
জন্ম: বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎসক, সংগঠক, লেখক-গবেষক ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার ছ’ কড়ি পুকুর, ন’ কুড়ি ডোবা খ্যাত ধরমন্ডল গ্রামে ১৩২৮ বাংলা সনের ৫ অগ্রহায়ণ বৃহস্পতিবার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রয়াত চন্দ্রকুমার চক্রবর্ত্তী, মাতা প্রয়াত জগনন্ময়ী দেবী। ঘটনাক্রমে তাঁর আরেক নাম ছিল বেচারাম। নিকটজনরা ডাকতেন বেচু। তাঁর ছয় পুরুষ চিকিৎসক ছিলেন।
বেড়ে ওঠা: ১১ বছর বয়সে পিতৃহারা ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তী দুঃখ-কষ্টে বেড়ে ওঠেন ও পড়াশোনা করেন। ছোটবেলা পেটরোগা চক্রবর্ত্তীর উদ্দেশ্য ছিল জনসেবা। ছোটবেলা থেকেই তাই তিনি বিভিন্ন সংগঠন ও জনহিতকর কার্যাবলীর সাথে জড়িয়ে পড়েন। অভাব-অনটন, অসুখ-বিসুখ ও বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে তিনি বরিশাল, সিলেট ও কলকাতায় পড়াশোনা করেন।
চিকিৎসা সেবায় সম্পৃক্ত: ১৯৪০ সালের শেষদিক থেকে ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তী নিজে রোগী দেখা শুরু করেন। এর আগে প্রায় ৩ বছর তিনি কোলকাতার শশীভূষণ দে স্ট্রীটে খ্যাতিমান হোমিও চিকিৎসক নীলমণি ঘটকের প্রধান সহকারী ডাঃ আর. কে চ্যাটার্জীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাজ করেন। নিজ এলাকায় কিছুদিন বিচ্ছিন্নভাবে হোমিও প্র্যাকটিসের পর পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৪ সনে তিনি ভারতের শিলচরে চলে যান এবং হোমিও প্র্যাকটিস শুরু করেন। উল্লেখ্য এ সময়ে তিনি কমিউনিস্ট আদর্শের সাথে একাত্ম হয়ে উঠেন। শিলচরে তাঁর প্র্যাকটিস জমে ওঠার মুহূর্তে শুরু হয় স্বাধীনতা ও দেশ বিভাগের ডাক। এমতাবস্থায় তিনি ১৯৪৮ সনের নভেম্বরে শিলচরের পাঠ চুকিয়ে চলে আসেন জন্মভূমিতে। ১৯৪৯-১৯৫১ সন পর্যন্ত তিনি গ্রামে থেকেই হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করতেন। ১৯৫১ সনের নভেম্বরে তিনি তৎকালীন মহকুমা শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থিত হন। এখানে অনেক দূরারোগ্য রোগি চিকিৎসার মাধ্যমে তাঁর হাত যশ ছড়িয়ে পড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁর চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল হোমিও হোম। তিনি এর বাংলা অর্থ করতেন সদৃশাঙ্গন। শেষ বয়সে পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি ১৯৮৬ সনের ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর প্রিয় শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে ঢাকা চলে যান। ছোট ছেলে ডাঃ চক্রেশ চক্রবর্ত্তীর সাথে তিনি ১৬৬ সি চামেলীবাগের তৃতীয় লেনে বসবাস ও প্র্যাকটিস করতেন।
মাটি ও মাতৃভূমির প্রতি আকর্ষণ: মাতৃভূমির প্রতি প্রবল আকর্ষণ থেকে শিলচরে সুপ্রতিষ্ঠিত ও নিশ্চিত জীবন ছেড়ে দেশ-বিভাগের প্রেক্ষিতে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিপদ সঙ্কুল জীবনে চলে আসেন। ঢাকায় যাওয়ার পরে ১৯৮৬ সনের ১৬ এপ্রিল পুত্রবধূ সাধনা চক্রবর্ত্তীকে লেখা এক পত্রে মাটির প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ ফুটে ওঠে। তিনি লিখেন- “রাজধানী। বড় শহর। গর্ব বড়। বহর বড়। খর্চ বড়। এত বড়তে অভ্যন্ত নই। বাতাস আরো বেশী চাই। আলো আরো অনেক চাই। মেলামেশা, লোকজন, কথা-বার্তা, হাসি-উল্লাস, আরো একটু প্রাণ চাই। মাটির বুকে বড় হয়েছি, মাটির একটু পরশ চাই।”
