
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ সংশোধনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা আনতে যাচ্ছে। এতে ১৯৭৯ সালের সামরিক শাসনামলে প্রণীত ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ’-এর কয়েকটি ধারা পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হলো, সরকারি কর্মচারীদের রাজপথে সভা-সমাবেশ, কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচি এবং সচিবালয়ে বিক্ষোভ বন্ধ করা, অন্য কর্মচারীদের কর্মস্থলে যাওয়া থেকে বাধা দেওয়া ঠেকানো।
সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী, এ ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত কোনো কর্মচারীকে তদন্ত ছাড়াই মাত্র আট দিনের নোটিশে চাকরিচ্যুত করা যাবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগ ইতোমধ্যে খসড়া সংশোধনের কাজ করছে এবং শিগগিরই এটি উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ শামীম সোহেল গণমাধ্যমকে জানান, “সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে এবং এটি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তোলা হবে।”
মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। অনেক কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান, কেউ কেউ দেশ ত্যাগ করেন, অনেকেই অনুমতি ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন এবং কিছু কর্মচারী অন্যদেরও অনুপস্থিত থাকতে উসকানি দেন। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে চাইছে। সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী, কেউ নিজের উপস্থিতি এড়িয়ে যান, অন্যকে উসকানিতে উদ্বুদ্ধ করেন অথবা দাপ্তরিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন—তাকে অপরাধী গণ্য করা হবে এবং তদন্ত ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা যাবে। প্রয়োজনে পদাবনতি বা বেতন কর্তনের শাস্তিও প্রযোজ্য হবে।
খসড়া বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অভিযুক্ত কর্মচারীকে দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া হবে এবং চাইলে ব্যক্তিগত শুনানির সুযোগও মিলবে। তারপর কর্তৃপক্ষ যদি তাকে দোষী মনে করে, তবে তিন দিনের মধ্যে চূড়ান্ত নোটিশ দিয়ে চাকরিচ্যুত করা যাবে। অর্থাৎ আট দিনের মধ্যেই সরকারি চাকরি হারানোর সম্ভাবনা থাকবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর অনেকে ওএসডি হন এবং কেউ কেউ সচিবালয়ের বারান্দায় শুয়ে প্রতিবাদ জানান, যা প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। সংশোধিত আইনের মাধ্যমে এমন ঘটনা প্রতিরোধ করতে চায় সরকার। তবে এই উদ্যোগে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রশাসন ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ ধরনের আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করতে পারে এবং ভিন্নমত বা অভিযোগকে সরকারবিরোধিতা হিসেবে বিবেচনা করে শাস্তি দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এক জেলা প্রশাসক বলেন, “আমার চাকরির মেয়াদ এখনো ২৫ বছর হয়নি, তাই সরকার আমাকে অবসরে পাঠাতে পারছে না। কিন্তু নতুন আইনের মাধ্যমে সে পথ তৈরি করা হচ্ছে।”
বর্তমান সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ নম্বর ধারায় বলা আছে, কেউ ২৫ বছর চাকরি করলে সরকার জনস্বার্থে তাকে অবসরে পাঠাতে পারে। কিন্তু সংশোধিত আইনে ২৫ বছর পূর্ণ না হলেও চাকরি থেকে অব্যাহতির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ নিয়ে প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, বিশেষ আইন মানেই একটি ‘কালো আইন’-এর সম্ভাবনা।
সাবেক সচিব ও লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, “দায়িত্বে অবহেলা করলে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, তবে কর্মচারীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকা আবশ্যক।” সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া মন্তব্য করেন, “আইনের অপব্যবহার ঠেকাতে সরকারের উচিত সুনির্দিষ্ট গ্যারান্টি দেওয়া।”
অন্যদিকে, পুলিশের ৮২ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ২৫ ফেব্রুয়ারি একযোগে ওএসডি হন। তাদের অনেকেই এখনো ২৫ বছর চাকরির সীমা পূরণ করেননি, তাই অব্যাহতি দেওয়া যাচ্ছে না। সংশোধিত আইন কার্যকর হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে।
এছাড়া ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর নেতারা সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেছেন। সংগঠনটির সমন্বয়ক মফিজুর রহমান বলেন, “এই সরকার তো গণতন্ত্রের কথা বলে এসেছে, তাহলে এখন কর্মচারীদের মুখ বন্ধ রাখতে চায় কেন? এটি ফ্যাসিবাদের লক্ষণ।”






