রবিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

প্রগতি: আমার প্রথম সম্পাদনা।। আব্দুর রশীদ লুলু



জানুয়ারি ১৯৮৩ সালে মাদার বাজার (ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, সিলেট)-এ স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে আমি গঠন করেছিলাম ‘তরুণ সাহিত্য পরিষদ’। লক্ষ্য ছিলো সম্মিলিতভাবে সাহিত্য চর্চা। এই সংগঠন গড়ে তুলতে আমার সাথে প্রচুর পরিশ্রম করেছে আমার জুনিয়র অথচ বন্ধু স্থানীয় মোঃ আব্দুল ওয়াহিদ (বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী)। তরুণ সাহিত্য পরিষদ গড়ে তুলতে ও টিকিয়ে রাখতে আমাকে বহু প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে। মাদার বাজার এলাকায় আমার বাড়ী নয়। তবে লেখাপড়া এবং নানাবিধ কাজে প্রায় এক দশক আমাকে ওখানে কাটাতে হয়েছে। ওই এলাকার সাহিত্য-সামাজিক কাজে এতো ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম যে, অনেকে মনে করতো মাদার বাজার আমার জন্মস্থান। পরবর্তী জীবনে অবশ্য আমি আমার সম্পাদিত ‘আনোয়ারা’ (অনিয়মিত শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা)-এ মাদার বাজার এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বিশেষ ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরার মাধ্যমে ওই এলাকার কিছু ঋণ পরিশোধের আন্তরিক চেষ্টা করেছি।

যা হোক, তরুণ সাহিত্য পরিষদের মাধ্যমে আমরা একটি পাঠচক্র ও সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর পরিচালনা করি। এক সময় আমাদের সাথে আন্তরিকভাবে সংশ্লিষ্ট হন আমাদের সিনিয়র অথচ বন্ধু স্থানীয় মোহাম্মদ মনফর আলী (বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকে ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত)। যিনি এক সময় তরুণ সাহিত্য পরিষদের প্রকাশনা ‘প্রগতি’র মাধ্যমে লেখালেখিতে সক্রিয় হন। স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় তার বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর দুঃখজনকভাবে তিনি লেখালেখিতে বর্তমানে নিষ্ক্রিয়। তরুণ সাহিত্য পরিষদ ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সক্রিয় থাকার পর এর সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই পেশাগত কারণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লে এর বিলুপ্তি ঘটে। যা হোক, প্রতিষ্ঠার পর পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এর প্রকাশনা ‘প্রগতি’ (অনিয়মিত সাহিত্য পত্র) আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। তখন স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, তখন আমি মোহাম্মদ আবদুর রশীদ নামে লিখতাম (বর্তমান নামে ২০০২ সাল থেকে লিখছি)। লেখা প্রকাশিত হলেও সম্পাদনার ব্যাপারে তখন আমি ছিলাম একেবারে আনাড়ী। ‘প্রগতি’ প্রথম সংখ্যার সম্পাদনা ও প্রকাশনায় আমাকে প্রচুর সহযোগিতা করেন আমার মামাতো ভাই কবি মুকুল ইকবাল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমার সমবয়সী মুকুল ইকবাল আশির দশকে সিলেটের সাহিত্যাঙ্গনে ছিলেন সরব। দীর্ঘদিন ধরে তিনি স্বপরিবার ইংল্যান্ড প্রবাসী এবং লেখালেখিতে অনিয়মিত। বিভিন্ন সময়ে আমার সম্পাদনার ‘প্রগতি’ ছয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়।

