রবিবার, ২ জুন ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

সুষমা সুলতানা রুহী

তুমি রবে নিরবে হৃদয়ে মম



মরহুম কমরেড আজহার আলী

আমার বাবা কমরেড আজহার আলী। তিনি তাজপুর ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও ভূমি দাতা। তিনি ক্বারীয়ানা কৃতিত্বের সহিত পাশ করেন। পাগড়ী পড়া আমার বাবার গানের প্রতি ছিলো প্রচণ্ড দূর্বলতা। খুব ভাল গণ সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। তখনকার সময়ে নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের গান গেয়েই মানুষের খুব কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন।

নিজে গান বানতেন এবং সে গানে সুর দিয়ে নিজেই গাইতেন। তবলা, দোতরা, গিটার খুব ভাল বাজাতে পারতেন। তাঁর কোনো ওস্তাদ ছিলেন না। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় সব কিছু শিখেছিলেন। গান বা বাদ্যযন্ত্র শিখার পিছনে তাঁর ওস্তাদ না থাকলেও এর পিছনে মজার ইতিহাস আছে। এ কথা পরে আর কোন এক লেখায় লিখবো।

১৯৮৮ সালে ইংল্যান্ডে একটি অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করছেন কমরেড আজহার আলী

আজ আমার বা আমাদের পরিবার সম্পর্কে একটু বলি-

আমি ছোট বেলা থেকেই কোনো কিছু শিখার পিছনে একটা ভয় কাজ করতো, গান বলেন বা যাই বলেন মনে হতো এটা আমার পক্ষে শিখা সম্ভব না। পড়াশোনায় তেমন ভাল ছিলাম না । বাবা সব সময় সাহস দিয়ে দিয়ে আমাকে শিখাতেন। তাঁর একটাই কথা ছিলো চেষ্টা করলে এমন কিছু পৃথিবীতে নেই যে পারা যায় না। তাই তোমাকে চেষ্টা করতে হবে। সাধনার উপর নির্ভর করে তোমার কোনো কিছু শিখা।

পরিবারে আমরা  ভাই বোন ছিলাম তিন জন। এক ভাই দুই বোন। ভাই সবার বড়। আমি যখন অনেক ছোট ছিলাম তখন তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান এবং সেখানে একটি স্কুলে গানের টিচার ছিলেন। খুব ভাল তবলা বাজাতেন। বাংলাদেশ থেকে বড় বড় শিল্পীরা ইংল্যান্ডে গানের প্রোগ্রামে গেলে আমার ভাইয়ের ডাক পড়তো। তাঁর গান বা তবলার হাতেখড়ি আমাদের বাবার কাছেই। তাঁকে সেখানে এক নামে সবাই চিনেন (প্রয়াত) বেনজির আহমদ রানা। তাঁর সহধর্মিণী মাসুমা সুলতানা নার্গিস আমার ভাবীও এই একই স্কুলে গানের শিক্ষক ছিলেন।

ভাইয়ের পরে আমার বড় বোন মিহিমা সুলতানা শিউলী। তাঁকে গান শিখানোর জন্য বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু গলায় তেমন ভাল সুর ছিলোনা তাই তাঁর আর গান শিখা হলোনা। এক সময় বিয়ে হয়ে তিনি ও ইংল্যান্ডে চলে গেলেন। আমি ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট এবং তাঁদের সাথে বয়সের বেশ ব্যবধান। বোনের যখন বিয়ে হয়ে বিদেশে চলে গেলেন তখন অামি ছোট। তৃতীয় শ্রেণীতে সবে ভর্তি হয়েছি। তখন শুধু পড়াশোনা অার খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। বাবাই আমাকে পড়াতেন। যে কোনো পড়া ইংরেজী বলেন বা অংক বলেন শিখতে অনেক সময় নিতাম। বাবা মনে করেছিলেন বোনের মতো আমার ও গলায় সুর নেই। ভাই, বোন ও ভাবী বিদেশে চলে যাওয়ার পর বাবা কেনো জানি গানের জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা সব বাক্স বন্দি করে ঘরের থাকে তুলে রেখে দিলেন। তাঁরা চলে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে আব্বা আমাকে এক বিকেলে ডাকলেন। গিয়ে দেখি ফটিকের (ড্রয়িং রুম)মেঝেতে হারমোনিয়াম তবলা রাখা। কুদরত চাচা (বাড়ীর কেয়ারটেকার) এ গুলী ঝাড়া মুছা করছেন। আব্বা আমাকে ডেকে বললেন আসোতো দেখি তোমার গলায় সুর আছে কিনা। আমি অজানা এক কৌতুহলে তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম।

তিনি হারমোনিয়ামে সা তে সুর ধরে বললেন বলোতো সা তার পর রে গা মা — এভাবে সাতটি স্বর বললাম সব একে একে অামার সুরের সাথে মিলে গেলো। সেদিন অামার বাবার চোখে যে অানন্দের ঝিলিক দেখেছিলাম তা আজও মনে হলে চোখের কোণে পানি চলে আসে। এই দিন থেকেই শুরু হলো অামার অারেক অধ্যায়। অামার পড়াশোনার পাশাপাশি গান প্র্যাকটিস করা । অাগেই অাপনাদেরকে বলেছি অামি যেকোনো বিষয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে খুবই দূর্বল। সা রে গা মা শিখার পর বাবা অনেক কষ্ট করে একটা গান শিখালেন এবং হারমোনিয়াম বাজিয়ে মোটামোটি গাওয়ার উপযোগী করলেন।

