রবিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

ভাষা আন্দোলন : বাংলাদেশ, আসাম এবং মানভূম।। দীপংকর শীল



বিশাল ভারতবর্ষে বহু জাতি ও ভষাভাষী মানুষের বর্ণিল অবস্থানে ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ। এখানে আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, চীন, শক, হুন, পাঠান, মোগল এক দেহে লীন হওয়ার গৌরববোধ করলেও ইতিহাস ও রাষ্ট্রনৈতিক নানা কারণে ভাষা বিড়ম্বনার শিকার হয়েছে। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষদেরকে ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য রক্তাক্ত পরিস্থিতিরও সম্মখীন হতে হয়েছে। এরমধ্যে বিভাগোত্তর পাকিস্তানে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে নামতে হয়েছে। মুসলিম জাতীয়তাবোধকে ধারণ করে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হলেও বাংলা ভাষার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দ্রুতই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধে উপনীত এবং এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। একুশে ফেব্রুয়ারির মতো ভারতের আসাম ও মানভূমেও সংঘটিত হয়েছে ভাষা আন্দোলন। দেশ আলাদা হওয়া সত্ত্বেও এ তিনটি ভাষা আন্দোলন এক অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। ভারতবর্ষে আমরা বাংলাদেশ, মানভূম ও আসামের ভাষা আন্দোলন এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার প্রয়াস নিতে পারি।


১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র করে। বাঙালি জাতি এ অন্যায় প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সর্বস্তরের বাঙালি জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয় এবং আন্দোলন পরিচালনা করে। এ আন্দোলনের ঘটনা প্রবাহে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এ সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রশাসনিক কাজ থেকে সরকার বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়। মানি অর্ডার ফর্ম, ডাক টিকিট, মুদ্রা ইত্যাদিতে শুধু ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহার করা হয়। ফলে পূর্ব বাংলার জনমনে যথেষ্ট উদ্বেগ ও বিরুদ্ধ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। এ পরিষদের পক্ষ থেকে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে মানি অর্ডার, ডাকটিকিট ও টাকায় ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা লেখার আবেদন জানানো হয়। মূলত ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের পর থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভাষার বিষয়টি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল উর্দু এবং ইংরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হোক। ২৫ ফেব্রুয়ারি এ সংশোধনী প্রস্তাবের উপর আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের তীব্র বিরোধিতার মুখে তা বাতিল হয়ে যায়। এ প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে গেলেও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর এ সাহসী ভূমিকা বাঙালি জাতিকে পরবর্তী আন্দোলন সংগ্রামে যথেষ্টভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাব বাতিল এবং বাংলা ভাষা বিরোধী সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয়। ২ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে কামরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় পূর্বতন ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ বিলুপ্ত করে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। এ পরিষদের দাবি ছিল- ক) বাংলা ভাষা হবে পূর্ব বাংলার একমাত্র শিক্ষার বাহন এবং অফিস আদালতের প্রধান মাধ্যম। খ) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি, বাংলা এবং উর্দু। এ পরিষদের আহ্বানে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। এ দিন মিছিল থেকে শেখ মুজিব, শামসুল হক, অলি আহাদ সহ ৬৯ জন গ্রেফতার হন। বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশি নির্যাতন এবং গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৩ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা শহরের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ১৪ মার্চ সারা পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। পরবর্তী তিন বছর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সংগঠন ১১ মার্চকে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করেছে।

এভাবে একের পর এক আন্দোলন কর্মসূচি চলাকালীন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফর করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এটাই ছিল তাঁর প্রথম সফর। ১৯ মার্চ ১৯৪৮ তিনি ঢাকা আগমন করেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক সংবর্ধনা সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘. . . পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়।’ জিন্নাহর এরূপ বক্তৃতায় উপস্থিত ছাত্র-জনতা খুবই হতাশ হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদও জানানো হয়। এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি আবারও ঘোষণা করেন, ‘টৎফঁ ধহফ ড়হষু টৎফঁ ংযধষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ’। এই ঘোষণামাত্র হলের ছাত্ররা ‘না, না’ ধ্বনি করে তার প্রতিবাদ জানায়। জিন্নাহর এই ঘোষণায় দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়।