অর্গানন ষষ্ঠ সংস্করণের প্রতি আকর্ষণ ও পঞ্চাশ সহস্রতমিক পদ্ধতির ঔষধের প্রতিষ্ঠা ও প্রচার-প্রসারে ভূমিকা : বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে অর্গানন ষষ্ঠ সংস্করণের ইংরেজি অনুবাদ ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তীকে আকৃষ্ট করে। তিনি অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে কাজ শুরু করেন। দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ও কঠোর পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে তিনি অর্গানন ষষ্ঠ সংস্করণে বর্ণিত ৫০ সহস্রতমিক পদ্ধতির মর্ম উদঘাটনে সফল হন। তারপর তা দেশ-বিদেশের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের নিকট তুলে ধরতে ও পৌছে দিতে আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশে ৫০ সহস্রতমিক পদ্ধতির ঔষধের প্রচার-প্রসারে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। উল্লেখ্য, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ৫০ সহস্রতমিক পদ্ধতি প্রায় নিরুপদ্রবে ও স্বল্প সময়ে আরোগ্য আনয়ন করে। অবশ্য তার আগে চাই লক্ষণ সাদৃশে যথাযথ ঔষধ নির্বাচন।
লেখক, সংগঠক ও সমাজসেবক: আর্ত-মানবতার সেবায় প্রয়াত ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তী নিজস্ব উদ্যোগে গরিব-দুঃখী জনগণের চিকিৎসার জন্য একটি দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালনা করতেন। তিনি একজন কবি ও প্রাবন্ধিক ছিলেন। বহু হোমিও গ্রন্থ প্রণেতা ডাঃ চক্রবর্ত্তীর আলোচিত বই “হোমিওপ্যাথির উদ্ভব, বিকাশ ও সংকট (১৯৮২)। তাঁর অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পরিষদের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। হোমিওপ্যাথি তথা ৫০ সহস্রতমিক পদ্ধতির প্রচার-প্রসারে তিনি সংগঠন ও পত্রপত্রিকার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পরিষদ ও সদৃশ-বিধান পরিষদ (শিলচর, কাছাড়, আসাম, ভারত) প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে তাঁর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তী স্মরণে: ৫০ সহস্রতমিক পদ্ধতির একনিষ্ঠ অনুসারী ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পরিষদ ১৯৮৮ সালের ২৯ জানুয়ারি স্মারকগ্রন্থ “দীপন” প্রকাশ করে। এ উপলক্ষে ওইদিন “প্রয়াত ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তী স্মরণ সভা” ওয়াপদা মিলনায়তন (ঢাকা)-এ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পরিষদের তৎকালীন সভাপতি ডাঃ মোঃ কায়েস উদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকার জেলা প্রশাসক মোঃ নিজামউদ্দিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের চেয়ারম্যান খানে আলম খান। স্মারকগ্রন্থ “দীপনে” যাদের লেখা প্রকাশিত হয়, তাঁরা হলেন- ডাঃ কবীর আহমদ (মরহুম), ডাঃ হরিমোহন চৌধুরী (প্রয়াত), ডাঃ জহুরুল ইসলাম (মরহুম), ডাঃ বীরেন্দ্র কুমার কর (প্রয়াত), ডাঃ চন্দ্রশেখর দাশ প্রমুখ। ভারত (শিলচর)-এর সদৃশ্য বিধান পরিষদ তাদের ত্রৈমাসিক প্রকাশনা “সদৃশ-বিধান” জুলাই ১৯৮৮ সংখ্যা তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি পরিষদ, সিলেট জেলা শাখার সভাপতি ডাঃ বীরেন্দ্র চন্দ্র দেবের উদ্যোগে ও প্রস্তাবনায় ২০১৮ সালের আগস্টে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তী স্মৃতি পাঠাগার। এছাড়া সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিবেকানন্দ হোমিও হলের প্রকাশনা “হোমিও জ্যোতি” এবং আনোয়ারা হোমিও হল-এর প্রকাশনা “আনোয়ারা”য় প্রয়াত ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তীকে নিয়ে বিশেষ লেখা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. আমিনুল হক তাঁর বই ঔষধের মানসিক লক্ষণ (২০০১) ডা. চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তীকে উৎসর্গ করেছেন এভাবেÑ “আমার মনের মানুষ ডা. চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তীকে।” ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত আনোয়ারা হোমিও হল গ্রন্থাগার ও আর্কাইভ এবং ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজীব স্মৃতি গ্রন্থাগারে ডা. চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তীর লেখাসমূহ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার চেষ্টা চলছে।
ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তীকে নিয়ে সুধীজনের মূল্যায়ন: এলোপ্যাথি থেকে হোমিওপ্যাথিতে রূপান্তরিত বিশিষ্ট চিকিৎসক, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ড (ঢাকা)-এর প্রকাশনা “বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক পত্রিকা”র সম্পাদক, বহুগ্রন্থ প্রণেতা জহুরুল ইসলাম বলেছেন- “ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তী এমন এক ব্যক্তি যাকে উপমহাদেশের মধ্যে অর্গানন ষষ্ঠ সংস্করণের প্রথম সঠিক ভাষ্যকার বলা চলে। যষ্ঠ সংস্করণের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নবতম শক্তি পদ্ধতির দ্বারোদঘাটন তিনি করেন। বাংলাদেশ হোমিপ্যাথি পরিষদের সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎসক মোঃ কায়েস উদ্দীন বলেছেন- “সর্বজন শ্রদ্ধেয় ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তীর জীবনকাল ছিল একটি চিরস্মরনীয় ইতিহাস। এ ইতিহাস চিকিৎসা বিজ্ঞানের কনিষ্ঠতম ও শ্রেষ্ঠতম অবদান হোমিওপ্যাতির সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতির এ দেশে রূপায়ন, প্রবর্তন, প্রচার ও প্রসারের ইতিহাস। এ ইতিহাস যে পদ্ধতির মাধ্যমে রোগক্লিষ্ট মানবের জন্য দ্রুত যাতনাবিহীন ও স্থায়ী আরোগ্যের তথা আদর্শ আরোগ্যের পথ তৈরীর নিমিত্ত কঠোর শ্রম ও ত্যাগ স্বীকারের ইতিহাস।” প্রবীণ হোমিও চিকিৎসক ডাঃ চন্দ্রশেখর দাশ বলেছেন “ডাঃ চন্ডীপদবর্ত্তী বাংলাদেশে আমাদেরকে ৫০ সহস্রতমিক শক্তির ওষুধের সন্ধান দিয়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ও রোগিদের নিকট চির ভাস্বর হয়ে রয়েছেন।” শিলচর, ভারতের সদৃশ বিধান পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট হোমিও চিকিৎসক ডাঃ কে. আর. দাস বলেছেন- “পঞ্চাশের দশকে যে কয়জন মনিষী মানবকল্যাণে অর্গানন ষষ্ঠ সংস্করণের প্রচার-প্রসার ও প্রয়োগের তাগিদ অনুভব করেছিলেন ডাঃ চক্রবর্ত্তী তাঁর মধ্যে একজন। ডাঃ চক্রবর্ত্তীই এ উপমহাদেশের প্রথম ব্যক্তিত যিনি অর্গানন সষ্ঠ সংস্করণ ও ৫০ সহস্রতমিক শক্তির প্রথম সার্বিক রূপকার। ১৯৫৪ সনে তিনি প্রথম ৫০ সহস্রতমিক শক্তির ওষুধ তৈরি ও প্রয়োগ করেন। যদিও এর অনুসন্ধানে ছিলেন আরো অনেক আগে থেকেই। ডাঃ চক্রবর্ত্তী তাই এ উপমহাদেশের হোমিওপ্যাথদের গৌরব।”
এছাড়া ভারত উপমহাদেশের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি ও হোমিও চিকিৎসক তাঁর অবদান ও কর্মের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- মরহুম ডাঃ হোসেন রাজা চৌধুরী ফারুকী, মরহুম ডাঃ কবীর আহমদ, ডাঃ চন্দন কুমার নাথ, ডাঃ সাধন চন্দ্র পাল, ডাঃ মোহাম্মদ আইয়ুব, ডাঃ চপলেশ চক্রবর্ত্তী, ডাঃ অমল চন্দ্র সেন (সম্পাদক-শাশ্বতী), ডাঃ এস.এম. রহমান (অধ্যক্ষ, ঢাকা হোমিওপ্যাথি কলেজ), ডাঃ শামসুল হুদা চৌধুরী, অধ্যক্ষ ডাঃ আব্দুল করিম, ডাঃ বীরেন্দ্র চন্দ্র দেব প্রমুখ।
ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্ত্তীর মৃত্যু: হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির জনক মরহুম স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের সুযোগ্য উত্তরসূরী মানবকল্যাণে নিবেদিত ডাঃ চন্ডীপদ চক্রবর্তী ১৯৮৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর (১৩৯৪ বাংলা সনের ৬ আশ্বিন) বৃহস্পতিবার ঢাকায় মৃতুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ২ ছেলে ও ৩ মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও গুণগ্রাহী রেখে যান। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে হোমিও অঙ্গনে শোকের ছাড়া নেমে আসে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর স্মরণে শোক সভার আয়োজন করা হয়।
লেখক: সম্পাদক-আনোয়ারা (শিকড় সন্ধানী প্রকাশনা)।