‘প্রগতি’ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়, মে- ১৯৮৩ সালে। প্রথম সংখ্যায় আমার অনুরোধে গণ-মানুষের কবি দিলওয়ার লিখেন সনেট কবিতা- ‘মাদার বাজারে প্রেম।’ চমৎকার সে কবিতা থেকে কিছু তুলে ধরা যায়- “হাজারো বছর আগে এই স্নিগ্ধ মাদার বাজারে/ প্রকৃতির সাধ ছিলো গর্ভবতী নারীর মতোন/ জন্ম দেবে পুত্র-কন্যা দুচোখের মাণিক রতন/ যেন বা সুখাশ্রু তারা জননীর কন্ঠ মণিহারে।” ‘প্রগতি’ এই সংখ্যায় ‘নিত্য দিনের শহর’ নামে মুকুল ইকবালেরও একটি ভালো কবিতা প্রকাশ পায়। তার কবিতার শেষের লাইনগুলো হচ্ছে- ‘ভাবছি এবার অন্য কিছু চুপিচুপি/ তুমি হলে মানসী আমার বহুরূপী/ অনেক শুনা নরোম ঠোঁটের স্বরলিপি।’ এ সংখ্যার প্রথম পৃষ্টায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয় আমার প্রিয় শিক্ষক জনাব আব্দুল মন্নান (মরহুম)- এর ‘পরিবর্তনশীল রীতি-নীতি’ শীর্ষক মূল্যবান প্রবন্ধ। এ সংখ্যায় আরেকট উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হচ্ছে প্রবীণ শিক্ষক-লেখক জনাব মোঃ আব্দুর রউফের- বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান।’ এছাড়াও এ সংখ্যায় লিখেছেন- তকুল রানা, দীপক চন্দ্র দত্ত, মোঃ আতিকুর রহমান, সমৃতি রাণী দে, মোঃ আব্দুল ওয়াহিদ, নুরুল আমীন মানিক, মোঃ এনামুল হক, মোঃ নজরুল ইসলাম প্রমুখ।

‘প্রগতি’ দ্বিতীয় সংখ্যা খুব সম্ভবতঃ ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় (সাল মাস পুরোপুরি মনে পড়ছে না। এই সংখ্যার কোন কপিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।। যতদূর মনে পড়ে, এ সংখ্যায় লিখেন- মুকুল ইকবাল, মোহাম্মদ মনফর আলী, মোঃ নজরুল ইসলাম প্রমূখ। সাপ্তাহিকী ‘সুর’- সম্পাদক কবি সিরাজ চৌধুরীর আমার গৃহীত সাক্ষাৎকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য লেখক হচ্ছেন- আতাউর রহমান মিলাদ, প্রথম সারথি ঘোষ, ময়নুর রহমান বাবুল, হাফিজ মোঃ আবু সাঈদ প্রমুখ।

‘প্রগতি’ চতুর্থ সংখ্যা প্রকাশিত হয় এপ্রিল ১৯৮৭ সালে। এতে কবি-সাংবাদিক-গীতিকার মহিউদ্দিন শীরু – এর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করি আমি। শীরু ভাইয়ের সাক্ষাৎকার গ্রহণে সক্রিয় সহযোগিতা করেন মোহাম্মদ মনফর আলী। এছাড়া এ সংখ্যায় লিখেন- সিরাজ চৌধুরী, আব্দুল বাসিত মোহাম্মদ, মোহাম্মদ মনফর আলী, মোঃ আব্দুল ওয়াহিদ প্রমুখ।

‘প্রগতি’ পঞ্চম সংখ্যা প্রকাশিত হয় মে ১৯৮৮ সালে। এ সংখ্যারও প্রথম পৃষ্ঠায় আমার গৃহীত কবি লাভলী চৌধুরীর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যায় লিখেন- সিরাজ চৌধুরী, চন্দন কৃষ্ণ পাল, মোঃ মুজিবুর রহমান শাহীন, মোঃ মুজিবুর রহমান মুজিব, মোঃ আব্দুল ওয়াহিদ, কৃষ্ণ ইসলাম অলিদ প্রমুখ।

‘প্রগতি’ যষ্ঠ এবং শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় মার্চ ১৯৮৯ সালে। এ সংখ্যায় কবি-সাংবাদিক শামসাদ হুসাম- এর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। শামসাদ আপার সিলেট শহরের হাউজিং এস্টেটস্থ বাসা থেকে এক সন্ধ্যায় সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করি আমি। এই সাক্ষাৎকার গ্রহণে আমাকে আন্তরিক সহযোগিতা করেন প্রখ্যাত ‘কাফেলা’ সম্পাদক, কথাশিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ (মরহুম)। এ সংখ্যায় গণ-মানুষের কবি দিলওয়ার- এর ‘মাদার বাজারে প্রেম’ কবিতাটি পুনঃমুদ্রিত হয়। এছাড়া এ সংখ্যার উল্লেখযোগ্য লেখক হচ্ছেন- লাভলী চৌধুরী, সাগর সৈকত, চৌধুরী জ্যোৎস্না পারভীন চপল, শাহাব উদ্দিন শাহীন প্রমুখ।