ঐদিন সন্ধ্যা অর্থাৎ ২৪ মার্চ ৬:৩০ মিনিটে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এর একটি প্রতিনিধি দল জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। কিন্তু জিন্নাহ প্রতিনিধি দলের দাবি অগ্রাহ্য করেন।

পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতাদের বাংলা বিরোধী চক্রান্ত শুধু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য তারা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারমধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ষড়যন্ত্র ছিল বাংলা বর্ণমালার পরিবর্তে আরবি বর্ণমালার প্রবর্তনের উদ্যোগ। নানা প্রতিবাদের ভিতরেও তারা ১৯৫১ সাল পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালা উচ্ছেদের প্রয়াস অব্যাহত রাখে। কিন্তু এদেশের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষের আন্দোলনের ফলে সরকারের এসব ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

ভাষা আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে বন্দি ছিলেন। এসময় তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব পূর্ব পাস্তিানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা আইনসভায় করেছিলেন, ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তা ভেঙ্গে পল্টনের জনসভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।’ তখন প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। আমি তখন বন্দি অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত্রের অন্ধকারে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের দিন স্থির করা হয়। কারণ ২১শে থেকে বাজেট সেশন শুরু হবে।’(শেখ মুজিবুর রহমান- কারাগারের রোজনামচা) ২১শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য তৎকালীন গভর্নর নুরুল আমীন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদ এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিছিল বের করলে পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার এক মারাত্মক সংঘর্ষ বাঁধে। এক পর্যায়ে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালালে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে প্রাণ হারান এবং আহত হন বহু সংখ্যক। ফলে সারা বাংলায় আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকায় এ ঘটনার প্রতিবাদে তিনদিন একটানা হরতাল পালিত হয় এবং দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে।

অবশেষে তীব্র আন্দোলনের মুখে সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং সাময়িকভাবে প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ সম্বলিত একটি প্রস্তাব প্রাদেশিক পরিষদে উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অতঃপর ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দিলে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জিত হয়।


একুশের ৯ বছর পর ১৯৬১ সালের ১৯শে মে বরাক উপত্যকা তথা আসামের শিলচরে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্যভাষা করার দাবিতে সংঘটিত আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন আরও এগার জন বাঙালি। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া দুটি দেশেই বাংলা ভাষাকে দাবিয়ে রাখার খেলায় মেতে উঠেছিল শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু কোটি কোটি লোক যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার দুঃসাহসী ঘৃণিত ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত জবাবও দেয় বাংলা ভাষীরা। সুদূর অতীতকাল থেকেই বাংলা ভাষার উপর অন্যান্য ভাষার আক্রমণকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রতিহত করে উর্দু, হিন্দি ও অসমিয়া ভাষার কূটচালকেও মোকাবেলা করে বাংলা ভাষা আজ কেবল তার প্রাণশক্তির জোরেই মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।

