ব্রিটেনের লুটন শহরের ১২ সদস্যের যে ব্রিটিশ বাংলাদেশি পরিবার সিরিয়ার তথাকথিত জিহাদে যোগ দিয়েছিলো তাদের সবারই মৃত্যু হয়েছে। এর মাঝে পরিবারের ৩ পুরুষ আইএস এর হয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে মারা যায়। এছাড়া শিশু-নারীসহ পরিবারের ৭জনের মৃত্যু হয় বিমান হামলায়।
পরিবারের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ সদস্য আবদুল মান্নান ও তাঁর স্ত্রী মিনারা খাতুন মারা যান রোগে ভুগে। তাঁরা দুজনেই ক্যান্সার আক্রান্ত ছিলেন। তাদের সকলের বাংলাদেশের বাড়ি ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও গ্রামে।
তবে আবদুল মান্নানের ভাতিজা সাব্বির আহমদ জানান, তাদের নিহতের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তারা আইএসএ যোগ দেওয়ার পর থেকে তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই।
উল্লেখ্য, ১২ সদস্যের এই পরিবারটি ২০১৫ সালের এপ্রিলের দশ তারিখে বাংলাদেশে বেড়াতে আসে। সেখান থেকে তুরস্ক হয়ে তাদের ফিরে আসার কথা ছিল মে মাসের মাঝামাঝি। কিন্তু ১১ই মে তুরস্কে নামার পর থেকে পরিবারটির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এর দুই মাস পরে সিরিয়া থেকে মান্নান পরিবারের সদস্যরা একটি বার্তায় ইসলামিক স্টেটের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। এখন লন্ডনে থাকা তাদের অন্য আত্মীয়-স্বজনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- মান্নান পরিবারের সকলেই মারা গেছে।
তাদের মৃত্যুর খবর দিয়ে রোববার সংবাদ প্রকাশ করেছে দ্যা ডেইলি মেইল। মান্নানের আগের পক্ষের স্ত্রীর ঘরের ছেলে সেলিমের বরাত দিয়ে মেইল অনলাইন বলছে, পরিবারটির সকলেই এখন মৃত। বাংলাদেশের সিলেটে পরিবারটির আদি নিবাস। সিরিয়া পৌঁছানোর দুই মাস পরে পরিবারটি এক বার্তায় ঘোষণা করে যে তারা ইসলামিক স্টেটের সমর্থন জানিয়ে ওই দেশে অবস্থান করছে।
বার্তাটিতে বলা হয়- ‘আমরা এখন সুখি, এমন একটি দেশে আমরা এখন বাস করছি যেখানে কোনও দুর্নীতি নেই, মনুষ্য সৃষ্ট আইনের নিষ্পেষণ নেই, শরিয়া আইনেই যার শাসন চলছে।’
বার্তাটিতে আরও বলা হয়, ‘হ্যাঁ, আমাদের ১২ জনের পরিবারের সবাই এসেছি, আর এই সংখ্যাটি শুনে কেনো আপনারা আহত হচ্ছেন, যখন বিশ্বের বিভিন্ন অংশ থেকে হাজার হাজার মুসলিম প্রতিদিন দীর্ঘ পথ, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলে আসছে এই ইসলামিক স্টেটে।
মান্নানই ছিলেন যুক্তরাজ্য থেকে আইসিস সমর্থনে সিরিয়ায় পাড়ি জমানো সবচেয়ে বেশি বয়স্ক কোনও ব্রিটিশ। এসময় আঙ্গুল তুলে আইসিসের সমর্থন জানানো একটি ছবিও প্রকাশ করা হয়। তবে ৭৫ বয়সী এই বৃদ্ধ বাবা তখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। আর ওই ছবিটি প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যে রাক্কায় তার মৃত্যু হয়। পরে তার স্ত্রী মিনারাও একই নগরীতে মারা যান। তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
তাদের দুই ছেলে মোহাম্মদ জায়েদ হোসেন, ২৫, ও মোহাম্মদ তৌফিক হোসেন, ১৯, পরে আমেরিকার মদদপুষ্ট সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘঠিত রাক্কা যুদ্ধে মারা যায়। পরে ওই সেনা সদস্যরা ২০১৭’র অক্টোবরে শহরটির দখল নিয়ে নেয়।
পরিবারের অন্য সদস্যরা সিরিয়ার অন্য জিহাদীদের সাথে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, তবে তাদেরও শেষ পরিণতি ঘটে গত বছর বাগুজে। ইসলামিক স্টেটের হাতে থাকা এই শেষ ভু-খণ্ড দখলে যে যুদ্ধ চলছিলো তাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মান্নানের অপর ছেলে মোহাম্মদ আবুল কাশেম, ৩১।
সেখানেই ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদি গ্রুপটির শেষ পরিণতি ঘটে। বারগুজ থেকে পালানোর পথে তখনকার উপযুপুরি বোমা হামলায় পড়ে পরিবারের অন্য সদস্যরা নিহত হন। এরা হচ্ছেন মান্নানের মেয়ে রাজিয়া খাতুন, ২১, ছেলে মোহাম্মদ সালেহ হোসেন, ২৬, ও তার স্ত্রী রোশনারা বেগম, ২৪, তাদের তিন সন্তান ও মান্নানের আরেক পুত্রবধু সাইদা খানম, ২৭।
মান্নানের এক চাচাতো ভাই আবদুল খালিদকে উদ্ধৃত করে মেইল অনলাইন জানায়, বারগুজ থেকে পরিবারের সদস্যদের পালানোর চেষ্টা এবং বোমা হামলায় তাদের মৃত্যু হওয়ার বিষয়টি তারা নিশ্চিত করেই জেনেছেন।
লুটনের একটি মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়তেন মোহাম্মদ মান্নান। সেখানে প্রায় সকলেই জানেন, পরিবারটির সকল সদস্যই এখন মৃত। মসজিদ কমিটির সভাপতি আবুল হোসেনকে উদ্ধৃত করেছে ডেইলি মেইল।
তিনি বলেন, যখন জানতে পারলাম পরিবারটি সিরিয়া চলে গেছে, আমরা খুবই মর্মাহত হলাম। আমরা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, পরিবারটি এমন কিছু করতে পারে। আমরা যে মান্নানকে চিনতাম তার সঙ্গে এই আচরণ কোনওভাবেই মিলছিলো না।
উল্লেখ্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশে রওনা হওয়ার আগের দিন এই পরিবারের লুটনের বাড়ীতে পুলিশ তল্লাশী চালিয়েছিল সন্ত্রাসদমন আইনের আওতায়। এই পরিবারের মেয়ে ২১ বছর বয়সী রাজিয়া খানম নিষিদ্ধ ইসলামী গোষ্ঠী ‘আল-মোহাজিরুনের’ সদস্য বলে মনে করা হয়। সেই গোটা পরিবারকে সিরিয়ায় গিয়ে জিহাদ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।