শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

ঢাকার মিরপুরের একটি বাড়িতে গুপ্তধনের সন্ধানে পুলিশের খোঁড়াখুঁড়ি



ঢাকার মিরপুরে একটি বাড়ির মাটির নিচে গুপ্তধন লুকানো আছে- এরকম একটি খবর লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ ওই বাড়িতে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু করে।

শনিবার (২১ জুলাই) সকাল দশটা থেকে দুপুর সাড়ে তিনটা পর্যন্ত খুঁড়েও সেখানে কিছু পাওয়া যায় নি। কিন্তু খননকাজের ফলে বাড়ির কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ায় ‘গুপ্তধনের সন্ধানে তাদের অভিযান’ আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।

সাড়ে চার ফুট গভীরেও কিছু পাওয়া যায়নি। ছবি : সাব্বির আহমেদ

এরপর থেকে এই বাড়িটিকে ঘিরে লোকজনের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।

মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দাদন ফকির বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, বাড়িতে রান্নাঘরসহ সাত থেকে আটটি ঘর আছে। এপর্যন্ত তারা দুটো কক্ষের মেঝে খুঁড়েছেন। এখনও সেখানে কোন ধরনের গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

দাদন ফকির বলেন, “দুটো রুমে আমরা সাড়ে চারফুট গভীর পর্যন্ত খুঁড়েছি। এই কাজে ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিককে লাগানো হয়েছে। কিন্তু আমরা এখন দেখছি যে বাড়িটিতে শক্ত কোন পিলার নেই। আরো খনন করলে এটি যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে।”

তিনি জানান, এখন তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রকৌশলীদের কাছ থেকে পরামর্শ চেয়েছেন। তাদের পরামর্শ পাওয়ার পরেই পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন।

গুপ্তধনের কথা কিভাবে এলো

মিরপুর থানার পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, এই বাড়ির মাটির নিচে স্বর্ণালঙ্কার আছে বলে টেকনাফের এক বাসিন্দা মোহাম্মদ তৈয়ব তাদের থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি বা জিডি দায়ের করেছেন।

পুলিশ জানায়, ওই জিডিতে মি. তৈয়ব দাবি করেছেন যে তার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ওই বাড়িতে থাকতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় তারা বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেছেন এবং যাওয়ার আগে তারা তাদের সব স্বর্ণালঙ্কার মাটির নিচে পুঁতে রেখে গেছেন।

তবে কতোখানি স্বর্ণ বা কতোটা টাকার স্বর্ণ এ বিষয়ে মোহাম্মদ তৈয়ব পুলিশকে কোন ধারণা দিতে পারেন নি।

পুলিশের কর্মকর্তা দাদন ফকির জানিয়েছেন, বর্তমানে এই বাড়ির যিনি মালিক- মনিরুল আলম, তিনিও তাদের কাছে আরো একটি জিডি দায়ের করেছেন। সেখানেও তিনি এরকম কিছু গুপ্তধনের কথা উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু এরকম একটি শোনা কথার ভিত্তিতে তারা কেন বাড়ি খুঁড়তে লেগে গেলেন- এই প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা মি. ফকির বলেন, “যেহেতু বাড়ির মালিকসহ দুজন একই ধরনের কথা বলে জিডি করেছেন, সেহেতু আমরা মাটি খুঁড়ে এর সত্যতা যাচাই করতে চেয়েছি।”

কে এই তৈয়ব

মোহাম্মদ তৈয়ব থাকেন বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা টেকনাফে। তিনি চাল ও জমিজমার ব্যবসা করেন।

বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, পাঁচ বছর আগে তিনি তার একজন পাকিস্তানি বন্ধুর মুখে এই বাড়িটির কথা শুনেছেন। বন্ধুটির নাম সৈয়দ আলম। মি. আলম কখনো পাকিস্তানে আবার কখনো বাংলাদেশে থাকেন বলে তিনি জানান।