‘বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন’-এর পেছনের ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৩১ সালের আদমশুমারিতে আসামে বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে আসামে জাতিগত দাঙ্গা এবং ‘বাঙালি খেদাও’ আন্দোলনের ফলে বাঙালিদের সংখ্যা কমতে থাকে। ফলে আসামের বিভিন্নভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালিরা ১৯৫৬ সালের আদমশুমারিতে প্রথম স্থান থেকে নেমে দ্বিতীয় স্থানে চলে আসে। ১৯৫৩ সালে অসমিয়া ভাষা এবং ইংরেজি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আইন প্রস্তুত করা হয়। ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসাম বিধান সভায় ‘রাজ্য ভাষা বিল’ পাস হলো। এই আইনে অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্য ভাষা ঘোষণা করা হয় আর বাংলা ভাষাকে বঞ্চিত করা হয়। অথচ ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর থেকে আসামের বিধান সভায় শপথ গ্রহণ ও ভাষণের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন ছিল। এই আইনের মাধ্যমে আসামের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে তার প্রাপ্ত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হলো। ফলে আসামের বাঙালিদের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আন্দোলন গড়ে উঠে। ‘রাজ্যভাষা বিল’ পাস হওয়ার পর ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জের রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে ‘কাছাড় জেলা জন সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের পরে গঠন করা হয় ‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ’। প্রতি মহকুমায়ও গঠিত হয় আলাদা আলাদা কমিটি। কাছাড়ের অপর দুই মহকুমা করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির প্রতি পাড়া, মহল্লা জনপদে বাংলাকে রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলে। সভা, সমাবেশ, পোস্টার, লিফলেটিং, আলাপ, আলোচনা, পদযাত্রার মাধ্যমে মানুষ তার মতামত প্রকাশ করতে থাকে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯শে মে আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে রেলপথ অবরোধ করা হয়। বিএসএফ এই অবরোধকে তুচ্ছ জ্ঞানে উপেক্ষা করে গুলি বর্ষণ করে। ঘটনাস্থলে শহীদ হন—১) কমলা ভট্টাচার্য ২) শচীন্দ্র পাল ৩) বীরেন্দ্র সূত্রধর ৪) কানাইলাল নিয়োগী ৫) চন্ডীচরণ সূত্রধর ৬) সত্যেন্দ্র দেব ৭) হীতেশ বিশ্বাস ৮) কুমুদ রঞ্জন দাস ৯) তারিণী দেবনাথ ১০) সুনীল সরকার ১১) সুকুমার পুরকায়স্থ এবং আহত হন অসংখ্য আন্দোলনকারী। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে ঢাকার রাজপথের মতো শিলচরের রেলপথ রক্তে রঞ্জিত হলো। এই বর্বর হত্যাকা-ের প্রতিবাদে পুরো বরাক উপত্যকায় সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ-মিছিল, স্মরণ সভার মধ্য দিয়ে শহীদদের প্রতি সম্মান এবং মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দীপ্ত শপথে বরাক উপত্যকা উত্তাল হয়ে উঠলে আসামের বাঙালিদের প্রতি ত্রিপুরা-পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতীয় বাংলাভাষী ও সাধারণ জনগণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। অবশেষে সরকার বাধ্য হয়ে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়া ভাষার সাথে বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এই স্বীকৃতির ফলে সরকারি অফিস-আদালতের নামফলক, সাইনবোর্ড, দাপ্তরিক কার্যাবলি, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যবহারের অধিকার নিশ্চিত হয়। [১৯ মে ভাষা আন্দোলন ও আমাদের কৈফিয়ৎ, দৈনিক জনকণ্ঠ] এভাবে একুশের উত্তরসূরি উনিশের অবদানও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হলো।


একুশে-উনিশের ভাষা আন্দোলনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত হয় ‘মানভূমের ভাষা আন্দোলন’। অথচ এই আন্দোলনের কাল পরিধি সবচেয়ে দীর্ঘ—যার সূচনা হয় ১৯১২ সালে। কারণ, ব্রিটিশ সরকার ১৯১২ সালের এপ্রিল মাসে সুবে বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করে। একটি পশ্চিমবঙ্গ—যার রাজধানী কলকাতা। অপরটি বিহার-ওড়িশা প্রদেশ—তার রাজধানী হয় পাটনা। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল মানভূমকে হিন্দি ভাষা প্রধান বিহার-ওড়িশা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলা ভাষাভাষী এলাকাকে কেন বিহার-ওড়িশার সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, সে নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। তখন থেকেই শুরু হয় মানভূমের ভাষা আন্দোলন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সাফল্যের আনন্দ এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সামনে থাকায় মানভূমের ভাষা আন্দোলন তখন জমে উঠেনি। এই সময় আন্দোলনের ব্যাপক প্রসার না হলেও বাংলা ভাষার উপর হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলতে থাকে। বিহার সরকার যখন অফিস-আদালত, শিক্ষার মাধ্যম তথা দাপ্তরিক কাজে হিন্দিভাষাকে চালু করেন এবং মানভূমের বাংলা ভাষাভাষীকেও হিন্দি ব্যবহার করতে নির্দেশ দেন, তখন মানভূমের সচেতন ও ভাষাপ্রেমি বাঙালি জনগণ প্রিয় বাংলা ভাষার উপর হিন্দির আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেন।

