বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
Sex Cams

স্কলার্সহোম স্কুল এন্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ ফাবিয়ানের জন্য যা করেছেন তা কোন ভাবেই প্রশংসাযোগ্য নয়



আব্দুল করিম কিম : হাফিজ মজুমদার সাহেব একজন সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্যরা প্রথাগত যে সব অপকর্ম করার অধিকার সংরক্ষণ করেন, তিনি সে সব থেকে দূরেই থাকেন। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে উনি প্রশ্রয় দেন এমন অভিযোগ উনার বিরোধী পক্ষকেও করতে দেখিনি। কয়েকবারের সাংসদ হওয়া সত্বেও দুর্নীতিবাজ বলার সুযোগ নেই। ক্লিন ইমেজ নিয়ে তিনি ভালোই আছেন।

হাজিফ মজুমদার সাহেব খুব ভালো সংগঠক। তিনি নিজের মত করেই চলেন ও বলেন। রাজনীতি নিয়ে বেশী কিছু বলেন না। রাজনীতি থেকে দূরে থাকারই চেষ্টা করেন। প্রশ্ন আসতে পারে মনে, তাহলে তিনি সংসদ সদস্য কেন ?

সেই প্রশ্নের জবাব দিতে বা পেতে এই লেখার অবতারণা নয়। হাফিজ মজুমদার সাহেব প্রতিষ্ঠিত ‘স্কলার্সহোম স্কুল এন্ড কলেজ’-এ ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাইছি।

হাফিজ মজুমদার সাহেব নীজ নামে সিলেটের অন্যতম সচ্ছল ও সফল ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন। যার নাম ‘হাফিজ আহমদ মজুমদার ট্রাস্ট’। এই ট্রাস্টের অধিনে সিলেট মহানগরের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক মোট দশটি পৃথক ক্যাম্পাসে গড়ে উঠেছে ‘স্কলার্সহোম স্কুল এন্ড কলেজ’ নামের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি ট্রাস্টের অধীনে গড়ে উঠলেও এটি সেবামূলক কোন দাতব্য সংস্থা নয়। আগাগোড়া একটি লাভজনক ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়যোগ্য পণ্য হচ্ছে ‘শিক্ষা’। না, এটাও কোন সমস্যা নয়। শিক্ষা নিয়ে সবাই ব্যাবসা করছে। হাফিজ মজুমদার ট্রাস্ট করলে সমস্যা কী ?

ব্যায়বহুল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় হাজার পাঁচেক শিক্ষার্থী রয়েছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে আছেন নাম করা সব শিক্ষাবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। তাঁদের মান সম্মত শিক্ষা ও বিপণন প্রক্রিয়াতে সিলেট নগরের অভিভাবকেরা মুগ্ধ। তাই তাঁর ‘স্কলার্সহোম স্কুল এন্ড কলেজ’-এর ব্যাবসা বাণিজ্য নিয়ে কিছু বলতে চাইছি না। বলতে চাইলে অনেক কিছুই বলা যাবে।

এই লেখা মূলত জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা ‘স্কলার্সহোম স্কুল এন্ড কলেজ’-এর শিক্ষার্থী একটি শিশুর জন্য ও তাঁর পরিবারের জন্য। আর আমাদের মত ‘শিক্ষা পণ্য’ কেনার প্রতিযোগীতায় থাকা অভিভাবকদের জন্য।

‘স্কলার্সহোম স্কুল এন্ড কলেজ’ নামক প্রতিষ্ঠানটির শিবগঞ্জ ক্যাম্পাস থেকে চতুর্থ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে গত সোমবার মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। শিশুটির নাম ফাবিয়ান চৌধুরী (১০)। তিন দিন ধরে সে অচেতন অবস্থায় ঢাকার বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে।

ফাবিয়ান চৌধুরী (১০) নামের ওই শিক্ষার্থীর জীবন সঙ্কটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার রাতে তাকে ঢাকায় নিয়ে গেছেন পরিবারের সদস্যরা। এই অবস্থায় শিশুটির উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত হওয়া সবচেয়ে জরুরী। আর বাংলাদেশে এমন চিকিৎসা মানে টাকার অবিরাম প্রবাহ।

ফাবিয়ানের পরিবারের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে। তাঁকে স্বান্তনা দেয়ার ভাষা আমার নেই।ফাবিয়ানের বাবা ফাহিম আহমদ চৌধুরী ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন, ছেলে স্কুলের ছাদ থেকে পড়ে গেছে বলে স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু ছোট একটা ছেলে পাঁচ তলার ছাদ থেকে পড়লে তো তার হাত-পা ভেঙ্গে যাওয়ার কথা। কিন্তু ফাবিয়ানের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। সিটিস্ক্যানেও মাথায় কোনো আঘাত ধরা পড়েনি। কেবল ফুসফুস দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। ফলে ছাদ থেকে পড়ার দাবিটি বিশ্বাসযোগ্য নয়।

তিনি বলেন, ছাদ থেকে পড়ে গেলেও এনিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এরকম নামি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদ থেকে কিভাবে একটি বাচ্চা পড়ে যায়? স্কুল চলাকালীন সময়ে বাচ্চাদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব তো স্কুল কর্তৃপক্ষেরই।

