবাসের সুযোগ দিয়েছেন। আপতকালীন বিশেষ করে বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগে নিজের এবং পারিবারিক পরিমন্ডল থেকে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যান। ত্রাণসহ জনসেবামূলক কর্মকান্ডে পিতা-মাতার স্মৃতিকে স্থায়িত্ব দানের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে তাঁদের পরিবার ভিত্তিক সেবা সংগঠন ‘আয়শা-সিকন্দর মানব কল্যাণ ট্রাস্টে’র প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ ও বন্যা পরবর্তী সময়ে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও দরিদ্রদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করেন।
তাঁর আরেকটি গুণের কথা বলা প্রয়োজন। স্থানীয় রাস্তাঘাট নির্মাণে ও উন্নয়নে যেখানে নিজের জমি আছে সেখানে জমি দান করে, যেখানে জমি নেই সেখানে টাকা দিয়ে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে জমি ও টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বা করেন।
সাহিত্যচর্চা যেহেতু সমাজ সেবার অংশ তাই তাঁর এ গুণ সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে দু’ চারটি কথা বলে শেষ করছি। জনাব মোঃ তাহির আলীর দুটি গ্রন্থ-যথাক্রমে ১। স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ২। কবিতা কানন ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রকাশনার অপেক্ষায় আছে ধর্মতরী। সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। তিনি শুধু লেখক নন, অনেক লেখকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও কাজ করছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি নিরলস লেখালেখি করছেন। আমি আশাবাদী, এদিক থেকেও তিনি সমাজকে যথেষ্ট দান করার ক্ষমতা রাখেন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।