এই প্রতিবাদের যুক্তিসঙ্গত কারণ হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জগগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে বিহার সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ। ১৯৩১-এর আদমশুমারিতে এই প্রদেশে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের সংখ্যাই বেশি দেখা যায়, অর্থাৎ, ১৮,১০,৮৯০ জনের মধ্যে ১২,২২,৮৮৯ জনই বাংলাভাষী। ১৯৪১-এর আদমশুমারির হিসাব অনুযায়ী ২০,৩২,১৪৬ জনের মধ্যে ১৮,৫৭,২৮৪ জন বাংলাভাষী। অর্থাৎ ১০ বছরে বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৬,৩৪,৩৯৫ জন। বাকিদের মধ্যে সাঁওতালি, হিন্দি আর কিছু আদিবাসী ভাষাভাষী মানুষ ছিলেন। এই হিসাব বিহার প্রদেশের নেতাদের মাথা ব্যথার কারণ ছিল। বিশেষত ১৯৩৬ সালে ওড়িশা পৃথক রাজ্য হলে বিহার প্রদেশের কংগ্রেস নেতাদের বড় অংশ মনে করতে থাকেন যে, মানভূমও ভাষার কারণে বিহার থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এতে ধানবাদ সমেত বিস্তীর্ণ খনি ও শিল্পাঞ্চল হাতছাড়া হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে ‘মানভূম বিহারী সমিতি’ গঠিত হয়। হিন্দিভাষা প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে স্কুল তৈরির কাজ শুরু হয়। হিন্দিভাষী নেতৃবৃন্দের এই মনোভাবের পাল্টা জবাব এবং বাংলা ভাষার উপর হিন্দি ভাষার আধিপত্যকে ঠেকাতে গিয়ে বাংলা ভাষা প্রচার ও প্রসার এবং স্কুল নির্মাণের জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ভাই প্রফুল্ল রঞ্জন দাসের নেতৃত্বে গড়ে উঠে ‘বাঙালী সমিতি’। তার মুখপত্র হিসেবে ১৯৩৫ সালে ‘মানভূম সমিতি’ পত্রিকার সূচনা হয়। পরে ‘সংগঠন’ নামে আরও একটি পত্রিকা চালু করা হয়। এভাবে চলতে থাকে ভাষা আন্দোলন।

১৯৩৭ সালে বিহারের কংগ্রেস মন্ত্রিসভা ‘ডোমিসাইল সার্টিফিকেট’ প্রথার মাধ্যমে বাংলাভাষীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করলে ভাষা আন্দোলন আরও জোরালো হয়। ১৯৩৯-এ কংগ্রেস মন্ত্রিসভা ভেঙে যায়। এই সময় কয়েকজন নেতা রাঁচী, সিংহভূম, পালামৌ, হাজারিবাগ ও মানভূম নিয়ে ‘ছোটনাগপুর’ রাজ্য তৈরির চেষ্টা করেন। চলতে থাকে টানাপড়েন। ভাষা আন্দোলন তখনকার মতো ভাষার জন্য লড়াই রূপে থেকে গেলেও স্বাধীনতার পরে তা জোরদার মাতৃভাষা আন্দোলনের রূপ নেয়।

১৯৪৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জয়পুর অধিবেশনে ভাষানীতির উপরে আলোচনা হলেও মানভূমের ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয়নি। কারণ, স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারত বিভাজনের সময়ে বিহার প্রদেশের বাংলাভাষী অঞ্চলকে পশ্চিমবঙ্গে আনার দাবিকে জাতীয় নেতারা ‘সেপারেশন মুভমেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। স্বাধীনতার চারদিনের মাথায় জামসেদপুরে ‘বিহার বাঙালী সমিতি’র বাৎসরিক সভা হয়। সেখানে উদ্বোধনী ভাষণে নগেন্দ্রনাথ রক্ষিত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বাংলার বাঙালি জাতিকে তার গৌরবময় ঐতিহ্য নিয়ে বেঁচে থাকার লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গকে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে সিংহভূম, মানভূম, সাঁওতাল পরগনা ও ভাগলপুরের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল ও পূর্ণিয়া জেলাকে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। ওই সভায় প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ-সহ বহু ভাষাকর্মী বিহারীদের হাতে আক্রান্ত হন। এর সঙ্গে শুরু হয় সরকারি দমন-পীড়নও। হিন্দি শিক্ষা না দিলে স্কুলের অনুদান বন্ধের নোটিশ জারি হয়। আদিবাসী স্কুলগুলিকে হিন্দি স্কুলে পরিণত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৯৪৮-এ এমন ৩০০টি স্কুল পরিবর্তিত হয়। ২৩টি স্কুলের অনুমোদন বাতিল হয়। বাংলা মাধ্যমে পড়ালে শিক্ষকদের শাস্তির বিধান দেওয়া হয়।(বিভাসকান্তি ম-ল, লড়াইয়ের শুরু বঙ্গভঙ্গের সময়ে)

ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় টুসু আন্দোলন। ভজহরি মাহাতো সহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লেখা ‘টুসু গানে মানভূম’ বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। টুসু গানকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে আন্দোলনে প্রাণ আসে। ফলে বিহার সরকার টুসু গানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং টুসু গান গাওয়ার জন্য অনেককে কারারুদ্ধ করে। জনগণ সরকারের প্রতি ধিক্কার জানাতে থাকে। ১২ জানুয়ারি থেকে অতুলচন্দ্র ঘোষ সরকারি বাধা উপেক্ষা করে টুসু গানে জেলাকে মুখরিত করার নির্দেশ দেন। সমগ্র মানভূমে টুসু সত্যাগ্রহ ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সরকারের দমন-পীড়নও বাড়তে থাকে। ১৯৫৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি টুসু সত্যাগ্রহ শেষ হয়। টুসু সঙ্গীতে আন্দোলনের বিষয়বস্তু চমৎকারভাবে ধরা পড়ে। মধুসূদন মাহাতো তাঁর গানে হিন্দি ভাষার আক্রমণ প্রতিহত করতে মাতৃভাষা বাংলার ধ্বজা হাতে নিয়ে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান এভাবে—

মন মানে না রে হিন্দি সইতে।
ভাষা মোদের হরে নিল হিন্দিতে ॥
মাতৃভাষা হরে যদি
আর কি মোদের থাকে রে।
(তাই) মধু বলে মাতৃভাষার
ধ্বজা হবে বহিতে ॥

বিহার সরকারের বাংলা ভাষা বিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভজহরি মাহাতোর প্রতিবাদী গানটি ‘মানভূম ভাষা আন্দোলন’-এর ‘থিম সঙ’-এ পরিণত হয়েছিল। এই গানে একদিকে যেমন হিন্দিভাষী ভাইদের কূটচালকে চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে সমালোচনা করেছেন, অন্যদিকে তেমনি সর্বভারতীয় চেতনাকেও সমুন্নত করেছেন। তাঁর অবিনাশী গানটি নিম্নরূপ:

শুন বিহারী ভাই
তোরা রাখতে নারবি ডাঙ্গ দেখাই
(তোরা) আপন স্বার্থে ভেদ বাড়ালি
বাংলা ভাষায় দিলি ছাই।
ভাইকে ভুলে করলি বড়
বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই ॥
বাঙালী বিহারী সবাই
এক ভাষাতে আপন ভাই।
বাঙালীকে মারলি তবু
বিষ ছড়ালি হিন্দী চাই ॥
বাংলা ভাষার দাবীতে ভাই
কোন ভেদের কথা নাই।
এক ভারতে ভাইয়ে ভাইয়ে
মাতৃভাষার রাজ্য চাই ॥

অরুণচন্দ্র ঘোষ টুসু গানের মাধ্যমে মাতৃভাষায় আবহমান কালের স্মৃতিচারণ করে সকলের অবরুদ্ধ আবেগগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং বিহারের হিন্দিভাষী কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের ঘৃণ্য রাজনীতির কথা প্রতিবাদী ভাষায় টুসু সঙ্গীতের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

আমার বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে।
(ও ভাই) মারবি তোরা কে তারে ॥
বাংলা ভাষা রে ॥
এই ভাষাতে কাজ চলেছে
সাত পুরুষের আমলে।
এই ভাষাতেই মায়ের কোলে
মুখ ফুটেছে মা বলে ॥
এই ভাষাতেই পরচা রেকর্ড
এই ভাষাতেই চেক কাটা
এই ভাষাতেই দলিল নথি
সাত পুরুষের হক পাটা ॥
দেশের মানুষ ছাড়িস যদি
ভাষার চির অধিকার
দেশের শাসন অচল হবে
ঘটবে দেশে অনাচার ॥