“আমার একজন বাল্যবন্ধু, আমাদেরই গ্রামের, আমাকে ওই গুপ্তধনের কথা জানায়। পাকিস্তানে বাসাবাড়ি, বিয়ে-শাদি করে এখন সে ওখানেই থাকে। মাঝে মধ্যে সে বাংলাদেশে বেড়াতে আসে। ২০১৩ সালে আলম প্রথমে আমাকে এই ঘটনার কথা জানায়।”

মি. তৈয়ব বলেন, “বাড়ির আসল মালিক ছিলেন দিলশাদ খান। তিনি আমার বন্ধু আলমের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। দিলশাদ খান পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা বিমান বন্দরে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক আগে আগে তিনি সপরিবারে পাকিস্তানে চলে যান।”

তারা পাকিস্তানের কোথায় থাকেন সেটা তিনি জানেন না, তবে শুনেছেন মি. খান মারা গেছেন এবং ইব্রাহিম নামে তাদের একটি ছেলে আছে।

মি. তৈয়ব জানান, তিনি শুনেছেন দিলশাদ খান ১৯৮৭ সালে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেসময় তিনি মিরপুরের বাড়িও দেখতে গিয়েছিলেন। এলাকার লোকজনও একথা জানে। পরে পাকিস্তানে যাওয়ার পর তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। মারা যাওয়ার আগে মিরপুরের বাড়িতে ফেলে আসা তাদের স্বর্ণালঙ্কারের কথা তিনি তার ছেলে ইব্রাহিমকে বলে গেছেন।

“উনার ছেলে ও ছেলের বউ আমার বন্ধু আলমকে বলেছে। আলম ওখান থেকে এসে আমাকে বলেছে। মুসলমান হিসেবে আল্লাহর কোরান ধরিয়ে তিনি আমাকে ওই স্বর্ণালঙ্কারের কথা বিশ্বাস করিয়েছেন।”

তিনি বলেন, স্বর্ণালঙ্কারের কথা জানার পর বন্ধু আলমকে সাথে নিয়ে তারা দু’জনে এবিষয়ে বহু খোঁজ খবর করেছেন। অনেক দূর অগ্রসরও হয়েছেন। কিন্তু একসময় তার বন্ধু তার সাথে প্রতারণা করলে তিনি পুলিশের আশ্রয় নিয়েছেন।

“আমার বন্ধু যখন আমাকে এড়িয়ে ওই বাড়ির বর্তমান কেয়ারটেকারের সাথে যোগাযোগ করে সব স্বর্ণ হাতিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করে তখন আমি পুলিশকে জানাই। আমার মনে হলো যে এসব তো আসল মালিক পাচ্ছে না। এর পেছনে এতোদিন এতো টাকা পয়সা সময় খরচ করেছি, আমিও কিছু পাচ্ছি না। তাহলে এসব সরকারের কাছেই যাক।”

কতো টাকার সোনা আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার বন্ধু তাকে বলেছেন যে ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকার স্বর্ণ ও হীরা আছে ওই বাড়িতে।

২০১৩ সালের পর গত কয়েক বছর ধরে মোহাম্মদ তৈয়ব বাড়িটির সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছেন বলে জানান।

তিনি বলেন, তার তদন্ত অনুসারে তিনি মোটামুটি নিশ্চিত যে সেখানে প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার আছে। কিন্তু এখন শুধু তার “চোখে দেখাটাই বাকি।”

সৈয়দ আলমের কথা

সৈয়দ আলমের জন্ম বাংলাদেশে। ১৯৮৫ সালে শৈশবে পাকিস্তানে চলে যান তিনি। সেখানেই পাকিস্তানি একটি পরিবারের বড় হয়েছেন। এখন তিনি পাকিস্তানের নাগরিক। মাঝে মাঝে বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন। এখানে তার ভাই ও বোনেরা আছেন।

তিনি থাকেন করাচীতে। মাস-খনেক আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। আছেন টেকনাফে।

সেখান থেকে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, পাকিস্তানে তার মোহাম্মদ হাসান নামের একজন বন্ধু আছে। সে তাকে কিছু কাগজপত্র দেখিয়ে এসব স্বর্ণালঙ্কারের কথা তাকে জানিয়েছে।

“আমাকে তারা বলেছিল পাকিস্তানি টাকায় ৪৫ হাজার টাকার সোনা এবং ৩০ হাজার টাকার হীরা ওই বাড়ির মাটির নিচে রাখা আছে।”