উল্লেখ্য ‘প্রগতি’ প্রতি সংখ্যার মূল্য ছিল দুই টাকা। ‘প্রগতি’ প্রকাশনায় অন্যান্যদের সাথে আর্থিক বিশেষ সহযোগিতা করেন তৎকালীন উছমান পুর ইউপি চেয়ারম্যান এবং পরবর্তীতে বালাগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মৌলভী ফজলুর রহমান। সে কথা আমি নির্দ্বিধায় ‘প্রগতি’ তৃতীয় সংখ্যা (জানুয়ারি ১৯৮৭)’র সম্পাদকের কথায় বলেছি। আশির দশকে ‘প্রগতি’ সম্পাদনার পাশাপাশি আমার সম্পাদনায় বিভিন্ন সময়ে দেয়ালিকা ‘স্মৃতি’ চার সংখ্যা তরুণ সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। ‘স্মৃতি’ প্রথম দু’ সংখ্যা লিখন ও অংকনে ছিলেন তৎকালীন মাদার বাজার এফ.ইউ. সিনিয়র মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা মোঃ আতিকুর রহমান। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন রুচির বইপ্রেমী জনাব রহমান বর্তমানে তাঁর নিজ এলাকা জকিগঞ্জের একটি মাদ্রাসায় কর্মরত আছেন।

‘স্মৃতি’ প্রথম সংখ্যায় প্রবীণ শিক্ষক- লেখক জনাব মোঃ আব্দুর রউফ লিখেন- ‘অভিপ্রেত স্মৃতি’ নামক চমৎকার কবিতা। তাঁর কবিতার শেষ দু’লাইন- ‘স্মৃতি যেন কভূ বিস্মৃতি না হয় অবেলায় কোনো সাজে/ চিরদিন ইহা স্মৃতি হয়ে থাক, সবার হৃদয় মাঝে।’ কালের করালগ্রাসে ‘স্মৃতি’ আজ হারিয়ে গেলেও আমার হৃদয় মাঝে কখনো অলস সময়ে আজও ‘স্মৃতি’ অন্য রকম দ্যোতনা আনে। ‘প্রগতি’ এবং ‘স্মৃতি’ ছাড়াও ইতোমধ্যে আমি সম্পাদনা করেছি- রক্ত জবা (তিন সংখ্যাঃ প্রথম সংখ্যা- ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯, দ্বিতীয় সংখ্যা- ২৬ মার্চ ১৯৮৯ এবং তৃতীয় সংখ্যা- ১৪ জুলাই ১৯৮৯), আব্দুল মন্নান স্মারক গ্রন্থ (ডিসেম্বর- ২০০৪), আব্দুল মন্নানঃ ঝরে যাওয়া এক নক্ষত্র (২৫ ফেব্রুয়ারি-২০০৬), আল-বির (শাহ্ আব্দুল করিম সংখ্যা, ৫ আগষ্ট ২০০৬) এবং যতীন্দ্র মোহন সোম স্মারক (২০ জুন ২০০৯)।

উল্লেখ্য, পরিকল্পনা আছে ভবিষ্যতে আরো ৩/৪টি বই (যেমন-প্রথম লেখা প্রথম বই, হোমিওপ্যাথি: আমি কেন ভালোবাসি, হোমিওপ্যাথির জনক হ্যানিম্যানকে নিবেদিত শত কবিতা) সম্পাদনার। এছাড়া নভেম্বর ২০০৪ সাল থেকে সম্পাদনা করে আসছি আমার প্রিয় শিকড় সন্ধানী অনিয়মিত প্রকাশনা ‘আনোয়ারা’। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে ‘আনোয়ারা’ অনেকগুলো সংখ্যা বেরিয়েছে এবং পাঠক নন্দিত হয়েছে। তবু আমার প্রথম সম্পাদনা ‘প্রগতি’র আনন্দ- অনুভূতি আলাদা। ওই সময়ে ‘প্রগতি’ সম্পাদনার আনন্দ-অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব। ‘প্রগতি’ আমাকে দিয়েছে সাহিত্যাঙ্গনে অনেকটা পরিচিতি। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমি আজ সাহিত্যাঙ্গনে বিচরণ করছি। ‘প্রগতি’ সম্পাদনা ও প্রকাশনার সেই শ্রম আজ তাই সার্থক ভাবি।

লেখক: ইসলাম ধর্ম, হোমিওপ্যাথি ও কৃষি বিষয়ক লেখক ও গবেষক।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!