এই অভিযোগের জবাবে স্কলার্স হোম’র শিবগঞ্জ শাখার অধ্যক্ষ প্রাণবন্ধু বিশ্বাস স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ফাবিয়ানের শ্রেণীকক্ষ স্কুল ভবনের ৪র্থ তলায়। প্রতিদিন ছুটি হওয়ার পর শিক্ষকরা সব শিক্ষার্থীদের লাইন ধরিয়ে নিচে নামিয়ে আনেন। পরে তাদের অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সোমবার দুপুরেও ছুটি শেষে সব শিক্ষার্থীদের নিচে নামিয়ে আনছিলেন স্ব স্ব ক্লাসের শিক্ষকরা। হঠাৎ একজন শিক্ষক শব্দ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখেন নিচে একটি ছাত্র পড়ে আছে। সাথে সাথেই তাকে তুলে এনে মাথায় পানি দেওয়া হয় এবং অভিভাবকদের ফোন দেওয়া হয়।

অধ্যক্ষ বলেন, ফাবিয়ানকে ছাদ থেকে পড়তে কেউ দেখেনি। শব্দ শুনে ও মাটিতে পড়ে থাকায় কেউ কেউ ধারণা করছেন, সে ছাদ থেকে পড়ে থাকতে পারে। কিন্তু ফাবিয়ানের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। ছাদে উঁচু দেওয়ালও রয়েছে। এতো ছোট ছেলের ওই দেয়াল পেরিয়ে পড়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।

তিনি বলেন, উদ্ধারের পর স্কুলের পক্ষ থেকে ফাবিয়ানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সব সময় আমরা তার খোঁজ রাখছি। তার আসলে কি হয়েছে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। সে সুস্থ হয়ে উঠলে বলা যাবে।অধ্যক্ষের সাথে আমরাও একমত ফাবিয়ান সুস্থ হয়ে উঠলে জানা যাবে, কি ঘটেছিল।কিন্তু স্কুল প্রাঙ্গনে দুর্ঘটনায় মুমূর্ষ ফাবিয়ানকে সুস্থ করে তুলতে স্কুল কর্তৃপক্ষ কি উদ্যোগ নিয়েছেন?

আল-হারমাইন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরেই কী উনাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে? ফাবিয়ানকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে পাওয়ার লড়াইটা কী শুধুমাত্র পরিবারের? স্কুল কর্তৃপক্ষ কি সেই লড়াইয়ে পাশে আছেন?

অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ফাবিয়ানকে সিলেটের আল হারমাইন হাসপাতাল থেকে ঢাকাতে গ্রীনলাইন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। আল হারমাইন হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে গেলেই আমাদের মত মধ্যবিত্ত একজন বাবার সমস্ত সঞ্চয় শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। ফাবিয়ানের আত্বীয়-স্বজনরা এগিয়ে আসছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতার কারনে এই দূর্ঘটনা ঘটেছে, উনারা এ পর্যন্ত কি কি দায়িত্ব পালন করেছেন ?

১। শুরুতে অভিবাকদের জানিয়েছেন ফাবিয়ান অসুস্থ
২। ফাবিয়ানকে আল-হারমাইন হাসপাতালে নিয়ে গেছেন।
৩। দূর্ঘটনার কারন অনুসন্ধানে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।
৪। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হাফিজ মজুমদার সাহেব ফাবিয়ানের বাবাকে ফোন করে সমবেদনা জানিয়েছেন।
৫। একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে শিক্ষকদের তোলা ১০ হাজার টাকা চাঁদা দেয়ার চেষ্টা করেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
৬ । একজন ট্রাস্টি ফাবিয়ানকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে মুখ বন্ধ একটি খাম ফাবিয়ানের বাবার হাতে কিছু না বলে দিয়ে এসেছেন।

কোটি কোটি টাকা উপার্জনকারী ‘স্কলার্সহোম স্কুল এন্ড কলেজ’ কতৃপক্ষ্য ফাবিয়ানের জন্য যা করেছেন তা কোন ভাবেই প্রশংসাযোগ্য নয়। তাঁদের দায়িত্বহীনতার কারনেই এই শিশু দূর্ঘটনার স্বীকার। তাই ঘটনার সাথে সাথেই ‘স্কলার্সহোম স্কুল এন্ড কলেজ’ কর্তৃপক্ষের উচিৎ ছিল, ফাবিয়ানের চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বহনের ঘোষণা দেয়া। একি সাথে প্রয়োজনে দেশের বাইরে পাঠানো দরকার হলে সে ব্যাবস্থা করতে প্রয়োজোনীয় উদ্যোগ নেয়া। তদন্ত কমিটি হয়তো জানাবে, ফাবিয়ান শি৮শু সুলভ দুষ্টুমিতে ছাদ থেকে পরে গেছে। অথবা অন্য কোন শিশু তাকে ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু শিশুদের ক্যাম্পাসে এই ধরনের নিরাপত্তাহীন ছাঁদ বা বারান্দা কেন ছিল, সে জবাব কে দেবে? সেই জবাব আদায় করতে হবে।

ফাবিয়ানের উন্নত চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার ‘স্কলার্সহোম স্কুল এন্ড কলেজ’ কর্তৃপক্ষের বহন ও দূর্ঘটনার কারন অনুসন্ধানে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের দাবিতে সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনের পক্ষ থেকে আগামীকাল বিকাল ৫ ঘটিকায় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে নাগরিক বন্ধন কর্মসূচি।

লেখক: বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!