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের স্বার্থবুদ্ধির ফাঁদে পড়ে ভুক্তভোগী হয় সাধারণ মানুষ। এই দুষ্টবুদ্ধি সম্পন্ন রাজনীতিকদের চরিত্র ধরা পড়েছে জগবন্ধুর গানে।

প্রাণে আর সহে না
হিন্দি কংগ্রেসীদের ছলনা।
ইংরেজ আমলে যারা গো
করত মোসাবিয়ানা
এখন তারা হিন্দি-কংগ্রেসি
মানভূমে দেয় যাতনা।

টুসু গানের মাধ্যমে যেমন বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর উচ্চকিত হয়েছে তেমনি শোষণের প্রতিকারের কথাও ধ্বনিত হয়েছে। এই গান দাবি আদায়ে শক্তি যুগিয়ে আন্দোলনকে বেগবান করেছে। বিহার সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন নীতিও আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারেনি। এই আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি আসে লোকসেবক সঙ্ঘের নেতৃত্বে পুরুলিয়া থেকে কলকাতা পদযাত্রায়। অবশেষে পরিস্থিতি বিবেচনায় কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হন। জানানো হয় যে, ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠন হবে। এই ঘোষণার পরে কমিশন পুরুলিয়ায় এসে বিভিন্ন জনের সাক্ষ্য নেয়। সেই পর্বে লোকসেবক সঙ্ঘ ১৪ ট্যাঙ্ক নথি কমিশনের সদস্যদের কাছে উপস্থিত করেছিলেন। সেই নথির মধ্যে বাংলায় লেখা চিঠিপত্র, পুঁথি, জমির দলিল এমনকি পঞ্জিকাও ছিল। বিপুল নথি দেখে কমিশনের প্রতিনিধিগণ নিশ্চিত হন যে, এই এলাকার মানুষজন বাংলা ভাষাই ব্যবহার করেন। কমিশনের প্রতিনিধিগণ বিভিন্ন জায়গায় সাক্ষ্য গ্রহণের পরে ঠিক করেন সাবেক মানভূমের ৩১টি থানার মধ্যে ১৯টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া গঠন করা হবে। এই ১৯টি থানাই ছিল বাংলা ভাষাভাষী এলাকা। পরে অবশ্য ১৪টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা গঠিত হয়। ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর মানভূম জেলা দ্বিখ-িত হয়ে পুরুলিয়া নাম নিয়ে বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়।[পুরুলিয়ার জন্মদিন, আনন্দবাজার] এভাবে অনেক আন্দোলন সংগ্রামের ভিতর দিয়ে বাংলা ভাষা তার ন্যায্য অধিকার আদায় করেছে।

বাঙালির এই তিনটি ভাষা আন্দোলনেই দেখা যায় বিভাষী শাসক শ্রেণি নিজেদের নিয়ন্ত্রণকে পাকাপোক্ত করার জন্য বাংলা ভাষাকেই আক্রমণ করেছে। বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখার জন্য শাসনকার্য থেকে বাংলা ভাষাকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এমনকি শিক্ষার মাধ্যম থেকেও বাংলা ভাষাকে সরিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষা চর্চার পথ বন্ধ করে বাঙালি জাতিকে দুর্বল করে দিতে চেয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করতেও চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। তিনটি ক্ষেত্রেই শাসকগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অপকৌশল গ্রহণ করেছে। এর পেছনে বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার প্রতি বিভাষী রাজনীতিকদের ঈর্ষাবোধ প্রবল ছিল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র বরাত দিয়ে বলা যায়, ভারতের ১৭৯টি ভাষার মধ্যে হিন্দির পরে একমাত্র বাংলা ভাষাই ভারতের সাধারণ ভাষা হওয়ার যোগ্যতা রাখে। সাহিত্যশক্তির দিক দিয়ে বাংলা যেমন একটি শক্তিশালী ভাষা তেমনি রয়েছে এর পরিপাটি অক্ষর ও দ্রুত লিখনের ক্ষমতা। সহজত্ব ও মিষ্টত্বের দিক দিয়েও বাংলা অদ্বিতীয়। বাঙালির আকাশছোঁয়া ব্যক্তিত্বসহ একসাথে এত গুণাবলি অর্জন করতে পারায় বিভাষী রাজনীতিকগণ ঈর্ষান্বিত হয়ে বাংলা ভাষাকে আক্রমণ করেছে। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। আপাতদৃষ্টিতে উর্দু-হিন্দি-অসমিয়ার আগ্রাসন থেকে বাংলা ভাষাকে মুক্ত করার জন্য ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হলেও নিহিতার্থে এই আন্দোলন পৃথিবীর ছোট-বড় সকল ভাষার মর্যাদার জন্য লড়াই করেছে এবং তা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত ভাষাভাষী মানুষের কাছে বাংলা ভাষার প্রতি সমীহ জাগাতেও সক্ষম হয়েছে।