অামার প্রথম গানটি ছিলো রবীন্দ্র সঙ্গীত- অাজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। এ গানটি হারমোনিয়ামে তোলার দুই একদিন পরেই অাব্বা বললেন তুমি এ গানটি গাইবে মঙ্গল চন্ডী নিশি কান্ত উচ্চদবিদ্যালয়ে একটি প্রোগ্রামে। অামি শোনে তো ভয়ে নাই। যাক, বাবা যেখানে বলেছেন সেখানে না করার কোনো সুযোগ নেই কারণ অনেক ভয় পেতাম তাঁকে। নির্দিষ্ট দিনে প্রোগ্রামে যাওয়া হলো। প্রোগামে যখন অামি স্টেজে উঠবো তার অাগ থেকেই অামার হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গেলো। অাব্বা সাথে নিয়ে অামাকে স্টেজে উঠলেন সাহস দেওয়ার জন্য। অামি গান শুরু করে অর্ধেকে যাওয়ার পর মনে হলো পৃথিবীতে ভূমীকম্প শুরু হয়েছে তাই অর্ধেক গান করেই স্টেজ থেকে নামতে হলো। অামি অারো ভয় পেলাম, মনে করেছিলাম পুরোটা গান শেষ করতে না পারায় অাব্বা অামাকে বকা দিবেন কিন্তু তিনি তা না করে অামাকে সাহস দিলেন, বললেন অনেক ভাল করেছো অাগামীতে তুমি পুরাটাই গাইতে পারবে।

মরহুম কমরেড আজহার আলী ও মেয়ে সুষমা সুলতানা রুহী (১৯৮৮ সাল)

অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন অামার বাবা। এ ভাবে সাহস দিয়ে দিয়ে পরে আমার মতো একটা অপদার্থকে ওয়ার্ল্ড কম্পিটিশনেও পাঠিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের ওয়েল্সে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় – ‘Llangollen International Musical Eisteddfod’ নামে ওয়ার্ল্ড কমপিটিশন। বাবার হাতে গড়া আমিসহ আরো তিনজন শিল্পী নিয়ে ক্ষুদে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বালাগঞ্জ শাখা ১৯৮৫ সালে এ প্রতিযোগীতায় গণসঙ্গীত গেয়ে বিশ্বের ১৪৭ দলের সাথে সপ্তম স্থান অধিকার করে। তখন এ খবর বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এবং বিবিসিতে তা প্রচারিত হয়।

যুক্তরাজ্যে একটি সংগীত অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করছেন মেয়ে সুষমা সুলতানা রুহী, পাশে কমরেড আজহার আলী ও অন্যান্যরা

পরে আমি একক ভাবে ও ১৯৮৮ সালে এ প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করতে ইংল্যাণ্ডের ওয়েলসে যাই। ওয়েলস অনেক ঠান্ডা এলাকা। কি ভাবে আমার ঠান্ডা লেগে যায় বুঝতে পারিনি। প্রতিযোগীতার কিছু সময় আগে অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমি তাবুর নিচে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পের বিছানায় শোয়া। বাবা আমার মাথার পাশে দাঁড়ানো। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন প্রোগাম শেষ হয়ে গেছে তবে এ বিষয় নিয়ে মন খারাপ করার কোনো দরকার নেই। এমন হতেই পারে।

অামার বাবার মতো শিক্ষক অামি অার দেখিনি । যত দূর্বল ছাত্রই হোকনা কেন তিনি সে ছাত্রকে নিয়ে গবেষণা করে অাগে দেখতেন সে কোন পদ্ধতিতে সহজে শিখতে পারবে এবং সে অনুযায়ী তাকে শিখাতেন। তিনি যেমন একজন ভাল সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন তেমনি একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ও ফুটবল প্রশিক্ষক ছিলেন। তাঁর হাতে অনেক ফুটবল খেলোয়াড়ের জন্ম হয়েছে যেমন তেমনি অনেক সঙ্গীত শিল্পীর জন্ম হয়েছে এবং তারা যে যার অবস্থানে আজ প্রতিষ্ঠিত।

আমি তাঁর দূর্ভাগা কন্যা অনেক কষ্ট করে তাঁর শিখানো গানকে ধরে রাখতে পারিনি। ১৭ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে আমার সহজ সরল আনন্দে ভরা জীবনটা খুবই কঠিন হয়ে যায় তাই আর গান নিয়ে এগোতে পারিনি। কিন্তু হৃদয়ে বাবার দেওয়া মন্ত্রনা নিয়ে এখনও আগানোর চেষ্টা করছি। যখন জীবন চলার পথে হুচট খাই বাবার এই কথা গুলী শক্তি হয়ে সামনে চলে আসে –

“শত বাঁধা আসুক তুমি ভেঙ্গে পড়বেনা, তোমাকে যে কোনো বাঁধা মোকাবেলা করতে হবে, তোমাকে দাঁড়াতে হবে, তোমাকে এগোতে হবেই।”

আামর বাবা একজন সমাজ সেবক ছিলেন। তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করছি এবং এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে জীবনের বাকীটা দিন পর্যন্ত।

আজ (২৪ জুলাই) আমার বাবার ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। আপনাদের সবার কাছে আমার বাবার জন্য দোয়া প্রার্থনা করছি। আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেস্ত নসীব করেন।

সুষমা সুলতানা রুহী : সদস্য, সিলেট জেলা পরিষদ
sultana.ruhi1973@gmail.com

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!