বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বোবা কান্না।। সৈয়দুর রহমান খান



সৈয়দুর রহমান খান, লেখক

রাত অনেক। সবাই ঘুমুচ্ছে। গোটা বাড়িটা গভীর ঘুমে নিমগ্ন। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। রাত পোহালেই আমার দেশ ত্যাগ করে জীবিকার তাগিদে ভিনদেশে যেতে হবে ।

প্রিয় জন্মভূমিতে আর মাত্র একটা দিন আছি। একদিনপর চলে যাবো অন্য একটা অপরিচিত সংস্কৃতির দেশে। সেখানে আমি হবো প্রবাসী। দেশে এসে আর যদি কোন দিন স্থির হতে না পারি তাহলে আমাকে প্রবাসী হয়েই জীবন কাটাতে হবে। সেই প্রবাসে সবার আপনজন থাকেনা, সেখানে আশপাশের সবাইকে আপন করে নিতে হয়। নব পরিবেশের সব কিছুকে – ভালো হোক আর মন্দ হোক, মানিয়ে চলতে হয়।

সে না হয় মানিয়ে চলবো! কিন্তু যাঁরা আমার আপনজন তাদের আমি প্রতিদিন দেখতে পাবো না! মা-বাবা, ভাই-বোনসহ সকল আপনজন ভুলে অন্য দেশের মানুষ আপন করতে হবে।

এতসব অস্থির ভাবনায় যখন খেই হারিয়ে ফেলেছি তখন মাথাটা একটু বালিশের সাথে চেপে ধরতেই বুঝলাম কোন এক অজানা শ্রাবণের বারি ধারায় ভিজে গেছে আমার বালিশ! এমতাবস্থায় আপ্লুত হৃদয় যেন আরো আপ্লুত হয়ে আমাকে নষ্টালজিয়ায় নিয়ে গেলো…

বিশেষ করে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর রাতগুলো…
আম্মুর সাথে করা বায়নাগুলো…
ভাই-বোনদের সাথে ঝগড়া খুনশুটি সময় গুলো….
ওদের সাথে আর ঝগড়া হবে না। সকালে ঘুম থেকে দেরি করে উঠি বলে আম্মু আর বকবে না। আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে…

তারপরও আবেগাপ্লুত অবুঝ মন এক ভাবনা থেকে আরেক ভাবনায় চলে যাচ্ছে! পরক্ষণেই মনে উঠছে, আচ্ছা আমি যে বিদেশে চলে যাবো তাই মনে করে কেউ কি কাঁদছে? হয়তো কাঁদছে।

আমি নিশ্চিত আজ আম্মুর চোখে ঘুম নেই। খুব ইচ্ছে করছে আম্মুকে গিয়ে বলতে,আম্মু আমার বিদেশের আবদারে কেন না বললেনা। তাহলে তো বেছে যেতাম। এইভাবে পরদেশে দিওনা আমায়। কিন্তু পারছি না। তাতো আর সম্ভব ও না। ভিসা,পাসপোর্ট, টিকেট আমার হাতে তুলে দিয়েছেন আম্মু-আব্বু সবাই…আমার ইচ্ছায়।

তাই পরবাসী হতে চাই না কথাটা মনের গহীনেই লুকায়িত থাকল আর শত ভাবনার দোলায় এক সময় ক্লান্ত চোখের পাতা বুঝে এলো টেরই পেলাম না। যখন চোখের পাতা খুলল তখন ভোর হয়েছে। ঘরে নাস্তা খাওয়ার ব্যস্ততা চলছে। আমাকেও নাস্তা খেতে ডাকা হল।

আমার ভাই-বোন, ভাবী সবাই আমাকে নিয়ে ব্যাস্ত কে কি খাইয়ে দিবে। সবাই খাইয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমার বুক ফেটে কান্না আসছে। আমি ঠিকই কাঁদছি, তবে বোবা কান্না।

এই বোবাকান্না ভিতরে নিয়ে আমি ওদের দিকে শুধুই তাকিয়ে আছি। না চাইলেও ওদের সাথে কাটানো সুখমুহূর্তগুলোতে বারবার ডুব দিচ্ছি। বোবা শব্দে ওঁদের বলছি – আর কয়েকটা দিন থাকতে দেওনা প্লিজ, আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এসব বললে আর ভাবলে কি হবে! ঘড়ির কাঁটার প্রতিটা সেকেন্ড পার হচ্ছে আর আমার এ বাড়িতে থাকার সময়টা ফুরিয়ে আসছে।

হলোও তাই। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে না হতেই আব্বু তাড়া দিলেন রওয়ানা হওয়ার জন্য। দেরি হলে ফ্লাইট মিস হবে। ব্যাগ ভর্তি কাপড়-চুপড়সহ নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছুতে লাগেজ আগে থেকেই যে গোছিয়ে রাখা। যেন কোন ভাবেই ফ্লাইট মিস না হয়।

 

শেয়ার করুন:

প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

error: Content is protected !!