তখন তিনি তার কাছে বিস্তারিত জানতে চাইলে বন্ধু হাসান তাকে বলেন, দিলশের কিম্বা দিলশাদ খান নামের এক ব্যক্তি যুদ্ধের আগে মিরপুরের ওই বাড়িতে ছিলেন। তার পিতার নাম খোদা বক্স, মা ফাতেমা বেগম।

তিনি জানান, দিলশের খানের ছেলে ইব্রাহিমের একজন বন্ধু হাসান। ওই হাসান তার বন্ধু। শুধু হাসানের মুখেই নয়, ইব্রাহিমের কাছেও তিনি এই হীরা ও সোনার কথা শুনেছেন। হাসানের মাধ্যমেই ইব্রাহিমের সাথে তার দেখা হয়েছিল। “ওরা তখন আমাকে বলেছিল আপনি যেহেতু বাংলাদেশে যাচ্ছেন, এটার একটু খোঁজ খবর করে দেখবেন,” বলেন তিনি।

মি. আলম জানান, পরে তিনি বাংলাদেশে এসে তার বন্ধু তৈয়বকে সবকিছু খুলে বলেছেন। তারপর তৈয়ব কি কি করেছে এবিষয়ে তার কিছু জানা নেই।

তারপর তিনি নিজেও ঢাকার মিরপুরের ওই বাড়িতে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন বলে জানান। বলেন যে বাড়ির কেয়ারটেকারের সাথেও তিনি এবিষয়ে কথা বলেছেন। “কেয়ারটেকার মনিরের সাথে আমার কথা হয়েছিল। তাকে আমি সবকিছু খুলে বলেছি। বলেছি এসব সোনা যদি পাওয়া যায় তাহলে তিনিও সেসব নিতে পারেন।”

পাকিস্তানি বন্ধু হাসান এবং কথিত সোনার মালিকের ছেলে ইব্রাহিমের কোন নম্বর তার কাছে আছে কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন্ধু হাসানের নম্বর তার ডায়েরিতে লেখা আছে। সেই ডায়েরি আছে বাড়িতে। তিনি এখন বাড়ি থেকে অনেক দূরে টেকনাফে। পরে তিনি তার পাকিস্তানি বন্ধুর ফোন নম্বর দিতে পারবেন।

কি বলছেন এখনকার মালিক

বাড়িটির বর্তমান মালিক মনিরুল আলম। তিনি জানান, মিরপুরের ওই এলাকার বেশ কিছু বাড়ি স্বাধীনতার যুদ্ধের পর বাংলাদেশ সরকার নিয়ে নিয়েছিল। পরে সরকার ওই বাড়িগুলি বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করে দেয়। এরকমই দ্বিতীয় এক মালিকের কাছ থেকে ২০১০ সালে তিনি এই বাড়িটি কিনেছেন।

বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, সপ্তাহ খানেক আগে তিনি এরকম একটি উড়ো খবর পান যে বাড়িতে নাকি গুপ্তধন আছে। সেটা তার বাড়ির কেয়ারটেকার তাকে জানিয়েছে।

“এরপর থেকে কিছু লোকজন এলাকায় প্রচার করে যে আমার বাড়িতে গুপ্তধন আছে। তারপর তারা বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করে। কয়েক দিন আগে তিনজন লোক বাড়ির ভেতরেও ঢোকার চেষ্টা করেছিল। তারা বাড়ির কেয়ারটেকারকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করে। খবরটা পাওয়ার পর নিরাপত্তার কারণে আমি প্রশাসনের কাছে যাই।”

তিনি বলেন, গুপ্তধনের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে ঘিরে এলাকায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন এবং একারণেই বিষয়টির সুরাহা করার জন্যে তিনি পুলিশের আশ্রয় নিয়েছেন।

তিনি জানান, খোঁড়াখুঁড়ির কাজ পুলিশের তত্বাবধানে হচ্ছে, কিন্তু এর খরচ বাড়ির মালিক হিসেবে তিনি নিজেই বহন করছেন।

বিবিসি

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!