এই ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সাফল্য হলো ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটানো এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা। এটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের চরিত্র থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনের চরিত্রে উন্নীত হয়েছে। পূর্ব বংলার মানুষ বাঙালি মুসলমান অধ্যুষিত হলেও তারা বিভক্ত ও অবিভক্ত ভারতবর্ষে নানাভাবে শোষিত ও বঞ্চিত ছিল। অবিভক্ত ভারতবর্ষে হিন্দু জমিদারদের দ্বারা শোষিত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানি মুসলমান শাসকগোষ্ঠী দ্বারা নির্যাতিত, শোষণ-বঞ্চনার দ্বারা পীড়িত হয়েছে। ফলে এই বাঙালি মুসলমানদের নবতর পাকিস্তানের ব্যাপারে মোহমুক্তি ঘটে। বাঙালি মুসলমানের এ মোহমুক্তিকে গবেষক বদরুদ্দীন উমর বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হিসেবে দেখেছেন। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যেই পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা ও প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৫২ সালে তার সূচনা হলেও তা ক্রমশ ৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র ছয়দফা, ৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচনে প্রতিবাদ গড়ে উঠে বাংলা ও বাঙালি একটি অভিন্ন রাজনৈতিক চেতনার রূপ নিয়েছে। এভাবে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সাথে নতুন ইতিহাস গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের ৭২-এর সংবিধান ৫২-র ভাষা আন্দোলনকেও বহন করেছে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তার রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র স্তম্ভ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।

অপরদিকে নানা ধরনের মত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সঙ্গতকারণেই রাজনৈতিক বিভাজনের পথে না গিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে আছে সর্বভারতীয় চেতনা। এই চেতনার প্রভাব খুবই শক্তিশালী। মানভূম, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বাংলা ভাষাভাষীর মধ্যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ থাকলেও সর্বভারতীয় চেতনার দ্বারা চালিত। পাশাপাশি ভারতবর্ষের প্রদেশ বা অঞ্চলগুলো কেন্দ্র দ্বারা শাসিত থাকায় গণতান্ত্রিকবোধ ও গণতান্ত্রিক শাসন উপেক্ষিত হয়নি। ভারতবর্ষ তার শাসন কাঠামোর মধ্যে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান করেছে। পক্ষান্তরে পূর্ববাংলার শাসকগোষ্ঠীর মাঝে সুশাসন তথা জনগণের চিন্তা-চেতনার ন্যূনতম মূল্যই ছিল না। তাই বাংলাদেশ তার নিজ পথ নিজেই করে নিয়েছে। বাঙালি জাতিই বিশ্বে প্রথম জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। বাঙালির এ আত্মত্যাগ আজ আর্ন্তজাতিকভাবেও স্বীকৃত। ১৯৯৭ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো যে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করেছে তা বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনেরই ফল। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজ গোটা বিশ্বের স্ব-স্ব মাতৃভাষা রক্ষণা-বেক্ষণের চেতনা, ন্যায্য অধিকার আদায়ের চেতনা এবং মুক্তির চেতনায় রূপ নিয়েছে। যুগে যুগে এই চেতনাকে শাণিত করবে ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদদের মহান আত্মত্যাগের অমরগাঁথা। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের সার্থকতা এখানেই।

লেখক: প্রভাষক, কমলগঞ্জ সরকারি গণমহাবিদ্যালয়, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার।

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!